শিবাজীপ্রতিম বসুর ‘স্বতন্ত্র, একক এবং সবল’ (২৬-৯)-এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলছি। বিদ্যাসাগরের কথা বলতে গেলে অনিবার্য ভাবে রামমোহনের কথা আসবেই। কারণ, ভারতীয় নবজাগরণের উষাকাল বলতে আমরা রামমোহনের সময়কেই বুঝি। আর বিদ্যাসাগরের সময়টা ছিল ভারতীয় নবজাগরণের বলিষ্ঠ রূপের প্রকাশকাল। যে সময়ে রামমোহন রায় জন্মেছিলেন, সেই অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়েও সতীদাহ প্রথা নিবারণের জন্য যে আন্দোলনে তিনি সাফল্য লাভ করেছিলেন, তা অত্যন্ত কঠিন ছিল। ১৮২৯ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সহযোগিতায় এই প্রথা নিবারণে একটি আইন পাশ হয়েছিল। আর ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন প্রণীত হয়েছিল। প্রসঙ্গত, রামমোহন সতীদাহ প্রথা নিবারণের পাশাপাশি আন্দোলন করেছিলেন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে, নারীর সম্পত্তির অধিকার সুনিশ্চিত করতে। নবজাগরণের পীঠস্থান হিসাবে পাশ্চাত্য দেশগুলির সম্পর্কে তাঁর জানার আগ্রহ ছিল সীমাহীন। ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তিনি আরবি ভাষায় কোরান পড়েছেন, হিব্রু ভাষায় বাইবেল পড়েছেন এবং সংস্কৃত ভাষায় বেদ-বেদান্ত পড়েছেন। তাঁর প্রচারিত ধর্মতত্ত্ব তাই ছিল একেশ্বরবাদী, এবং মুক্তমনা। তাঁর সমস্ত কাজ ছিল মানবকল্যাণমুখী। অশিক্ষা, অজ্ঞতা, দারিদ্রপীড়িত দেশে তিনি ‘ভগবান, ভগবান’ করার মধ্যে কোনও সার্থকতা খুঁজে পাননি।
অথচ, আজ স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে প্রাচীন ঐতিহ্যের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে এক অন্ধকার মধ্যযুগীয় পরিমণ্ডল রচনার অভিনব প্রয়াস আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। এঁরা আধুনিকতার বিরোধী এবং সেই অর্থে বিদ্যাসাগরেরও বিরোধী। কিন্তু কেন? নবজাগরণের এই মহান পথিকৃৎ-এর জন্মদিবসে তা আলোচ্য হলে ভাল লাগত। দ্বিতীয়ত, প্রবন্ধকার তাঁর বক্তব্যের শেষে লিখেছেন, “বাঙালি জাতির কাছে বীরসিংহের ধুতি-চাদর পরা মানুষটি এত আধুনিক এত অনুসরণযোগ্য।” কোনও এক স্থানে কারও জন্মগ্রহণ বড় বিষয় নয়, তাঁর কর্মধারা হয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। উল্লেখযোগ্য, তাঁর সময়ে বিদ্যাসাগর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বিদগ্ধ সমাজে ছিলেন এক বহুল চর্চিত নাম।
তপন কুমার সামন্ত
শিয়ালদহ, কলকাতা
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিন্তাধারার সংমিশ্রণে ব্রতী বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য বিদ্যার মধ্যে সম্মিলনের সেতু স্বরূপ হয়েছিলেন...।” স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রেও তাঁর নিকট সমাজ কৃতজ্ঞ। বিদ্যাসাগরের কাছে শিক্ষা ছিল মানুষের মন থেকে কুসংস্কার দূর করে সুস্থ মানবিক বোধ জাগিয়ে তোলার অস্ত্র। তাই তিনি সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভান্ডার থেকে জ্ঞান আহরণ করে বাংলা শিক্ষার বুনিয়াদকে রচনা করতে চেয়েছিলেন (বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ, বিনয় ঘোষ)। অপর দিকে, বাল্য বিবাহ, বিধবা বিবাহ প্রভৃতি হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারগুলি সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধাচারণ সামাজিক গোঁড়ামিকে আঘাত করতে সমর্থ হয়েছিল।
ফ্রেডরিক জে হ্যালিডে (বাংলার ছোটলাট পদে যোগ দেওয়ার পূর্বে শিক্ষা পরিষদের সদস্য ছিলেন) সাহেবের উৎসাহে বিদ্যাসাগর মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের জন্য একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, কেবল লিখন-পঠন ও সামান্য অঙ্কের মাধ্যমে মাতৃভাষায় শিক্ষা চালু রাখলে হবে না। তা পূর্ণাঙ্গ করতে হলে ইতিহাস, ভূগোল, জীবনচরিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতিশিক্ষা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং শারীরবিজ্ঞান সম্পর্কেও শিক্ষা দেওয়া উচিত। সমাজ সংস্কারক হিসাবে বাল্য বিবাহের কুফল সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর প্রথম কলম ধরেন। তিনি বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে শাস্ত্র দিয়েই শাস্ত্রের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে এ সম্পর্কে বইপত্র লেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিধবা বিবাহ আইন চালু করতে হবে, আর এ জন্য রাষ্ট্র এবং সমাজের সমর্থন প্রয়োজন। স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর নিজের কর্মপ্রয়াসকে বেথুন স্কুলের ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে গ্রামবাংলার বিভিন্ন জায়গায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ১৮৫৮-র ১৫ মে-র মধ্যে তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারকদের অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয়ের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে হয়েছিল। এ থেকে বিদ্যাসাগরও মুক্ত ছিলেন না। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে যিনি প্রবাদপ্রতিম, তিনিই আবার নিজের স্ত্রী-কন্যার শিক্ষা বিষয়ে একান্ত উদাসীন ছিলেন। পুত্রবধূদের লেখাপড়া শেখারও একান্ত বিরোধী ছিলেন। উনিশ শতকের প্রথমে শিক্ষিত হিন্দু যুবকদের কণ্ঠে ধর্মকে ঘৃণা করার কথা শুনেছিলেন। তাঁরা বিধবা বিবাহের সমর্থনে এবং বহু বিবাহের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। অথচ, শতাব্দীপ্রান্তে এসে শুনলেন চন্দ্রনাথ বসুর মতো এম এ পাশ যুবক বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহের সমর্থনে বক্তব্য রাখছেন। বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে অক্ষয় চন্দ্র সরকার বিষোদ্গার করছেন। সহবাস সম্মতি বিলের বিরোধিতা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। বাঙালি সমাজের এই পিছু হটাকে প্রকারান্তরে তিনি কি সমর্থন জানিয়েছিলেন? তবে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বটুকু পেরিয়ে উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় বিদ্যাসাগর আমাদের
নিকট চিরস্মরণীয়।
সঞ্জয় রায়
দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
নিশ্চিহ্ন হয়নি
‘স্বতন্ত্র, একক এবং সবল’ লেখাটি সুখপাঠ্য। সতীদাহ, বিধবা বিবাহ, বাল্য বিবাহ রদ করতে মনীষীরা অনেক লড়াই করেছেন। বিভিন্ন ভাবে যুক্তি খাড়া করেছেন। তবে এ সব প্রথা সমাজ থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়নি। আড়ালে, আবার কখনওসখনও প্রত্যক্ষ ভাবেও রয়ে গিয়েছে। খবরের কাগজে এক-এক সময় আদালতের এক-এক রকম রায় পড়ি— পরকীয়া অবৈধ নয়, স্বামী স্ত্রীর মালিক হতে পারে না। আবার অন্য দিকে, রাজস্থানে বাল্য বিবাহ নথিভুক্তকরণে সায় দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, সমাজে বহু বিবাহও কি ঘটছে না? এমনকি পাচারের মাধ্যমে নারীর উপর যৌন নির্যাতন চালানোর ঘটনা? আধুনিক সমাজব্যবস্থায় এ সব বৈধব্য বা স্বামীর চিতায় সহমরণের চেয়ে কম কিছু কি?
মুন্সি দরুদ
সিউড়ি, বীরভূম
জন্মদিন
বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনীতে লিখেছিলেন— “শকাব্দঃ ১৭৪২, ১২ই আশ্বিন, মঙ্গলবার, দিবা দ্বিপ্রহরের সময় বীরসিংহ গ্রামে আমার জন্ম হয়। আমি জনকজননীর প্রথম সন্তান।” বঙ্গাব্দ অনুযায়ী, ১২২৭ সালের ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার। আবার খ্রিস্টাব্দ অনুযায়ী, ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী রাজ্য জুড়ে বা রাজ্যের বাইরেও ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখটিকে জন্মদিন হিসাবে পালন করা হয়েছে। অথচ, ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১২ আশ্বিন বীরসিংহ গ্রামে তাঁর জন্মদিন পালন করা হত। কিন্তু প্রশাসনিক উদ্যোগে গত বছরে ইংরেজি তারিখ মেনে তা ২৬ সেপ্টেম্বর বা ৯ আশ্বিন পালন করা হয়েছে। যদিও ১২ আশ্বিন আবার পালন করা হয়েছে।
এই বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন আমরা ২৫ বৈশাখ ও তিরোধান দিবস ২২ শ্রাবণ পালন করে আসি, সেখানে বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রেও বাংলা তারিখকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। অনেকেই মনে করেন বিদ্যাসাগরের জন্মদিনটি পশ্চিমবঙ্গে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসাবে পালন করা হোক। সে বিষয় নিয়েও ভবিষ্যতে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।
নরসিংহ দাস
মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর