একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২-র এই পবিত্র ক্ষণে বাংলাদেশের প্রতিবাদী জাগ্রত জনতা, বিশেষত তরুণ ছাত্রদের আত্মবলিদান পৃথিবীর ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে রয়েছে। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় তাদের আত্মত্যাগ আজও আমাদের চিন্তা-চেতনাকে ভীষণ ভাবেই আলোড়িত করে।
ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আমাদের জাতীয় মর্যাদা। ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার অর্থই হল মায়ের বুক থেকে তাঁর সন্তানকে কেড়ে নেওয়া। বাক্স্বাধীনতা ও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার অধিকার হরণ করা। সেই ভাষার প্রতি আক্রমণ ও অপমান মেনে নেওয়া যায় না। অথচ, সে দিন পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী বর্বরোচিত উপায়ে জনগণের কণ্ঠরোধ করে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে উর্দুভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরের জনতার প্রতিবাদী স্বরে স্লোগান উঠেছিল— ‘আমরা কেউ ফিরে যাওয়ার জন্য আসিনি’, ‘উর্দু বাংলা বিভেদ নাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আওয়াজ ওঠে— ‘মনে রেখো আজ যদি আমরা পিছিয়ে পড়ি তবে আগামী কাল একটা জাতি মরবে’। এর পরেই চলে জনতার উপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, শোনা যায় বন্দুকের গর্জন এবং গুলিও। বাংলা ভাষার জন্য শহিদ হলেন রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত, আব্দুস সালাম, আব্দুল জব্বার এবং আমার রোশেনারা বোনেরা। রাতারাতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হস্টেলের সামনে শহিদ বেদি তৈরি হয়। সেই বেদি পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য পুনরায় তা নির্মিত হয়।
সূর্যস্নাত সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে বাংলা ভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রতিবাদী বীর সন্তানদের বুকের তাজা রক্তে মুক্তাঙ্গনের সবুজ ঘাস টকটকে লাল হয়ে উঠেছিল। বাংলা ভাষা আন্দোলনের এই উদাত্ত আহ্বানের ঢেউ উদ্বেলিত করেছিল স্বাধীনোত্তর ভারতের অসমের শিলচর উপত্যকাকে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য প্রতিবাদী আন্দোলনে আত্মবলিদান দিলেন— কমলা ভট্টাচার্য, তরণী দেবনাথ, হিতেশ বিশ্বাস, সুনীল সরকার, কানাইলাল নিয়োগী, কুমুদ দাসের মতো এগারো জন তরুণ-তরুণী। ১৯৫২-র বাংলা ভাষা আন্দোলন পরিণতি পায় ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে। সর্বাত্মক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একটা দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন অধ্যায় হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছে।
মুস্তাক আলি মণ্ডল
আমতা, হাওড়া
গুরুত্ব আছে?
মাতৃভাষা ‘মাতৃদুগ্ধসম’। কিন্তু ওই এক দিনই কি মাতৃভাষা নিয়ে হইচই যথেষ্ট? বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার জন্য কত বলিদান, তা কি আজকের প্রজন্মের বাঙালি জানে? বাংলা ভাষার গুরুত্ব তাদের কাছে কতটুকু? আমরা কতটা দায়িত্ববান আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য?
উৎসব আনন্দ উদ্যাপনে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু মাতৃভাষা নিয়ে আমরা যতটা না উৎসবমুখর, ততটা কি সচেতন? আজকের ঝাঁ চকচকে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমে পড়া প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা কতটা আপন? বাড়ির বৈঠকখানা বা পড়ার ঘর থেকে রবীন্দ্র, বঙ্কিম রচনাবলি থেকে সুনীল শামসুর রহমানের স্থান দখল করেছে জনপ্রিয় হিন্দি বা ইংরেজি সাহিত্য। সত্যজিৎ, ঋত্বিক, তরুণ মজুমদার হারিয়ে গিয়ে ওয়েব সিরিজ়ের দাপাদাপি। বিজ্ঞাপনে ভুল বাংলা বানানের ছড়াছড়ি। রাজনৈতিক নেতাদের মুখে স্লোগানের নামে অশ্লীল বাংলা শব্দ। বাংলা গানের বদলে ডিজে। বাংলা, বাঙালি, বাংলা ভাষা সবটাই যেন আজ বড় ম্লান। বাংলা ভাষা যেন আজ আর আমাদের প্রাণের সঙ্গে যুক্ত নেই।
ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
শিলিগুড়ি
প্রতিবাদ কই
বর্তমান সময়ে বাঙালিদের উপর চরম ভাষাসন্ত্রাস অব্যাহত। শুধু তা-ই নয়, গণতান্ত্রিক ভারতে আজ বাংলা ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, খুব সহজেই তাঁদের উপর বিদেশি, বাংলাদেশি, অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরানো, আত্মত্যাগ, আত্মবলিদান করেছে বাঙালিরাই। তাদের উত্তরসূরিদেরই আজ বিদেশি আখ্যা দিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা চলছে। ‘হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা’ এই বলে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ, ভারতীয় সংবিধানে হিন্দি রাষ্ট্রভাষা— এমন কোনও উল্লেখ নেই, ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় আঘাত হেনে এক ভাষা-এক ধর্ম-এক রাষ্ট্র বা হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান তৈরির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে।
হিন্দি ভাষাকে শিক্ষাক্ষেত্রে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে অধিকাংশ মানুষই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। বর্তমানে অধিকাংশ প্রতিবাদই হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে, সামাজিক কারণে যে প্রতিবাদ হচ্ছে, সেইগুলোকেও রাজনৈতিক রং লাগানো হচ্ছে। প্রকৃত সমস্যার কোনও সমাধান হচ্ছে না। এমতাবস্থায় আমাদের দায়িত্ব দৈনন্দিন জীবনের সব কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার আবশ্যক করা। রাষ্ট্রপুঞ্জ আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকেই বিশ্বের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। সমস্ত হীনম্মন্যতা ভুলে, সমস্ত ষড়যন্ত্র ভেদ করে বাংলা ভাষাকে নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ব্যক্তিগত ইচ্ছায় বা জ্ঞান আহরণের জন্য যে কোনও ভাষা শেখা যেতেই পারে। কিন্তু সামাজিক কাজে প্রতিষ্ঠা পাক বাংলা ভাষা।
তপোময় বিশ্বাস
কলকাতা-৪
নানা রূপে ভাষা
শিশু জন্মের পরে প্রথম যে ভাষায় তার গর্ভধারিণীকে ডাকে, সেটাই তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমে আমরা যতটা পরিপূর্ণ ভাবে এবং সহজে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি, সে ভাবে অন্য কোনও ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়তো সম্ভব নয়। আবার বেদনা-বিরহে যে ভাবের সৃষ্টি হয়, তখন তাকে প্রকাশ করতে গেলেও ভাষার দরকার। আমাদের প্রায় সকলেরই মাতৃভাষার উপর দখল সবচেয়ে বেশি। সেই কারণে সুখ, দুঃখ সব কিছুই মাতৃভাষার মাধ্যমে সবচেয়ে ভাল ভাবে প্রকাশ করতে পারি। মাতৃভাষা হল ভাবের ভাষা। প্রেম থেকে কলহ— সবেরই সাবলীল প্রকাশ ঘটে মাতৃভাষায়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু আমরা অনেকেই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারি না। কারণ আমরা যেখানে জন্মগ্রহণ করি, সেখানকার একটা নিজস্ব ভাষা থাকে। এই আঞ্চলিক ভাষাই আমাদের প্রথম ভাষা। যেমন— এক জন গ্রামের মানুষ যে ভাষায় কথা বলবেন, এক জন শহরের মানুষ হয়তো অন্য ভাবে একই কথা বলবেন। দুটো ভাষাই বাংলা। গ্রামের মানুষটির কাছে গ্রামের কথ্যভাষাটাই তাঁর জীবনের প্রথম ভাষা। তিনি শহরে এসে যখন শহরের মতো করে কথা বলতে চাইলেন, তখন আঞ্চলিক টান মিশ্রিত হয়ে যে বাংলা ভাষার জন্ম হল, সেই ভাষা তাঁর কাছে দ্বিতীয় ভাষা। আর শহরের নিজস্ব ভাষা তাঁর কাছে হয়ে যায় তৃতীয় ভাষা।
সারা ভারতের মানুষকে বুঝতে এবং চিনতে গেলে হিন্দি জানতে হবে। আবার বিশ্বকে জানতে গেলে ইংরেজি জানা দরকার। কিন্তু মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার যে বিকাশ ঘটে, অন্য কোনও ভাষায় তা হতেই পারে না। কারণ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা যতটা হৃদয়ঙ্গম হবে, সেটা অন্য কোনও ভাষাতে হবে না। আজকাল সন্তানের ভবিষ্যৎ পেশার অভিমুখ ঠিক করতে অভিভাবকদের একটা বড় অংশ ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানদের পড়াচ্ছেন। ফলে, বাংলা ভাষার চর্চা অনেকটা কমে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চা ভীষণ ভাবেই জরুরি।
সনাতন পাল
বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর