— ফাইল চিত্র।
অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু তাঁর ‘গণতন্ত্রের ঐতিহ্যকে হারাতে দেবেন না মানুষ’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারে (১৬-৩) দেশের গণতন্ত্র, আর্থিক বৈষম্য ও করব্যবস্থা সংক্রান্ত সব প্রশ্নের জবাব অতি সহজ সরল ভাবে বুঝিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে তাঁর উদ্বেগ ও মতামত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন যে, স্বাধীনতার পরে ভারত বহু কষ্টে যে বৈশিষ্ট্যগুলি অর্জন করেছিল যেমন, বাক্স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি ইদানীং কালে বিপন্ন, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। সংসদ ভবনে অধিবেশন চলাকালীন দুই ব্যক্তির অতর্কিতে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী পক্ষের সাংসদরা দেশের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তার পর তাঁদের সাময়িক ভাবে বহিষ্কার করা হয়। দেশে গত কয়েক বছরে প্রায় দু’শো সাংবাদিকের উপর গুরুতর হামলা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে রামলালার মন্দির প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ডে সরকারি সহায়তার ছবিও দেখা গিয়েছে।
পাশাপাশি কৌশিকবাবু আর্থিক বৈষম্যের কথা বলেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট সম্পদের অধিকাংশই কতিপয় উচ্চবিত্ত মানুষের হস্তগত হয়ে আছে। আর্থিক বৈষম্যই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নষ্ট করে। কয়েক জন পুঁজিপতির মধ্যে গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতিকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গণতন্ত্রকেই অগ্রাহ্য করছে গণতান্ত্রিক দেশ। এই বৈষম্যকে দূর করতে আয়ের পুনর্বণ্টনের জন্য কৌশিকবাবু করব্যবস্থার পরিকাঠামোকে নতুন করে সাজানোর কথা বলেছেন। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও তো বলেছেন যে, উন্নয়নের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কেবল দেশের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি নয়, উন্নয়ন প্রকৃত অর্থে দেশের সকল মানুষের খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার স্বাধীনতা ও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চিতকরণ।
কৌশিকবাবু মনে করিয়েছেন দেশের প্রত্যেকটি মানুষের ভাবা দরকার, কোন কাজটা সম্ভব আর কোনটা অসম্ভব। খেলার দল বা রাজনৈতিক দল, যে কোনও দলের অনৈতিক কাজ সত্ত্বেও তাকে সমর্থন করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা মানুষ। মানুষের কষ্টে তার ধর্ম, জাত বিচার না করে তাকে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। এটাই গণতন্ত্রের ঐতিহ্য, তাকে হারাতে দেওয়া চলে না।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
ন্যায্য বণ্টন
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক প্রবন্ধে যে বক্তব্য উঠে এসেছে, তা দলমত নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকের মনের কথা। এদের কোনও দল নেই, এরা শুধুমাত্র ভাল ও মন্দের দলে। মন্দকে ভাল বোঝাতে, বা ভালকে সর্বতো ভাবে অস্বীকার করতে সাধারণ মানুষ চায় না। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ভাল বা জনস্বার্থে কাজ হবে, এটাই দস্তুর। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকেই জনগণের মত হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দলীয় রাজনীতির কবলে পড়ে শাসক দল ও বিরোধী দলের অবস্থান সব সময় আড়াআড়ি। সমাজনীতি, অর্থনীতি বা রাষ্ট্রনীতির যে বই পড়ে আসেন রাজনীতির কারবারিরা, সেখানে নির্দিষ্ট ধারণা দেওয়া থাকে নীতি নির্ধারণের। তার ব্যবহারিক প্রয়োগ নিজের মেধা অনুযায়ী করেন কর্তাব্যক্তিরা। বাস্তবে যে ছবি ফুটে ওঠে তা হল, কোনও দলের নীতি যতই বিপত্তি ঘটাক, তার বিরুদ্ধাচরণ করা চলবে না। পার্টিলাইনের বাইরে কোনও কথা উচ্চারণ করা যাবে না। তা হলেই ‘দলবিরোধী’ তকমা জুটে যায়। কৌশিক বসু এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। এই অন্ধ সমর্থন বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে না-পারা যে সার্বিক কোনও মঙ্গলসাধন করে না, এ রকম মানসিকতা যে অতি বিপজ্জনক, প্রবন্ধকারের সম্ভবত এটাই উপলব্ধি। স্বৈরতান্ত্রিক ভাবনায় সরকার বা তার নেতা-নেত্রী ক্ষমতার অলিন্দে টিকে থাকতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ছোট ছোট দলে উপভোক্তা নাগরিকদের ভাগ করে শাসনকার্য চালানোর ফন্দি আঁটেন। বশংবদ গোষ্ঠী তখন কৃত্রিম নেতা-নেত্রীর ভজনায় এত মাতে যে, দেশের বৃহৎ স্বার্থে কোনটা জরুরি তা ভাবে না। অন্ধ মাদকতা পেয়ে বসে তাদের। এতে বাড়ে হিংসা, বিশেষ ভাবনার বশবর্তী হয়ে।
ফুটবল দল সমর্থন করা আবেগের ব্যাপার, বিনোদনের বিষয়। এতে দেশের বা দশের কোনও কিছুতে বিশেষ ফারাক হয় না। তবে, পছন্দ তৈরি হয় খেলা দেখতে দেখতে। সেটাই পরে আবেগে পরিণত হয়ে মানুষের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দেশের বৃহৎ অংশের জনস্বার্থ জড়িয়ে যেখানে, সেখানে আবেগের প্রাবল্য দেখানো শুভ নয়, কাজের কথাও না। দেখা যায়, বিশেষ দলের আদর্শ মেনে সুবিধা যেটুকু নেওয়ার তা পুরোদস্তুর নিয়ে অর্থে-সম্পদে বলীয়ান হয়ে যায় দলীয় সমর্থকরা। এ সবই হয় নিঃশব্দে। বাড়ি-গাড়ি, এলাকার প্রতিপত্তি দিয়েই আবার তাঁরা রাজনৈতিক নেতাদের জয় করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। গরিব নাগরিক শুধুমাত্র ভোটাধিকার পেয়ে খুশি, আর ক্ষমতাবানরা আরও ক্ষমতার নেশায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এ ভাবে জন্ম নেয় পারস্পরিক সাঙাততন্ত্র, ক্ষয় শুরু হয় গণতন্ত্রের। তখন গণতন্ত্রের ঐতিহ্য মানুষ ধরে রাখবে কী করে? গণতন্ত্রের ঐতিহ্য সাধারণের দ্বারা নষ্ট হয় না, ক্ষমতাবান ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতির কারবারিরা তার দখল নিয়ে নেন।
তাই, গোষ্ঠীগত বা দলগত পরিচয়ের উপরে উঠে ভাবা অভ্যাস করতে হবে। পাশাপাশি ‘প্রোগ্রেসিভ’ করব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহ করে তা নির্দিষ্ট বণ্টন ব্যবস্থায় গড় আয়ের নীচে থাকা মানুষদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিলে বাজার অর্থনীতি যেমন চাঙ্গা হয়ে উঠবে, তেমনই সমাজনীতিতে সাম্য বজায় রাখাও সম্ভব হবে। তবে, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে অলস উপভোক্তা তৈরি না করে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ হোক, কাজের সুযোগ বাড়ুক। আয় ও উৎপাদন বাড়লে জাতীয় সম্পদ বাড়বে। প্রথম শর্ত, সেখানে গোষ্ঠী ভাবনায় নিজেদের মতামতকে আবদ্ধ না রেখে বৃহদংশের কথা ভেবে যা ভাল তা মানতে হবে, মন্দ যা তা সমবেত ভাবে পরিহার করতে হবে। এ ভাবেই একটা জাতি বা দেশ এগিয়ে যেতে পারে।
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
অদ্বিতীয়
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সাহিত্যের সত্যান্বেষী’ (রবিবাসরীয়, ১০-৩) প্রবন্ধের সূত্রে কিছু কথা। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ঐতিহাসিক রোম্যান্স ও ডিটেকটিভ আখ্যান রচনায় বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করলেও, লিখেছিলেন বেশ কিছু প্রশংসনীয় কৌতুকরসের গল্পও। তির্যকতা নয়, স্নিগ্ধ সরলতা তাঁর গল্পের প্রাণবায়ু। কৌতুকাবহ ঘটনায় নজর কাড়ে তাঁর ‘কর্তার কীর্তি’, ‘মনে মনে’, ‘নাইট ক্লাব’, ‘ঝি’, ‘অসমাপ্ত’ প্রভৃতি গল্প। অল্প আয়োজনেও গভীর আবেদনে ঋদ্ধ এ সব গল্প।
এ ছাড়া, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু উপভোগ্য সামাজিক গল্পেরও রচয়িতা (বুমের্যাং, কালকূট, কাঁচামিঠে, স্বাধীনতার রস, মায়া-কুরঙ্গী)। বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর কালের গুমোট আবহাওয়ার মধ্যেও তিনি প্রেমের গল্প লিখে মুক্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছিলেন। সামাজিক সংস্কার ও ঠুনকো আভিজাত্যের বেড়া ভেঙে তিনি প্রেমের জয় ঘোষণা করেছেন ‘গোদাবরী’, ‘কানু কহে রাই’ গল্পে। তাঁর ভূতের গল্পে ভয়ের চেয়ে অদ্ভুত রসের প্রাধান্যই বেশি। রসবৈচিত্র ও উপস্থাপনার গুণে তাঁর বহু ছোট গল্প বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক চিঠির উত্তরে রাজশেখর বসু লিখেছিলেন, “প্রাচীন ভারতের জীবিতবৎ চিত্র অঙ্কনে আপনি অদ্বিতীয়, রোমাঞ্চ গল্পেও আপনার স্থান সকলের উপর। আর একটি কথা— যার সম্বন্ধে আধুনিক লেখকরা নিরঙ্কুশ— আপনার পরিচ্ছন্ন শুদ্ধ ভাষা।” (২৯-০৩-৫৭ তারিখে লিখিত রাজশেখর বসুর চিঠির অংশবিশেষ, কোরক, সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ২০০০ সংখ্যা)।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি