Jute Mill

সম্পাদক সমীপেষু: পরিণাম প্লাস্টিক

শ্রমনিবিড় চটশিল্পকে সঙ্কটের মুখে দাঁড় করানোর জন্য দায়ী জুটমিল মালিকদের অপরিণামদর্শিতা এবং রাজ্য ও কেন্দ্র— উভয় সরকারের দীর্ঘ দিনের উদাসীনতা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০২১ ০৫:৪৩
Share:

‘বিকল্পের বিপদ’ (সম্পাদকীয়, ১৯-৮) প্রসঙ্গে এই চিঠি। কেন্দ্রের ‘জুট প্যাকেজিং আইন’ অনুসারে চাল, গমের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ এবং চিনির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ চটের বস্তা ব্যবহারের কথা বলা হলেও, প্রতি বছরেই দেখা যায় খরিফ ও রবি মরসুমে খাদ্যশস্য ওঠার সময় সারা দেশে চটের বস্তার পর্যাপ্ত জোগানের অভাবে কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। প্রতি বছর জুট কমিশনারের দফতর থেকে ফসল ওঠার আগেই চটকলগুলিকে বস্তা সরবরাহ করার জন্য যে অর্ডার দেওয়া হয়, তার এক বৃহৎ অংশ চটকল মালিকরা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হন। তখন বাধ্য হয়ে ফসল সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিক ব্যাগের উপর নির্ভর করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র যদি ক্রমশ আইন শিথিল করে, তার জন্য কেন্দ্রকে দোষ দেওয়া যায় না, বা একে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনা বলা যায় না। বরং বলা যায়, রাজ্যের অন্যতম শ্রমনিবিড় চটশিল্পকে সঙ্কটের মুখে দাঁড় করানোর জন্য দায়ী জুটমিল মালিকদের অপরিণামদর্শিতা এবং রাজ্য ও কেন্দ্র— উভয় সরকারের দীর্ঘ দিনের উদাসীনতা।

Advertisement

যে শিল্পের সঙ্গে একদা ৪০ লক্ষ পাটচাষি ও ৪ লক্ষ শ্রমিকের জীবন জীবিকা জড়িয়ে ছিল, সেই শিল্প আজ কেন এত রুগ্ণ? যে শিল্পের উৎপাদিত সামগ্রীর চাহিদা ও বাজার এত নিশ্চিত, আইনের বলে সুরক্ষিত, সেখানে এত সমস্যা কেন? বর্তমানে এই শিল্পের মালিকরা কাঁচা পাটের অত্যধিক মূল্যকে দায়ী করছেন। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, অতীতে বছরের পর বছর চাষিরা পাটচাষ করে লাভজনক মূল্য না পেয়ে পাটচাষ ছেড়ে অন্যান্য ফসলের উৎপাদনে সরে গিয়েছেন। পাটচাষের এলাকা এবং উৎপাদন উভয়ই প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কমেছে। কেন্দ্র অতীতে পাট নিগমের মাধ্যমে সর্বনিম্ন সহায়ক মূল্য দেওয়ার যে ব্যবস্থা করেছিল, তা আজ অকার্যকর।

শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি আনার লক্ষ্যে চটকল মালিকদের অতীতে কেন্দ্রীয় সরকার বহু অনুদান দিয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে, যার সর্বশেষ ‘জুট টেকনলজি মিশন’। সে সবই শিল্পের স্বাস্থ্য ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে। চটকল মালিকরা শিল্পকে উজ্জ্বল করার কোনও চেষ্টা করেননি। যার ফলে এই শোচনীয় পরিণতি।

Advertisement

দেবকী রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

উত্তরপাড়া, হুগলি

শিল্প, না ফাটকা?

‘বিকল্পের বিপদ’ সম্পাদকীয় আসন্ন উদ্বেগকে চিহ্নিত করেছে। আগামী রবি মরসুমে গম প্যাকেটজাত করতে কেন্দ্র ৪৫ শতাংশ প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারের প্রস্তাব রাজ্য সরকারকে দিয়েছে, যা এই রাজ্যে শ্রমনিবিড় চটশিল্পে আবার মারাত্মক এক সঙ্কট ডেকে আনবে। কয়েক মাস আগে, কাঁচা পাটের অভাবে রাজ্যে প্রায় ১৫টি চটকলে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’ ঘোষণা করেছেন মালিকপক্ষ। একই কারণে অন্যান্য বেশ কিছু চটকলে শিফটের সংখ্যাও কমিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় ট্রেড ইউনিয়নগুলো বার বার অভিযোগ তোলে, কাঁচা পাট নিয়ে ফাটকাবাজি হচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু চটকল মালিক অন্যায় ভাবে কাঁচা পাট মজুত করে সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে তুলছেন। এ নিয়ে, চটশিল্পে সক্রিয় সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন রাজ্য সরকারের কাছে দরবার করলেও তেমন সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়নি। পাট নিগমের তরফ থেকে অনেক হম্বিতম্বি শোনা গেলেও, মজুতদারির প্রশ্নে কোনও পদক্ষেপই তারা করেছে বলে মনে হয় না। আমাদের সংগঠনের তরফ থেকে এ নিয়ে তাদের চিঠি দিলেও উত্তর পাওয়া যায়নি।

কাঁচা পাটের অভাবে নিয়োগকর্তা কারখানায় উৎপাদন বজায় না রাখতে পারলে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে আইনত ‘লে-অফ’ ঘোষণা করতে পারে, ‘ওয়ার্ক সাসপেনশন’ নয়। এই বেআইনি কাজ করা সত্ত্বেও রাজ্য শ্রম দফতর কোনও পদক্ষেপ করল না, অতিমারির সময়ে চলতে থাকা নিদারুণ আর্থিক সঙ্কটে লে-অফ’এর সুবিধা পেলে তবু চটকল শ্রমিকদের আংশিক সুরাহা হত।

রাজ্যের শিল্প মানচিত্রে বামফ্রন্ট আমল থেকেই উৎপাদন শিল্পের অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়েছে। তিন বছর অন্তর অন্তর ট্রেড ইউনিয়নগুলোর পেশ করা দাবিসনদ ঘিরে নিষ্ফলা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু চটশিল্পের বুনিয়াদি সমস্যা সমাধানে না বাম, না তৃণমূল— কেউই কোনও সদর্থক ভূমিকা রাখল না। শুধুমাত্র বস্তা নয়, পাটের তন্তু, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে রাস্তা মেরামতি, বাঁধ নির্মাণে পাটের উপযোগিতা প্রমাণিত। পাটজাত পণ্যের বৈচিত্রকরণ করলে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে, এ বিশ্বাস আমাদের শিল্প নীতিকারদের নেই।

বাস্তবে, বহু দশক ধরে এই ক্ষেত্রটি নিয়োগকর্তাদের কাছে পুঁজি সঞ্চয়ের এক ক্ষেত্র হয়ে রয়েছে। এই শিল্প থেকে অতি অল্প সময়ে দ্রুত মুনাফা অর্জন করে অন্যত্র বিনিয়োগ করাটাই দস্তুর হয়ে থেকেছে। কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রক তার এক রিপোর্টে জানিয়েছে, চটকলগুলোতে বার্ষিক টার্নওভার দশ হাজার কোটি টাকা হলেও, কারখানার আধুনিকীকরণ বা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য নিয়োগকর্তারা তার মাত্র ২.৭ শতাংশ খরচ করেন। শিল্পপতিদের বদলে এই শিল্পক্ষেত্রটিতে আজ ফাটকা মালিক, কাঁচা পাট সরবরাহকারী, সাময়িক ঠিকা নেওয়া লোকজনের দাপট চলছে। এমনকি শ্রম দফতরও জানে না, কোন চটকলের মালিক আসলে কে! আইনকে ফাঁকি দিতে চুপিসারে কখন হাত বদল হয়ে যাচ্ছে।

সর্বোপরি, মানা হয় না ন্যূনতম শ্রম আইন। পর্বতপ্রমাণ পিএফ, গ্র্যাচুইটি বকেয়া রেখে দিব্যি চলছে তাঁদের ব্যবসা, দেশের কোনও আইনই তাঁদের টিকি ছোঁয়ার সাহস পায় না। জাতীয় পাট পর্ষদের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় চটকল শ্রমিকদের নিদারুণ আর্থিক দুরবস্থার তথ্য উঠে এসেছে।

অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে পুনর্গঠন করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও চিন্তার কাঠামোতে আমূল বদল। কাঁচা পাট উৎপাদন, তা বাজারজাত করা, ফড়ে-ফাটকাবাজদের কব্জা থেকে পাটচাষিদের মুক্ত করার জন্য প্রশাসনিক নজরদারি ও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। একমাত্র এই সংগঠিত শিল্পে রয়েছে ৭-৮ ধরনের মজুরি। ২০১৫ সালে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে রাজ্য সরকার চটশিল্পের জন্য মজুরি ও বেতনক্রম পাট নীতি অনুসারে নির্দিষ্ট করার লিখিত প্রতিশ্রুতি দিলেও, তা ঠান্ডা ঘরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।

চা ও চট, এই দু’টি শ্রমনিবিড় সাবেক শিল্পই সমস্যায় জর্জরিত। কালেভদ্রে বিরোধ মিটমাটের চেষ্টা করে, সারা বছর হাত গুটিয়ে থাকলে সমাধান হবে না। প্লাস্টিকের জুজু দেখিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর হীন কৌশল অতীতেও দেখা গিয়েছে। তাতে শিল্পের উন্নয়ন হয়নি। শিল্পের খোলনলচে বদলানোতে নজর কেন্দ্রীভূত করা হোক।

অতনু চক্রবর্তী

সাধারণ সম্পাদক, বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম

নিকাশির সর্বনাশ

‘বিকল্পের বিপদ’ প্রসঙ্গে বলতে চাই, প্লাস্টিক বর্জনের প্রচার চলছে, কিন্তু প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না। বরং, কোনও কোনও ক্ষেত্রে উৎপাদনের জন্য সরকারের অগ্ৰণী ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমুদ্রতীরে প্লাস্টিক কুড়োনোর ছবি দেখেছি। কিন্তু দেশকে প্লাস্টিকমুক্ত করার ক্ষেত্রে সেই অভিযানের গুরুত্ব কোথায়, যখন শস্য প্যাকেটজাত করতে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করার উদ্যোগ করা হয়!

আজকাল একটু ভারী বৃষ্টি হলে শহর এক মানুষ জলের তলায় চলে যায়। নিকাশি ব্যবস্থার এই দুরবস্থার বড় কারণ প্লাস্টিক। সমস্ত নালামুখে জড়ো হয়ে জল বেরোনো বন্ধ করতে এর জুড়ি নেই। পরিবেশ দূষণে প্লাস্টিকের ভূমিকা অপরিসীম। সেই জায়গায় চট পরিবেশবান্ধব। তাই শস্য সংরক্ষণে কোনও ভাবেই যাতে চটের বস্তার বিকল্প প্লাস্টিক ব্যাগ না হয়, সেটা সুনিশ্চিত করা সরকারের আশু কর্তব্য। আমাদের রাজ্যে ভারী শিল্পের অভাব। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যদি আমরা চটশিল্পের সার্বিক উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারি, সেটা ভুল হবে।

গৌতম পতি

তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement