Education

সম্পাদক সমীপেষু: ছাত্রদরদি শিক্ষক কই

শিক্ষক সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ একদা বলেছিলেন— শিক্ষককে অবশ্যই সর্বাঙ্গীণ ভাবে পবিত্র হতে হবে। এবং তখনই তাঁর মুখের কথায় শক্তি সঞ্চার হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২২ ০৪:৫০
Share:

সমাজে মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকসমাজের দায়িত্ব অপরিসীম।

চিন্ময় গুহ তাঁর ‘শ্বাসরোধী শিক্ষাপরিবেশ’ (৯-৮) শীর্ষক উত্তর সম্পাদকীয়তে শিক্ষাক্ষেত্রের এক জ্বলন্ত সমস্যাকে আমাদের সামনে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, নিজে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি, আজকের শিক্ষকসমাজের মধ্যে ছাত্রদরদি হয়ে শিক্ষাদানের প্রচেষ্টার বড় অভাব। কিন্তু বাস্তবে সুন্দর সমাজ ও সেই সমাজে মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের পরে শিক্ষকসমাজের দায়িত্ব অপরিসীম।

Advertisement

শিক্ষক সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ একদা বলেছিলেন— শিক্ষককে অবশ্যই সর্বাঙ্গীণ ভাবে পবিত্র হতে হবে। এবং তখনই তাঁর মুখের কথায় শক্তি সঞ্চার হবে, যখন তিনি নিজেকে ছাত্রের স্তরে নামিয়ে আনতে পারবেন এবং তাদেরই মন দিয়ে দেখবেন ও বুঝতে পারবেন। এইরূপ শিক্ষকই প্রকৃত শিক্ষাদানে সমর্থ। অন্যরা নয়। কিন্তু সত্যিই বড় আক্ষেপ লাগে বলতে যে, এমন প্রকৃত শিক্ষকের আজ বড় অভাব। এটা ‘নিউ লিবারাল’ শিক্ষাব্যবস্থার এক বড় অভিশাপ, যেখানে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তোলা হয়েছে বাজারমুখী আর ছাত্রছাত্রীরা হয়ে উঠেছে সেই বাজারের পণ্য। সেখানে বাবা-মায়েরাও মেতে উঠেছেন নিজের ছেলেমেয়েদের বাজারমুখী ঝকঝকে পণ্য তৈরি করতে। তাই প্রয়োজন হয়েছে প্রকৃত আত্মজাগরণের, যেখানে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষককুলকে এক দিকে যেমন হয়ে উঠতে হবে ছাত্রদরদি, অন্য দিকে ছাত্রছাত্রীদেরও হয়ে উঠতে হবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কারণ, যেখানে শ্রদ্ধা থাকে না, সেই কাজ কখনও প্রাণ পায় না। এ ভাবেই হয়তো ফিরে পাব আমাদের সৌজন্যপূর্ণ অতীতকে।

সৈকত বিশ্বাস, বোলপুর, বীরভূম

Advertisement

চাবিকাঠি

চিন্ময় গুহের প্রবন্ধের সঙ্গে সহমত। আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য নয়। ফলে, শিক্ষার পরিকাঠামোও খুবই দুর্বল। রাজনীতির চাপে পাঠ্যসূচিও বার বার পরিবর্তিত হয়েছে কখনও উদ্দেশ্যহীন কখনও উদ্দেশ্যপূর্ণ ভাবে। শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত যথাযথ না হলে, অর্থাৎ শিক্ষকের সংখ্যা কম থাকলে শিক্ষকদের ভাল ভাবে পড়ানো সম্ভব নয়— এ কথা ঠিক। তবে ভাল ভাবে পড়াতে চানই বা কত জন শিক্ষক? প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন, আসল চাবিকাঠি শিক্ষকদের হাতে।

আমাদের পাঠ্যসূচি সাধারণ মানের স্কুল পড়ুয়াদের কাছে মোটেই আকর্ষণীয় নয়। ওই বয়সে পড়াশুনার গুরুত্বও তাদের বোঝার কথা নয়। তাদের ভাল লাগলে তবেই তারা মন দিয়ে পড়বে। এটা খুব কঠিন কোনও ভাবনা নয় এবং এই ভাবনাটা শিক্ষকদের, ছাত্রদের নয়। কিন্তু শিক্ষকদের অনেকেই এই ভাবনা থেকে দূরে থাকেন। কোনও কোনও শিক্ষকদের, এমনকি অভিভাবকদেরও আফসোস করে বলতে শুনেছি— “ছোটবেলায় আমাদের শিক্ষকরা পড়া না করলে কঠিন শাস্তি দিতেন। তাই আমরা মানুষ হয়েছি। আমাদের সে ক্ষমতা নেই।” মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, এই ভীতি প্রদর্শনের ফলে তখনকার দিনে স্কুলছুটের হার অনেক বেশি ছিল।

তাই শিক্ষকদেরই শেষ পর্যন্ত দায়িত্বটা নিতে হবে। ক্লাসগুলোকে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করতে হবে এবং সদিচ্ছা থাকলে তা সম্ভব। প্রায়ই দেখা যায়, একই বিষয়ে এক জন শিক্ষকের ক্লাস করতে ছাত্ররা যত উৎসাহী, অন্যদের ক্ষেত্রে ততটা নয়। আমাদের দেশে স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে পরিকাঠামোজনিত বাধা কোনও দিনও হয়তো কাটবে না, কাটানোর চেষ্টাও করা হবে না হয়তো। তাই বলে শিক্ষকদের সেটাকে অজুহাত করা চলবে না। কোনও কোনও শিক্ষক যখন অসম্ভবকে সম্ভব করছেন, তখন অন্যদের বাধা কোথায়? সাধারণ মানের ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যার কথা না ভাবলে শিক্ষার ভবিষ্যৎ যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থেকে যাবে।

দুর্গেশ কুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

অবক্ষয়

‘শ্বাসরোধী শিক্ষাপরিবেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি রাজ্য ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কলঙ্কিত চেহারা তুলে ধরেছে। শিক্ষা সমাজের উন্নয়নের হাতিয়ার। সেই শিক্ষাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে তিনটি কমিশন তৈরি হয়েছে। রাধাকৃষ্ণন কমিশন, ১৯৪৮; মুদালিয়র কমিশন, ১৯৫২; এবং কোঠারি কমিশন, ১৯৬৪। এই কমিশনগুলির প্রত্যেকটির লক্ষ্য ছিল, শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন। সকলের জন্য শিক্ষা, বিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক ভাবধারা এবং সমাজব্যবস্থার প্রতি আস্থা ভাব গড়ে তোলা ইত্যাদি নানা রকম সুপারিশ করা হয়েছে।

কিন্তু এই রাজ্যের এখন যা পরিস্থিতি, তাতে সত্যিই মনে হয়, আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন মন্ত্রীদের শিক্ষার। অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষক নিয়োগ করে নেতা-মন্ত্রীদের কাছে যে ভাবে সম্পত্তি ও টাকার পাহাড় জমা হয়েছে, তাতে শিক্ষার অপমান ছাড়া আর কিছু হয়নি। এই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা এখন চূড়ান্ত অবক্ষয়ের পথে। ভাল বিদ্যালয় নেই, ভালবেসে পড়াতে চান এমন শিক্ষকের সংখ্যা হাতেগোনা। রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছিলেন, কী ভাবে ভালবেসে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে ছাত্রদের শিক্ষাদান করতে হয়। সেই শিক্ষা এখন কোথায়? বরং শিক্ষকদের অনেকে স্কুলে পড়ানোকে অবহেলা করে গৃহশিক্ষকতার প্রতি বেশি মনোযোগী। শিক্ষকদের টিউশনি বন্ধ করার অনেক চেষ্টা বহু দিন ধরে চললেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নজরদারির দায়িত্বে যাঁদের থাকার কথা, তাঁরা নিজেরাও টাকা খেয়ে বসে আছেন। এই পরিস্থিতিতে যে সব ছাত্রছাত্রী প্রকৃত মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের রাজ্য কি কখনও পারবে শিক্ষার এই অবক্ষয় ঠেকাতে?

কুহু দাস, দশগ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর

এক শিক্ষানীতি

এক দেশ এক শিক্ষানীতি চালু করার বিষয়ে কিছু নিজস্ব ভাবনা জানাতে এই পত্রের অবতারণা। এক শিক্ষানীতি চালু করতে গেলে নিশ্চয়ই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। শিক্ষায় বিনিয়োগ দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সহায়ক হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ে না কেন? জিডিপির ৬ শতাংশ মাত্র শিক্ষাখাতে ব্যয় করা হয়। আসলে, দেশের লোকেরা অশিক্ষিত থাকলে রাজনীতিকদের সুবিধা হয়। স্কুলব্যবস্থা ভেঙে পড়া বা ভাল স্কুল না থাকা দেশের পক্ষে বিরাট সঙ্কট ও বিপর্যয়। সরকারি স্কুলগুলিতে কেন ছাত্রছাত্রী কমে যাচ্ছে বা প্রায় শূন্যে এসে ঠেকছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি গভীর চিন্তার বিষয়। নিযুক্ত শিক্ষকরা যদি রাজনীতি ভুলে নিজেদের কাজ সম্বন্ধে গর্ব অনুভব করেন, তা হলেই ছবিটা পাল্টাতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রের প্রতিটি ধাপে দুর্নীতি এত প্রবল ও প্রকট, সেখানে শিক্ষকরা কি সত্যি গর্বিত হতে পারেন নিজেদের কাজ নিয়ে? তাই শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতি মুক্ত করতেই হবে। শুধু নম্বর দেখে ইন্টারভিউতে ডাকলে হবে না। সাধারণ বহু ছাত্রছাত্রী যোগ্যতা থাকলেও নম্বর কম থাকার জন্য ডাক পায় না। তারা যেন বঞ্চিত না হয়, দেখতে হবে।

ভবিষ্যতের অর্থব্যবস্থায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষার গুরুত্ব বাড়াতে ভারতকে উদ্যোগী হতে হবে। একই সঙ্গে আর্থিক অসাম্যের প্রভাব শিক্ষায় পড়তে দেওয়া চলবে না। পরিবারের আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক না কেন, শিক্ষায় সব শিশুর সমান অধিকার স্বীকার করতেই হবে। আবার, ভারতে বিবিধ ধর্ম, ভাষা, পোশাক নিয়ে চলাই আমাদের ঐতিহ্য। এক শিক্ষানীতি চালু করতে গেলে অবশ্যই সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মেনে চলা উচিত। সব শেষে একটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। সর্বভারতীয় পরীক্ষায় দিল্লি বোর্ডের ছেলেমেয়েরা অন্যদের তুলনায় ভাল ফল করে। এই বৈষম্যও অবিলম্বে দূর করতে হবে।

বিনয় কুমার বসু, ভদ্রকালী, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement