অপু মিত্র তাঁর ‘শুধুই অপচয়’ চিঠিতে (সম্পাদক সমীপেষু, ২১-১০) কলকাতার অবক্ষয়ের দিকটা তুলে ধরেছেন। তাপ্পি দিয়ে রাস্তা সারিয়ে জনগণের টাকার অপচয়, খাদ্যশস্য অপচয়, দান খয়রাতে অপচয় ইত্যাদি। অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু প্রবাসী বাঙালি হিসাবে বাংলার প্রসঙ্গ উঠলেই তাঁকে লজ্জায় মুখ লুকোতে হয়— এই উক্তি মেনে নিতে কষ্ট হয়। জনগণের করের টাকা ভারতের সর্বত্র নেতারা অপব্যবহার করে থাকেন, অপচয়ও সর্বত্র। জাতপাত, মসজিদ, গির্জা, ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিবাহ ইত্যাদি বিতর্কে হিন্দুদের আধিপত্য কর্নাটকে প্রবল, যেটা পশ্চিমবঙ্গবাসীদের মধ্যে তেমন নেই। এটা বাঙালির জন্য খুব গর্বের।
খুশবন্ত সিংহের কালীঘাট টু কলকাতা বইয়ের প্রাক্কথনে মৃণাল সেন লিখেছেন, “রাজীব গাঁধীর মতো একে মৃতপ্রায় শহরই বলুন, কিংবা নয়পালের মতো ‘মৃত নগরী’ তকমা দিন, খুশবন্ত সিংহ কিন্তু জানেন কেন তিনি আমাদের বলছেন, ‘কলকাতা নিয়ে একটাই কথা বলার। তা হল, এ শহর কখনও একটিও বিরস মুহূর্ত দেখেনি।’ খুশবন্ত সিংহ বলছেন যে কলকাতায় আপনাকে বিনোদনের জন্য পয়সা খরচ করে সিনেমা-থিয়েটার যেতে হবে না। কেবল ময়দানে একটু ঘুরে বেড়ালেই পেয়ে যাবেন গল্পকথক, কবি, গায়ক, যাঁরা কিছুই না চেয়ে আপনাকে খুশি করে আনন্দিত হবে।... শরীর অশক্ত, দুর্বল, জীর্ণ হয়েছে, কিন্তু কলকাতার আত্মা এখনও একই রয়েছে— ভালবাসা, স্নেহ, করুণা, সহমর্মিতা আর আশায় পূর্ণ।” সেই ট্র্যাডিশন অপ্রতিহত। এই দৃষ্টিতেই কলকাতাকে দেখা উচিত।
জহর সাহা
কলকাতা-৫৫
মদ বিক্রির টাকা
এ বছর পূর্ব মেদিনীপুরের মাথায় একটা মুকুট যুক্ত হয়েছে। একটি সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, আমাদের জেলা নাকি রাজ্যের মধ্যে ‘শ্রেষ্ঠ’। সেই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা কতটা গর্বের, আর কতটা কলঙ্কের, সে বিচার করা চাই। পরিসংখ্যানটা এই, আমাদের রাজ্যে শুধুমাত্র অক্টোবর মাসের প্রথম ১৫ দিনে যে পরিমাণ মদ বিক্রি হয়েছে, তা নাকি সর্বকালীন রেকর্ড। তার মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুর মদ বিক্রিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এই পরিসংখ্যান রাজ্য সরকারের আবগারি দফতরের দেওয়া।
তমলুক শহরে দুটো সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত মদের দোকান বন্ধের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে নাগরিকদের নিয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে আন্দোলনের সঙ্গে আমি নিজে থেকেছি। দোকান দুটো বন্ধ করতে কমিটি সমর্থও হয়েছে। এ রকম একটা পরিসংখ্যান সুস্থ রুচির মানুষদের কাছে উদ্বেগের। মেদিনীপুর জেলা বিদ্যাসাগর, ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী হাজরা, সতীশ সামন্তের মতো প্রখ্যাত মানুষদের নামের সঙ্গে যুক্ত। এই জেলার ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। আমরা বাসিন্দা হিসাবে গর্ব বোধ করি। কিন্তু আজকের এই পরিসংখ্যান আমাদের সেই গর্বের জায়গাকে কালিমালিপ্ত করেছে। শুধু আমাদের জেলাই নয়, যে ভাবে আমাদের বতর্মান রাজ্য সরকার মদ বিক্রিকে তার রাজস্ব বৃদ্ধির অন্যতম উপায় বলে মনে করছে, এবং সরকারি উদ্যোগে তার আরও বেশি প্রসারের উপর জোর দিচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। সেই সঙ্গে মহল্লায় মহল্লায় সরকারি মদের দোকান খুলছে, সেটার ভবিষ্যৎ পরিণতি ভেবে আমরা আতঙ্কিত।
শুধুমাত্র রাজস্ব বাড়ানোর জন্য একটা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার কি যা খুশি করতে পারে? যে রাজস্ব সরকার আদায় করছে, তার উৎসের যৌক্তিকতা কতটা, বা তার প্রভাব নাগরিকদের বৌদ্ধিক, সামাজিক আচরণগত রুচি-সংস্কৃতির উৎকর্ষের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে প্রশ্ন কি করার দরকার নেই? ন্যায়নীতির দিক থেকে কি বিচার করতে হবে না যে, সমকালীন মূল্যবোধের যথাযথ রূপ তাতে প্রতিফলিত হচ্ছে কি না? এই বিষয়গুলো অনুধাবন করাও একটা সরকারের দায়িত্ব বা কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। নাগরিকদের সর্বনাশ করার অধিকার সরকারকে কে দিয়েছে? মদ নামক তরল পানীয়টির প্রভাব এক জন মানুষের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক এবং সর্বোপরি তার সামাজিক সম্পর্ক এবং সামাজিক সম্মান ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। এই পদার্থটি এক জন মানুষকে তার সমাজ থেকে, তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে সামাজিক ভাবে এত অসহায় করে যে, সে বেঁচে থাকার ইচ্ছে পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। মনুষ্যত্ব ধ্বংসের উপর যে সরকারের রাজস্ব নির্ভর করে, আমরা নিন্দা করি সেই সরকারকে। এই রাজস্বের উপর নির্ভরশীল যে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, যুবশ্রী প্রকল্প, তা-ও আমরা চাই না। কারণ, এক জন মদ্যপ কখনও এক জন কন্যার আদর্শ পিতা, ভাই বা স্বামী হতে পারে না। স্বামী মদ্যপ হলে এক জন নারীকে বাস্তবে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, সে অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সবার আছে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “মানুষকে পশু না বানাইতে পারিলে তাহাকে দিয়া পশুর মতো কাজ করানো যায় না।” আমাদের সরকার হয়তো সেই দায়িত্বই নিয়েছে। কারণ, সচেতন শিক্ষিত নাগরিকের অস্তিত্ব জনবিরোধী নীতি প্রণয়নের পথে বাধাস্বরূপ। তাই চেতনায় আঘাত করা সবার আগে জরুরি। সেই কাজে মদ-সহ নানা নেশাদ্রব্যের বিকল্প কিছু নেই। মানুষকে ধর্ম দিয়ে, নেশা দিয়ে মাতিয়ে রাখতে পারলে, তাদের চেতনাকে নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখতে পারলে, শাসকের ইচ্ছেমতো সেই মানুষগুলোকে ব্যবহার করা সম্ভব। তাই এর বিরুদ্ধে সমবেত ভাবে রুখে দাঁড়ানো দরকার।
সূর্যকান্ত চক্রবর্তী
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
অন্ধকারে
কলকাতার বহু মূর্তির মধ্যে আকাশবাণী ভবন ও রাজভবনের নিকটবর্তী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পূর্ণাবয়ব একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূর্তি। এই পথে যাতায়াতের কালে এটি প্রায় সবার চোখে পড়ে। প্রতি বছর ২৩ জানুয়ারি এখানে নেতাজির গলায় মালা পরিয়ে শ্রদ্ধা জানান বহু সাধারণ মানুষ, এবং তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন দলের নেতা, মন্ত্রীরাও। এ সব ছবি কাগজে ছাপা হয়, টিভি-মোবাইলের পর্দায় প্রদর্শিত হয়। সম্প্রতি লক্ষ করছি, মূর্তির মাথার উপর আলোর কোনও সুব্যবস্থা না থাকার কারণে সন্ধ্যার পর এই মূর্তি অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। বিলম্ব না করে উপযুক্ত আলোর ব্যবস্থা করা দরকার।
বঙ্কিমচন্দ্র বেরা
কলকাতা-১৩
অনড় সরকার
বেশ কয়েক সপ্তাহ আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ছাত্রদের অনশন বিক্ষোভ চলছে, যাতে ইন্টার্নরাও শামিল হয়েছেন। ফলে হাসপাতালের স্বাভাবিক পরিষেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। দু’জন ছাত্র অনশন করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাজ্যে এই চিত্র বিগত কিছু বছর ধরে দেখা যাচ্ছে। হয় হবু শিক্ষকরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, নাহয় হবু পুলিশ, কিংবা হবু ডাক্তাররা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। কিন্তু সবচেয়ে অবাক বিষয়, এই পেশার মানুষদের বিক্ষোভের ক্ষেত্রে সরকারের বিন্দুমাত্র নরম মনোভাব দেখা যায় না। অথচ, যখনই টালিগঞ্জের তথাকথিত টেলি তারকারা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন, তখন এক দিনের মধ্যে রাজ্যের তাবড় তাবড় মন্ত্রী সেই বিক্ষোভ মঞ্চে উপস্থিত হয়ে সমাধান সূত্র বার করে আনেন। সে ক্ষেত্রে সরকারের ‘মানবিক’ মুখ দেখা যায়। চলচ্চিত্র, টিভি সিরিয়ালের অভিনেতাদের সমাজে কতটুকু অবদান আছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে তাঁদের জন্য রাজ্য সরকারের প্রশংসনীয় তৎপরতা দেখা যায়। ঠিক উল্টো দিকে রয়েছেন তাঁরা, যাঁরা সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। তাঁদের প্রতি সরকারের আচরণ আমাদের স্তম্ভিত করে। কলকাতার হাসপাতালগুলো রোগী সামলাতে হিমশিম খায়। তার উপর করোনা আবহে একটি বিশিষ্ট হাসপাতাল ঠিকমতো পরিষেবা দিতে পারছে না। দ্রুত সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
চন্দ্র মোহন নন্দী
কলকাতা-৭৮