ঠিকাকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে অশোক ঘোষের লেখাটি (‘ঠিকাকর্মীদের নিরাপত্তা কোথায়’, ৯-২) বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি। নানা রকম দফতরের নিয়মিত কাজের বোঝা ঠিকাকর্মীরা নিষ্ঠা সহকারে পালন করেন। এই ঠিকাকর্মীদের কাজের উপর ভর করেই কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দফতরের কর্তারা নিয়মিত কাজের চাপ সামাল দিয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি দফতরের নানা বিভাগের কর্মীরা চুক্তিতে নিযুক্ত। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী থেকে শুরু করে অ্যাকাউন্ট্যান্ট পর্যন্ত, সব পদে কনট্র্যাক্টরের পাঠানো লোক দিয়েই কাজ চলে। লেখক ইএসআই হাসপাতালের উল্লেখ খুব প্রাসঙ্গিক ভাবেই করেছেন। দিল্লির একটি ইএসআই হাসপাতালের সমস্ত পুরনো চুক্তিকর্মীকে নতুন ঠিকাদার বাদ দিয়ে দিয়েছে, এটা ঠিকাকর্মীদের কাজের নিরাপত্তার অভাব স্পষ্ট করে। তবে একটা কথা উল্লেখযোগ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের অডিট ডিপার্টমেন্টে শতাধিক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী দীর্ঘ দিন অস্থায়ী ভাবে চাকরি করার পরে নিয়মিত কর্মী রূপে স্বীকৃতি লাভ করতে সফল হয়েছেন।
ঠিকাকর্মীদের কাজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনাচিন্তার সময় এসেছে। যে কনট্র্যাক্টরের সঙ্গে কোনও হাসপাতালের চুক্তি হয়েছে, তিনি যদি মনে করেন যে এক জন দক্ষ সাফাইকর্মীকে পরের দিন থেকে আর হাসপাতালে না পাঠিয়ে বসিয়ে দেবেন, তা হলে হাসপাতাল পরিচালক বা সরকারি আধিকারিকদের কিছুই করার থাকে না। ঠিকাকর্মীদের কাজের নিরাপত্তার বিষয়টি যথাযথ ভাবে তুলে ধরার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৭
চুক্তি শ্রম
‘ঠিকাকর্মীদের নিরাপত্তা কোথায়’ প্রসঙ্গে এই চিঠি। আশির দশকের আগে পর্যন্ত উৎপাদন শিল্পে কেবলমাত্র অতি অস্থায়ী কাজের জন্য ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা হত। বহুনিন্দিত ‘জঙ্গি’ শ্রমিক আন্দোলনের চাপে সরকার ব্রিটিশ আমলে, অথবা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রণীত শ্রম আইনগুলো সংশোধন করে বেশ কিছু শ্রমিক কল্যাণমূলক ধারা যোগ করে। কিন্তু আইন করলে কী হবে, তার সঠিক প্রয়োগের তদারকি করবে কে? কুখ্যাত ‘ইনস্পেকটর রাজ’-এর কল্যাণে আইন ভাঙাই হয়ে যায় নিয়ম, চলতে থাকে শ্রমিক শোষণ। ভারতের অটোহাব গুরুগ্রামে গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায় কাজ করার সময় আঙুল কাটা অসহায় ঠিকা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ না পাওয়া এই শোষণের উদাহরণ। বলা চলে, এ শুধু হিমশৈলের চূড়া মাত্র। এখন ঠিকাশ্রম শুধুমাত্র উৎপাদন শিল্পেই সীমাবদ্ধ নেই। পরিষেবা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পুলিশ-প্রশাসন, সর্বত্র ঠিকা শ্রমের রমরমা। প্যারাটিচার, সিভিক ভলান্টিয়ার ইত্যাদি গালভরা নামের আড়ালে শিক্ষিত ঠিকা শ্রমিকরা স্থায়ী কর্মীদের মতো একই কাজ তাঁদের এক ভগ্নাংশ-মাত্র বেতনে করে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
কন্ট্রাক্ট লেবার (রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবলিশন) আইনটি ১৯৭০ সাল থেকে চালু থাকলেও নতুন শ্রম বিধিতে (লেবার কোড) তার কোনও উল্লেখ নেই! আইনটির নাম দেখলেই বোঝা যায়, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নিরবচ্ছিন্ন কাজের ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমের অবলুপ্তি, এবং সেই ধরনের কাজে নিযুক্ত ঠিকা শ্রমিকদের ধাপে ধাপে মূল কর্মদাতার অধীনে স্থায়ীকরণ। একটা বড় শিল্পোৎপাদন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে এই পত্রলেখক ১৯৮০-৯০ সময়কালে এ রকম স্থায়ীকরণের কয়েকটি ঘটনা দেখেছেন। এখন অন্য আইনের সঙ্গে মিশে গেলেও চুক্তি শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের আইনটি তো ৫০ বছর কার্যকর ছিল। শ্রমিক নিয়োগের ছবিটা কেমন? ঠিকা শ্রমের অবলুপ্তি তো দূরস্থান, এখন উলটপূরাণ। চর্তুদিকে ঠিকা শ্রমের রমরমা। শুধু তা-ই নয়, প্রকৃত কর্মসংস্থানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজকে কর্মরত স্থায়ী শ্রমিক অথবা কর্মী কাল অবসর নিয়ে সেই একই কাজ ঠিকা শ্রমিক হিসাবে করে যাচ্ছেন। সরকারি বা বেসরকারি, সব সংগঠিত ক্ষেত্রে ছবিটা এক। নৈতিকতাকে শিকেয় তুলে রেল-সহ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আহ্বান জানাচ্ছে, তা-ও এমন সব কাজ করার জন্যে যেগুলিকে কোনও মতেই ‘অস্থায়ী’ কাজ বলা যায় না। একটা বড় সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান তো তাদের একটা ছোট কারখানায় একটিও স্থায়ী শ্রমিক না রেখে একশো শতাংশ ঠিকা শ্রমিক দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক নেতাদের ভাবনাতে এটাই হয়তো ‘নিউ নর্মাল’!
বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়, কুলটি, পশ্চিম বর্ধমান
উপযুক্ত মজুরি
সারা বছর ধরে ১০০ বছর পূর্বের দৈনিক সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ এক-একটি খবর নিয়মিত পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সংবাদটি (‘বাণিজ্যে ভারতের স্থান’) একটি উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরেছে। একশো বছর পূর্বে এই দিনে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ভারতের ভূতপূর্ব বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ড-এর বক্তব্যের উপর। বাণিজ্য-বিষয়ে ভারতের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা সম্পর্কিত বক্তব্যে তিনি ভারতের লোকবলের বিষয়টিকেও সমান গুরুত্ব দেন। পত্রিকার সংযোজনে বলা হয়েছিল, “ভারতের মজুরগণ যাহাতে উপযুক্ত পরিমাণ অন্নবস্ত্র পাইয়া মানুষের ন্যায় চলা ফিরা করিতে পারে তৎসম্বন্ধে ভারতীয় আমলাতন্ত্র কতদূর কি করিয়াছে তাহা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয়।” ১০০ বছর পূর্বে আনন্দবাজার পত্রিকা ভারতের মজুরদের সম্পর্কে যে প্রশ্ন তুলেছিল, আজও তা সমান প্রাসঙ্গিক। ভারতের মজুরদের সেই অবস্থার কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? যদি না হয়, তা হলে দায়ী কে?
শ্যামল ঘোষ, কলকাতা-১৩১
দেড়শো দিন কাজ
১০০ দিনের কাজে সেরা পশ্চিমবঙ্গ, সংসদে এমনটাই জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সুখবর। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী ফগ্গন সিংহ কুলস্তে যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তাতে জানা গিয়েছে, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের রাজ্য গুজরাত, এবং আদিত্যনাথ যোগীর রাজ্য উত্তরপ্রদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য। গর্বের কথা এই যে, বাংলা এর আগেও অনেক প্রকল্পে প্রথম হয়েছে। কন্যাশ্রী প্রকল্প ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেছে। ‘দুয়ারে সরকার’ কার্যক্রম ও তার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রকল্পগুলিও দেশে-বিদেশে ইতিমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ইতিমধ্যেই ১০০ দিনের বদলে ১৫০ দিনের কাজের গ্যারান্টির সুপারিশ করেছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার তা মানছে না, তার জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থ রাজ্যগুলিকে বরাদ্দ করছে না। ফলে বহু মানুষ, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কেন্দ্র কর্নাটকের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত এলাকাগুলিতে ১৫০ দিনের কাজের অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু আমপানে বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গের এলাকাগুলির ক্ষেত্রে সেই অনুমতি দেয়নি, যা চরম পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। আশঙ্কা হয়, কেন্দ্র এখানেও রাজনীতির খেলা খেলছে, এবং ইচ্ছে করেই পশ্চিমবঙ্গকে আর্থিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত করছে। এ কি গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির শোচনীয় হারের পরিণাম? এই বিমাতৃসুলভ আচরণ হাস্যকর।
তবে বাংলাকে দাবিয়ে রাখা যাবে না, হারানো যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের রূপায়ণে পশ্চিমবঙ্গকে মডেল করা। এই প্রকল্পের আরও সাফল্য পাওয়ার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বাংলা-সহ সব রাজ্যকে ১৫০ দিনের কাজের অনুমতি দেওয়া উচিত কেন্দ্রের ও সেইমতো অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা দরকার। এতে বেকারত্ব কিছুটা হলেও কমবে।
পঙ্কজ সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি