স্বাতী মৈত্রের ‘পরীক্ষা হলেই কি মূল্যায়ন হয়?’ (৩১-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে লেখক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেছেন— দ্বাদশ শ্রেণিতে সফল ছাত্র অনার্স পড়তে এসে যখন স্বাধীন ভাবে একটি বাক্যও লিখতে পারে না, সেই মূল্যায়নের কী দাম? প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পর্কিত একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্ত ছাত্রেরও ওই একই অবস্থা, অর্থাৎ এম এ বা এম এসসি উত্তীর্ণ প্রার্থীও একটি অধ্যায় পড়ে বুঝতে পারে না বা একটি বাক্যও সঠিক ভাবে লিখতে পারে না। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। তা হলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়নেরই বা কী দাম?
অনেক বছর আগে, বিদ্যাসাগর ব্রিটিশ আমলের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বলেছিলেন, “বি এ বা এম এ পাশ ব্যক্তিও লেখেন ‘আই হ্যাজ়’, কারণ তাঁরা একই যন্ত্রে একই ছাঁচে প্রস্তুত” (অশোক সেনের লেখা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অ্যান্ড হিজ় এলিউসিভ মাইলস্টোনস)। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। কেননা, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার জাঁতাকল থেকে আমরা আজও বার হতে পারিনি। শিক্ষাব্যবস্থার অধোগতি প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক বলেছেন, প্রকৃত শিক্ষার জন্য যা প্রয়োজন সেই সময়, পরিকাঠামো বা বেতন— স্কুলশিক্ষকের তা কিছুই জোটে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তো এগুলি জোটে, তা হলে সেখানে এই অবস্থা কেন?
দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-য় মার্ক্স বলেছিলেন, শিক্ষায় বুর্জোয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে হস্তক্ষেপ করে। এবং প্রকৃত শিক্ষা দানের স্বার্থে প্রয়োজন শিক্ষাকে শাসক শ্রেণির প্রভাব মুক্ত করা। প্রথম সোভিয়েট শিক্ষা কমিসার লুনাচারস্কি বলেছিলেন “প্রথমেই প্রয়োজন জ্ঞানার্জনে বিশেষ অধিকার প্রথাটির বিলোপসাধন, যা শিক্ষাকে অল্প কিছু মানুষের কুক্ষিগত করে রাখে।” শ্রমকে শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গীভূত করা ছিল সোভিয়েট শিক্ষাব্যবস্থার এক যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্য। যত ক্ষণ তা না করা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ কল্পিত মুক্ত জ্ঞান আমাদের অনায়ত্ত থেকে যাবে।
শিবাজী ভাদুড়ি
হাওড়া
তলানিতে মান
পরীক্ষা ছাড়া মূল্যায়ন এবং পরীক্ষা হয়ে মূল্যায়ন— এই দুটোর মধ্যে কোনও বিরোধ থাকতে পারে না। পরীক্ষা ছাড়াই মূল্যায়ন সম্ভব হবে, যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঠিক পরিকাঠামো থাকে। আমাদের রাজ্যে পরিকাঠামোহীন মূল্যায়ন প্রথা চালু হয়েছিল আশির দশকের শুরুতে। বামফ্রন্ট সরকার চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দিল। চারটে ক্লাস। অথচ, বহু স্কুলে কোথাও দু’জন, কোথাও এক জন করে শিক্ষক। এক জন শিক্ষক এখন প্রথম শ্রেণিতে, পরক্ষণেই তাঁকে চলে যেতে হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। একটা ক্লাসে অঙ্ক করতে দিয়ে অন্য ক্লাসে ইংরেজি পড়াতে যাচ্ছেন। ফলে তিনি ভাল করে খাতাগুলো দেখতে পারছেন না। একটা ক্লাসে যখন যাচ্ছেন, অন্য ক্লাসে চিৎকার চলছে। তার উপর আছে মিড-ডে মিলের বাজার হিসাব।
পাশ-ফেল নেই বলে বহু ছাত্রছাত্রী ডাংগুলি খেলতে খেলতে ক্লাস ফাইভে উঠে গিয়েছে। তারা অনেকে নামটুকু সই করতে পারে না, সাধারণ যোগ-বিয়োগ করতে পারে না— এমন বহু নজির আছে। ফলে, বিদেশে পরীক্ষা না দিয়ে মূল্যায়ন পদ্ধতি আছে বলে আমাদের দেশে বা রাজ্যেও তা চালু করতে হবে— এ কথা অবৈজ্ঞানিক। দার্জিলিংয়ের চা গাছকে যদি কলকাতার মাটিতে রোপণ করা হয়, সেই গাছ বাঁচবে না। কারণ, চা চাষের উপযুক্ত পরিকাঠামো কলকাতার মাটিতে নেই। এটা জানেন বলেই তৎকালীন শাসক দলের বহু নেতা মন্ত্রী, তাঁদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের সরকারি স্কুলে পাঠাননি। যে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষায় প্রথম সারিতে ছিল, সেখানে আশির দশকের প্রথম থেকে তার মান নামতে নামতে এখন প্রায় তলানিতে ঠেকেছে।
ঋষভ কবিরাজ
কল্যাণী, নদিয়া
মাথা খাটে কম
স্বাতী মৈত্র তাঁর লেখায় প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার ফাঁক-ফোকর তুলে ধরেছেন। বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলব, আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে মুখস্থ বিদ্যা, দ্রুত গতিতে লেখা, টুকে কিছু একটা ‘প্রজেক্ট’ নামে চালিয়ে দেওয়া, এর বাইরে নতুন কোনও চিন্তাভাবনার অবকাশ নেই। যেমন, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে একটি কবিতার যে অর্থ সহায়িকা বইতে রয়েছে, সেটা মুখস্থ করে লিখলে তবেই ভাল নম্বর পাওয়া যায়। উচিত নয় কি প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে নিজের মতো চিন্তা করার অবকাশ দেওয়া? একটা কবিতার যে অনেক রকম উপজীব্য থাকতে পারে এবং মৌলিক চিন্তার ক্ষেত্রে নম্বর বেশি পাওয়া যাবে, তা কি বলা হয়? আমাদের মূল্যায়নে ‘মৌলিকতা’র কোনও স্থান নেই। যে হেতু মৌলিকতা প্রয়োজন নেই, তাই ছাত্রছাত্রীদের মুখস্থবিদ্যা-নির্ভর পড়াশোনায় মাথা খাটাতে হয় না। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।
পড়াশোনার পর চাকরির ক্ষেত্রেও বেশির ভাগেরই মৌলিকতা নেই। ফলে কিছু সময় পর উন্নতির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ছোটবেলায় দাদু-ঠাকুমার মুখে রূপকথার গল্প শোনা থেকে শুরু হত কল্পনাশক্তির বিস্তার। আধুনিক ছোট পরিবারে এই গুরুজনদের অভাব অনেক ক্ষেত্রেই সেই কল্পনাশক্তির প্রসার রোধ করে। ঋত্বিক ঘটক যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ছবিতে বলেছিলেন, “ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।” আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হল, ‘ভাবা’ যে সবচেয়ে জরুরি কাজ, তা ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে না পারা।
সুমন চক্রবর্তী
বেঙ্গালুরু
শিক্ষার পরিবর্তন
‘পরীক্ষা হলেই কি মূল্যায়ন হয়’ (৩১-৮) প্রসঙ্গে কিছু কথা। আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকার পোষিত একটি স্কুলের শিক্ষিকা। প্রায় ১৫ বছরের শিক্ষকতার জীবনে, শিক্ষাব্যবস্থার উপর সরকারের নানা পরীক্ষানিরীক্ষার সাক্ষী হয়েছি। শিক্ষাকে কখনও জনমুখী, কখনও নম্বরমুখী, কখনও পরিকল্পনামুখী হতে দেখেছি, কিন্তু বাস্তবমুখী বা মনোগ্রাহী হতে দেখিনি। সবার জন্য শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে গিয়ে, সরকার সর্বদা চোখ রেখে চলেছে পিছিয়ে পড়া বা শিক্ষায় অনাগ্রহীদের প্রতি। কী ভাবে তাদের শিক্ষার অঙ্গনে বেঁধে রাখা যায়, কী ভাবে তাদের পরীক্ষা বৈতরণি পার করানো যায় ভাবতে ভাবতে শিক্ষাদান বা মূল্যায়নের পদ্ধতিকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। অথচ, যে গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রী শিক্ষার চাহিদা নিয়ে বিদ্যালয়ে হাজির হয়, তাদের জন্য ভাবার অবকাশ কারও নেই। বিদ্যার্জন তাদের কাছে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতায় পরিণত। দরিদ্র পরিবারের জিজ্ঞাসু ছাত্রছাত্রীরা সে ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে শিকার হয় সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার সমান্তরালে চলতে থাকা গৃহশিক্ষকতা চক্রের।
অতিমারির ঝড়ে সব প্রসাধন উড়ে গিয়ে বেআব্রু হয়ে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থার কঙ্কাল। পরীক্ষা ছাড়াই ছাত্রছাত্রীদের নম্বর দেওয়ার চেষ্টা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শিক্ষানীতির নির্ধারকদের চিন্তার দৈন্যদশা। নম্বর আজ সত্যিই ছেলের হাতের মোয়ায় পরিণত। নম্বর আজ আর অর্জন করতে হয় না, দানে পাওয়া যায়। এই পদ্ধতি ভীষণ ভাবে অমানবিক এবং অবৈজ্ঞানিক। দ্রুত চিন্তা করা দরকার মূল্যায়নের বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে। বর্তমানে সরকারি স্কুলে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লিখিত মূল্যায়নের পাশাপাশি ছাত্রের সার্বিক বৃদ্ধি ও গঠনের এক রূপরেখা তৈরির নির্দেশিকা রয়েছে মার্কশিটে। যা এখনও কোনও রকম গুরুত্ব পায়নি। আমার মতে, এটা সরকারি শিক্ষানীতির একটা ইতিবাচক চিন্তার ফসল। ছাত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মূল্যায়নের উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে আজ, তথ্যভান্ডার যখন আঙুলের ডগায় হাজির, তখন মুখস্থ বিদ্যার অনুশীলন অনাবশ্যক। সময়ের দাবি মেনে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনও কাম্য।
দীপান্বিতা সরকার
দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান