‘হুতোম কোথায়’ (২০-৩) প্রবন্ধে সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, বাঙালি হুতোমের তুল্য বই আর হল না বলে আক্ষেপ করেই চলেছে। তা-ই যদি হত তবে সৃজনশীল বাঙালি এত দিনে হুতোম প্যঁাচার নকশা-র মতো আত্মবীক্ষণমূলক রঙ্গরচনা আরও কয়েকখানি লিখে ফেলত। আসলে বাঙালি হুতোমের মতো তীব্র আত্মবিশ্লেষণমূলক রঙ্গব্যঙ্গের প্রয়োজনীয়তা আর অনুভব করে না। সরস রসিকতা, হাস্যরস বা রঙ্গব্যঙ্গের অভাবে যে বাঙালি-মানস যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে, শুষ্ক হৃদয় নিয়ে শুধুই অর্থ প্রতিপত্তির পিছনে ছুটে জীবন থেকে আনন্দ সরে যাচ্ছে, সে বিষয়ে বাঙালি সচেতন নয়। তবে হুতোমের পরে শুধুই গুরুগম্ভীর তৎসম শব্দ প্রয়োগে সাহিত্য নয়, অনেক বুদ্ধিদীপ্ত সরস রম্যরচনাও তৈরি হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। শরৎচন্দ্র তাঁর বৈঠকি আড্ডাতে বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেল দিয়ে যে মজার কাহিনি শোনাতেন, সে সব পরে সাহিত্যে নথিভুক্ত হয়েছে। শিবরামের হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের মধুর রঙ্গরস বাঙালিমাত্রেই উপভোগ করেছেন। মুজতবা আলি কাবুলের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে দেশে বিদেশে বইতে লিখেছেন, শালপ্রাংশু বৃহদাকার যে আফগানেরা তাঁর অভ্যর্থনায় এসেছিলেন, তাঁরা তাঁর লাগেজটিকে দেশলাই বাক্সের মতো লুফে নিলেন, এমন কোলাকুলি করলেন যে তাঁর বাঙালি বক্ষপঞ্জর মড়মড় করে ভেঙে পড়ার উপক্রম। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিক তো এই কিছু দিন আগে পর্যন্ত বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। টেলিফোন বিভ্রাট-এ, “হ, আমি জানোয়ার, তবে সিংহ” বা নব রামায়ণ-এ, “হনুমান লক্ষ্মণের লাইগ্যা বিশল্যকরণী আনতে গিয়া দেরি হয় দেইখ্যা সূর্য্যরে কপাৎ কইরা বগলে নেয় নাই? সেই থিকা বেবাক হিট বগলে” ইত্যাদি মানুষের মুখে মুখে ফিরত।
তবে লেখক ঠিকই বলেছেন যে, গত ৩০ বছরে টেলিভিশনে যে রঙ্গকৌতুক হয়েছে, তাকে বড়জোর ভাঁড়ামো বলা যেতে পারে। বর্তমান নেটমাধ্যমে যে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হয়, তাকে ক্রিকেটীয় পরিভাষায় ‘স্লেজিং’ বলা যায়। কোনও ভাবেই তা ‘স্যাটায়ার’ নয়। অথচ, বর্তমান পরিমণ্ডলে জীবনটাই কৌতুকে পরিণত হয়েছে। এই যে কিছু দিন আগে ‘কাজ করতে পারছি না’ বলে দলবদলের হিড়িক দেখা গেল, আবার শাটল ককের মতো ফিরে এল পুরনো দলে, এ কি কৌতুক নয়? অপুষ্টিতে শিশু মরে, অতিমারিতে গঙ্গায় লাশ ভেসে যায়। জীবনের এই বাস্তব রঙ্গ যদি হুতোমের নকশায় আঁকা যেত, তা হলে তা আনন্দের মোড়কে
প্রকাশ হত। সেই অভাববোধের জন্যই এত হাহুতাশ।
শিখা সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১
কৌতুক অবসর
হুতোমি ভাষাকে শুধু ভাষা-ছাঁদের বিষয় বলে ধরলে বোধ হয় অর্ধেকটা বিশ্লেষণ করা হয়। বাকি অর্ধেকটা সন্নিহিত আছে দর্শনে। প্রশ্ন হল, আজকের সমাজে উপাদানের কোনও কমতি নেই। কিন্তু হুতোমি ফিলোজ়ফি তৈরি হচ্ছে না। কেন? এ দোষ (বা বৈশিষ্ট্য) শুধু সাহিত্যের চলনের উপরেই বর্তায় না। হুতোমি সমাজের মধ্যেই এর কারণ লুকিয়ে আছে। হুতোমি ভাষাকে সহ্য করার সহনশীলতা সেই সমাজের ছিল। কিন্তু আজকের সমাজ কি তা পারবে? দ্বিতীয় কথা হল, হুতোম আছে, হুতোমের কলমও আছে, হুতোমের সময় নেই। রঙ্গ করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন উদাসীন দৃষ্টি আর স্থিরতার প্রয়োজন। আজ সেই অবসর এই সমাজ কাউকে দেয়নি। কিছু না থাকলে আধার কার্ড, ভোটার কার্ডের বানান ভুল ঠিক করানোর জন্য মাসের পর মাস ছুটে বেড়াতে হয়। একটা নিশ্চিত রোজগারের আশায় প্রতিভাবান চাকরিপ্রার্থীরা জলকামানের সমাদরে জ্ঞান হারাচ্ছেন, বিষপান করছেন। এক দিকে লোকের অভাবে কাজ হচ্ছে না, আর এক দিকে কাজের অভাবে লোকে ঘুরে মরছে। কে বলতে পারে এঁদেরই কেউ মনে মনে কলম চালাচ্ছেন। সুযোগ পেলেই যুদ্ধে নামবেন। কিন্তু সমাজ ঠিক করেছে, এ সুযোগ দেওয়া চলবে না।
শঙ্খ অধিকারী
সাবড়াকোন, বাঁকুড়া
কমিটিজীবী
‘কবিরা কোথায়!’ (২৭-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে সঠিক মন্তব্য করা হয়েছে, “এখন তাই কবিদের জগৎ বাধ্যতামূলক ভাবে রাজনীতি-জগৎ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, ছাড়ান নেই।... কবিরাও অনেকে খুশিমনে রাজনীতির বাইটপ্রবণ ক্রীড়নক হয়েছেন।... কবিকে আলপিন থেকে হাতি সব নিয়ে জুতসই কোট কেন দিতে হবে, সে প্রশ্ন শুনে আজ যাঁরা রাগ করছেন, তাঁদেরও মানতে হবে যে কবিরা এ জন্য কম দায়ী নন।” তবে বর্তমান বঙ্গ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে শুধু কবি নয়, সামগ্রিক ভাবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের জন্যও এই মন্তব্য সমান ভাবে প্রযোজ্য। কবিরা সমাজের অংশ, তাই রাজনীতিতে একটি নির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়া স্বাভাবিক। পরাধীন দেশে জালিয়ানওয়ালা বাগের কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ নাইটহুড ত্যাগ করেছিলেন, বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে পথে নেমে রাখিবন্ধন উৎসবের সূচনা করেছিলেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্ট ফ্র্যাঙ্কোকে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছিলেন ইভলিন ওয়, যেখানে হাক্সলে, এলিয়ট, এইচ জি ওয়েলস প্রমুখ নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন। এজ়রা পাউন্ড ছিলেন হিটলারের ঘোরতর সমর্থক। বাংলাতেও বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, জর্জ বিশ্বাস প্রমুখ নিজেদের বামপন্থী বিশ্বাসের কথা সরাসরি ঘোষণা করেছেন, একই কথা ‘পদাতিক কবি’ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে শেষ জীবনে তিনি মমতা-ঘনিষ্ঠ হয়ে দলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক বিশ্বাসও তাঁদের গুণগ্রাহীদের কাছে গোপন থাকেনি। যদিও মরিচঝাঁপির নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষেরা গর্জে উঠেছিলেন।
পূর্বতন বাম শাসনের গোধূলি লগ্নে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে পরিবর্তনপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সরব হতে দেখা গিয়েছিল। মিছিলে হাঁটতে, টিভির আলোচনা চক্রে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে, রাজপথের হোর্ডিং-এ পরিবর্তনের আহ্বান জানাতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেননি। ক্ষমতার বিপ্রতীপে গিয়ে শাসকের বিরুদ্ধাচরণ করার সাহসের জন্য এই সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতারা জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেন। বস্তুত ‘বুদ্ধিজীবী’, ‘বিদ্বজ্জন’, ‘সুশীল সমাজ’ ইত্যাদি শব্দবন্ধের বহুল প্রচলন সেই সময় থেকে চালু হয়।
তৃণমূলের জমানায় এঁদেরই একাংশকে ক্ষমতার বৃত্তে প্রবেশ করতে দেখে অনেকেই অবাক হন। রামপুরহাটে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে তাঁদেরই কারও কারও যেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে, তা নিরাশ করতে বাধ্য। প্রশ্ন উঠতে পারে, সে দিনের পরিবর্তনকামী বুদ্ধিজীবীদের কি আজ তা হলে সাময়িক বিস্মৃতি ঘটল? তাঁদের বক্তব্যগুলি আজ তীব্র ভাষায় সমালোচিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সমাজমাধ্যমে। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি থেকে সম্ভ্রমের ভাব যেন খসে পড়ে গিয়েছে। মানুষ এখন বুদ্ধিজীবীদের হাওয়া মোরগের সমতুল্য বলে মনে করে কত না রঙ্গব্যঙ্গ করছে।
“বঙ্গে কালস্রোতে বিপ্লবী কবি কমিটিজীবী হন! ক্রুদ্ধ শিল্পী গ্যালারি মালিক হন! আর সুর-হারানো গায়ক লোকসভা ভোটে দাঁড়ান!” আট বছর আগে একটি দৈনিকে সাংবাদিকের কলমে লিখেছিলেন সুমন দে। এই কটাক্ষ আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
রাজশেখর দাশ
কলকাতা-১২২
উপহারে বই
সুপ্রিয় দেবরায় তাঁর ‘অমূল্য উপহার’ চিঠিতে (১৬-৩) আক্ষেপ করেছেন, এখন আর কেউ অনুষ্ঠানে বই উপহার দেন না। কিন্তু বই উপহার দেওয়ার সমস্যাও ছিল। একাধিক সঞ্চয়িতা, সঞ্চিতা, শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প বা উপন্যাস হাতে আসত। আবার, যাঁকে উপহার দেব তিনি বইপড়ুয়া হলে তাঁর বইটি পড়া থাকতে পারে। তাই এখন ‘গিফট ভাউচার’ দেওয়াই শ্রেয়। তিনি নিজের ইচ্ছামতো বই কিনে নিতে পারবেন।
সুদীপা রায় (ঘোষ)
কমলপুর, উত্তর ২৪ পরগনা