Corona Vaccine

সম্পাদক সমীপেষু: অনাস্থার ফল

২০০৫ সালে ফ্লু-এর প্রতিরোধক ‘ট্যামিফ্লু’ (জেনেরিক নাম, ওসেল্টামিভির) নিয়ে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ বিস্তর লেখালিখি হয়েছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২১ ০৪:৪০
Share:

স্থবির দাশগুপ্তের ‘টিকা থেকেই ঠেকে শিখেছি’ (১৬-৩) প্রসঙ্গে এই চিঠি। লেখাটি ফ্লু টিকার পরিপ্রেক্ষিতে হলেও, নজর চলমান অতিমারি ও তার জন্য টিকাকরণ কার্যক্রমের উপর পড়বেই। একটা প্রচ্ছন্ন সতর্কবার্তাও শুনতে পাওয়া বিচিত্র নয়। কেন টিকা? টিকা প্রত্যাখ্যান করার ঘটনা যত না স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকে, তার চেয়ে ঢের বেশি হয় ধর্মীয় কারণে। প্রচারমাধ্যমে, বিশেষত সমাজমাধ্যমে, ভুল তথ্য এবং মিথ্যা প্রচার কিছু বিশেষ জনগোষ্ঠীর টিকা প্রত্যাখ্যানের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে মারণরোগগুলি নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলার পরও ফিরে আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়। অতি সম্প্রতি মালয়েশিয়াতে ডিপথেরিয়া ফিরে এসেছে, এবং শিশুমৃত্যুও ঘটেছে। তাদের দেশের জাতীয় টিকাকরণ প্রকল্পে প্রতিটি বাচ্চাকে যে সমস্ত টিকা দেওয়ার কথা আছে, তার মধ্যে ডিপথেরিয়া অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও অভিভাবকেরা কল্পিত কাহিনি বা মিথ্যার শিকার হয়ে তা প্রত্যাখ্যান করছিলেন। অথচ, সেই দেশের ফতোয়া কাউন্সিল এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী ডাক্তারদের মতে, টিকাকরণ শরিয়ত অনুমোদিত। মালয়েশিয়ার ঘটনা ব্যতিক্রম নয়, বিভিন্ন দেশেই এই ধরনের অবিজ্ঞানের নজির রয়েছে। আমাদের দেশও তার বাইরে নয়।

Advertisement

টিকা প্রত্যাখ্যানের দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই সংশয়। বাজারে নতুন আসা টিকাকে নিয়ে এই সংশয় স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার কথা ভেবে হতে পারে, আবার রাজনৈতিক কারণে চারিয়ে দেওয়া ব্যাপারও হতে পারে। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার পর্যায়ে ট্রাম্প সমর্থক ‘কিউঅ্যানন’ লবি অনবরত ভ্যাকসিন-বিরোধী প্রচার চালিয়ে গিয়েছে তত দিন পর্যন্ত, যত দিন না ট্রাম্পের অবিমৃশ্যকারিতা তার ভোটব্যাঙ্কে ধস নামানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সেই ট্রাম্প প্রশাসনই করোনা টিকা গবেষণায় অ্যাস্ট্রাজ়েনেকাকে ১২০ কোটি এবং নোভাভ্যাক্সকে ১৬০ কোটি ডলার দিয়েছে কাজটা ত্বরান্বিত করার জন্য।

স্বাভাবিক অবস্থায় মাত্র এক বছরের মধ্যে টিকা আবিষ্কৃত হয়ে বাজারে এসে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আপৎকালীন অবস্থায় ব্যবহারের জন্য যে সব টিকা অনুমোদন পেয়ে বাজারে এসেছে, সেগুলি উড়িয়ে দেওয়ার আগে দু’বার ভাবতে হবে। বস্তুত, যে কোনও টিকাই আজীবন ট্রায়াল পর্যায়ে থাকে, থাকাটাই উচিত। সে ভাবে দেখতে গেলে পোলিয়ো, টিবি, টিটেনাস, মাম্পস, রুবেলা টিকা নেওয়া প্রতিটি শিশু এই বহমান ট্রায়ালের ‘ভলান্টিয়ার’। যদি মানুষ এই টিকাগুলি প্রত্যাখ্যান করেই সন্তানদের মানুষ করবে ঠিক করেন, তা হলে আগামী একশো বছরে শিশুমৃত্যুর ফলে পৃথিবীর জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে। সে দিন করোনার টিকা হয়তো লাগবে না।

Advertisement

স্বপন ভট্টাচার্য, মাইক্রোবায়োলজি, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, মৌলানা আজাদ কলেজ

তুলনা চলে না

স্থবির দাশগুপ্তের নিবন্ধটি কিছু অস্বস্তির সূচনা করেছে। প্রথমত, স্পষ্ট করে না বললেও করোনা অতিমারিকে কার্যত নস্যাৎ করা হয়েছে এ নিবন্ধে। দ্বিতীয়ত, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা কার্যত নাকচ করা হয়েছে। তুলনায় আনা হয়েছে ফ্লু-এর টিকার কথা। যদিও আন্তর্জাতিক চিকিৎসকমহল এই টিকার সুফল নিয়ে নিশ্চিত নয়। ফলে, এ রকম তুলনা দুর্বল। বরং আলোচনায় আসতে পারত স্মল পক্স বা পোলিয়োর টিকার কথা, যেগুলোর দীর্ঘকালীন সফল প্রয়োগে ভয়ঙ্কর রোগ দু’টিকে পৃথিবী থেকে প্রায় সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। যদিও এর জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দীর্ঘ দিন ধরে লাগাতার প্রচারাভিযান চালিয়ে যেতে হয়েছে। অবশেষে রোগ দু’টির বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিরোধ ক্ষমতা (হার্ড ইমিউনিটি) গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। তৃতীয়ত, ‘ট্যামিফ্লু’ নিয়ে একটি কোম্পানি যে রকম নির্লজ্জ বাণিজ্য করেছিল, সেই ঘটনাকে পুনরুত্থাপিত করেছেন লেখক। এ বারের অতিমারির সময় বিশ্ব জুড়ে নিবেদিতপ্রাণ যে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং প্রযুক্তিকর্মীরা বিরতিহীন পরিশ্রম করে ১১ মাসের মধ্যে টিকার সফল প্রয়োগ সম্ভব করলেন, তাঁরা অনালোচিত রয়ে গেলেন।

আরও দু’একটি কথা। চিকিৎসাজগৎ, শিল্পজগৎ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির এক জটিল মেলবন্ধন। সবচেয়ে ভাল উদাহরণ, বহুজাতিক ‘মাইলান’ সংস্থার মদতে পুষ্ট ট্রাম্প হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনকে ‘গেম চেঞ্জার’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ ওষুধটিকে অনুমোদন করে। শেষ অবধি গত বছর জুনে ইংল্যান্ডের ‘রিকভারি ট্রায়াল’ প্রকাশিত হওয়ার পরে ওষুধটি পরিত্যক্ত হয়। ব্রাজিলের স্বাধীনমনস্ক চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে ট্রায়াল রিপোর্ট তৈরি করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। এই সংবাদ ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা নিজেদের নাম গোপন করে ট্রায়াল রিপোর্ট প্রকাশ করেন।

২০০৫ সালে ফ্লু-এর প্রতিরোধক ‘ট্যামিফ্লু’ (জেনেরিক নাম, ওসেল্টামিভির) নিয়ে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ বিস্তর লেখালিখি হয়েছিল। এই ওষুধটি কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। কিন্তু তার সমর্থনে যে তথ্যগুলো দেওয়া হয়েছিল, অভিযোগ উঠেছিল যে, সেগুলো সবই কোম্পানির দেওয়া তথ্য, এবং অধিকাংশ ট্রায়াল বিশ্বাসযোগ্য নয়। অভিযোগ উঠেছে, ওই সব গবেষণার আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে প্রস্তুতকারক কোম্পানি, এবং রিপোর্ট লিখেছিল কোম্পানির কর্মচারী এবং কোম্পানির অর্থে পুষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল সম্পাদকীয় লিখেছিল, “দ্য মিসিং ডেটা দ্যাট কস্ট ২০ বিলিয়ন ডলার” (১০ এপ্রিল, ২০১৪)। অর্থাৎ, উপযুক্ত ট্রায়াল ছাড়াই একটি ওষুধ ২০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে নিয়েছিল।

সম্প্রতি (৩ মার্চ, ২০২১) নেচার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে কয়েকটি গোড়ার প্রশ্ন রাখা হয়েছে—
১) টিকার প্রতিরোধ কত দিন অবধি থাকবে? ২) বয়সের সঙ্গে এর কতটা তারতম্য হয়? ৩) যে সব নতুন স্ট্রেন দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে টিকা কত ভাল ভাবে কাজ করবে?
৪) টিকা হয়ে গিয়েছে, এ রকম মানুষ কি ভাইরাস ছড়াতে পারে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনও অজানা। এটাও মাথায় রাখা দরকার যে, বিভিন্ন টিকার কার্যকারিতার তুলনামূলক আলোচনা করা সম্ভব নয়।

ডা. জয়ন্ত ভট্টাচার্য, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর

সুরক্ষায় অনীহা

সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশ জুড়ে টিকাকরণ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। কিন্তু অনেকের মধ্যেই এখনও পর্যন্ত টিকা নেওয়াতে যথেষ্ট অনীহা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, দেশবাসীকে আরও কিছু দিন করোনা সতর্কতা বজায় রেখে চলতে হবে। যেমন, যথাযথ ভাবে মাস্ক ব্যবহার, নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। কিন্তু রাস্তাঘাট, বাজার, দোকান, ট্রেন— সর্বত্র এক অদ্ভুত চিত্র। মাস্ক ব্যবহার করতে অনিচ্ছা। লোকাল ট্রেনে কিছু দিন আগে পর্যন্তও বেশির ভাগ মানুষই মাস্ক ব্যবহার করছিলেন, খানিকটা নজরদারির ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু এখন প্রায় কেউই আর মাস্ক পরছেন না। মাস্ক ব্যবহার করতে বললে পাল্টা কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন।

বার বার সতর্ক করার পরেও মাস্ক ব্যবহার না করলে যাত্রীকে বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য উড়ান সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে বিমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ। হাওড়ায় করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় এ বার কনট্যাক্ট ট্রেসিং শুরু করেছে হাওড়া জেলা স্বাস্থ্য দফতর। সেই সঙ্গে হাওড়া পুরসভা চালু করেছে বিশেষ কন্ট্রোল রুম। যখন বিশেষজ্ঞরা নতুন করে সংক্রমণের আশঙ্কায় সমস্ত দেশবাসীকে সচেতন থাকতে বলছেন, সেই সময় লোকাল ট্রেনে সচেতনতার অভাবের এই চিত্রটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যদি এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা করেন, তা হলে আমরা আর একটু নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারি।

সুশীলা মালাকার সর্দার, বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement