রানি মুখোপাধ্যায়।
‘কেন ছবি বয়কট’ (সম্পাদক সমীপেষু, ১১-৯) চিঠিটির সূত্রে সিবিএফসি-র উত্তর ভারতের প্রাক্তন অধিকর্তা হিসেবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই। ২০০৯ সালে আদিত্য চোপড়ার দিল বোলে হাড়িপ্পা নামে একটি হিন্দি ছবিতে রানি মুখোপাধ্যায়ের শিখ বেশে পাগড়ি পরার ধরন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। আমরা সিবিএফসি-র তরফ থেকে ছবিটিকে মুক্তির ছাড়পত্র দিলেও একটি প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিবাদের ফলে প্রযোজক ছবিটি রিলিজ করতে পারছিলেন না। সিবিএফসি-র তৎকালীন চেয়ারপার্সন শর্মিলা ঠাকুর এ বিষয়ে আলোচনার জন্য দিল্লিতে তাঁর বাড়িতে আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি বলেন, যশ চোপড়া নিজে পঞ্জাবি। তিনি কি জানবেন না কী ভাবে পাগড়ি পরা উচিত? ওই গোষ্ঠীটির জোর করে নিজের মত চাপানোর অভ্যাস রয়েছে। অর্থাৎ, ছবি রিলিজ় হওয়ার আগে প্রযোজককে চাপ দিয়ে কোনও না কোনও ভাবে অর্থ আদায় করা এদের স্বভাব। শর্মিলা ঠাকুর যশজিকে ফোন করেন, এবং চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে কোনও রকম টাকা-পয়সা দিতে বারণ করেন।
কিছু দিন পর রানি মুখোপাধ্যায়ের বেশভূষায় কোনও রকম পরিবর্তন না করেই ছবিটি মুক্তি পায়। তবে ওই গোষ্ঠীটিকে টাকা দেওয়া হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। অনেক সময় কিছু ছোট গোষ্ঠী ওই একই উদ্দেশ্যে ছবি বয়কটের ডাক দিলেও, এর সঙ্গে ধর্মীয় ভাবাবেগ জড়িয়ে থাকলে ব্যাপারটা তাদের হাতের বাইরে চলে যায়। যেমনটি হয়েছিল পদ্মাবত ছবিটির ক্ষেত্রে। বিষয়টি সংসদ এবং সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
মনোজ গুপ্ত, কলকাতা-১০৭
হৃষীকেশের ছবি
চিরশ্রী মজুমদারের ‘নিখাদ বাঙালির আনন্দ থেকে অভিমান’ (রবিবাসরীয়, ১১-৯) পড়ে জানলাম, পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয়তম ছবি ছিল নারায়ণ সান্যালের উপন্যাস আশ্রিত সত্যকাম। খোদ নারায়ণবাবু হৃষীকেশবাবুর সম্পর্কে তাঁর পঞ্চাশোর্ধ্বে বইতে যা লিখেছেন, তা তুলে ধরলে আরও তথ্য জানা যাবে। পরিচালকের আমন্ত্রণে ছবির মহরত দেখতে সস্ত্রীক মুম্বই যান নারায়ণবাবু। হৃষীকেশবাবুর শখ ছিল সারা দিন চিত্র পরিচালনা করতে করতে দাবা খেলা। ওঁর চেয়ারের পাশেই একটি ছোট্ট তেপায়া টেবিল রাখা থাকত। তার উপর দাবা-বোড়ের গুটি সাজানো থাকত। দু’টি শটের মাঝে যেটুকু সময়, সেটুকু সময়ে হৃষীকেশবাবু দাবার জগতে ডুব দিতেন। খেলায় এত মগ্ন হয়ে থাকতেন যে, খেয়াল থাকত না তিনি ফ্রেমের মধ্যে এসে যাচ্ছেন। তখন কেউ এসে সতর্ক করে দিয়ে যেতেন। উনি তৎক্ষণাৎ উঠে সরে বসতেন। দাবার ছকের সঙ্গে প্রতিপক্ষ দলেরও বদল হত। ওঁর ইউনিট ছিল একটা যৌথ পরিবার। উনি তার কর্তা। সবাই তাঁকে ভালবাসতেন। হৃষীকেশবাবুর দলে ভারতের সব প্রদেশের লোক কাজ করতেন বলে মধ্যাহ্নভোজের মেনুতে সব রকমের খাবারের ব্যবস্থা থাকত। এবং নায়ক-নায়িকা, পরিচালকরা যা খেতেন, ইউনিটের সবাই তা-ই খেতেন। খাবার পদের কোনও রকম অসাম্য ছিল না। ছবির প্রয়োজনে উপন্যাসের কিছু বাদ দিতে হয়, কিছু অপরিবর্তিত থাকে। একটি দৃশ্য তিনি উপন্যাসের সঙ্গে অপরিবর্তিত রেখেছেন, শটটা খুব ভাল উতরেছে, কিন্তু ওই দৃশ্যে চৌকিদারের নাম নিয়ে পরিচালক একটু সংশয়ে ছিলেন। ওঁর মনে হচ্ছে, নাম আছে শিউনন্দন আর স্ক্রিপ্টে নাম রাখা হয়েছে রামনন্দন। তিনি নিশ্চিত না হয়ে ফাইনাল করবেন না। শেষ পর্যন্ত গাড়ি থেকে বই আনিয়ে সংশয় দূর করা হল। পরিচালকই ঠিক। ফের নতুন করে দৃশ্যটি শুট করা হয়। লেখক ‘তুচ্ছ’ কারণে নতুন করে শট নেওয়ার মৃদু প্রতিবাদ করায় পরিচালক তাঁকে বলেছিলেন, অপ্রয়োজনে মূল উপন্যাসের একটি চরিত্রের নাম খামকা বদলাবেন কেন?
অভিজিৎ ঘোষ, কমলপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
বাঙালির ফুটবল
পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও মণিপুরে চলছে ১৩১তম ডুরান্ড কাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা। ১৮৮৮ সালে শিমলায় শুরু হয়েছিল ডুরান্ড কাপ, যা এশিয়ার প্রথম (চলমান) এবং বিশ্বের তৃতীয় প্রবীণতম ফুটবল প্রতিযোগিতা। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল-সহ ১১টি আইএসএল দল, মহামেডান-সহ পাঁচটি আই লিগ দল এবং চারটি ভারতীয় সেনা দল নিয়ে মোট কুড়িটি দল অংশ নিয়েছে এ বারের প্রতিযোগিতায়। লক্ষণীয়, প্রায় আড়াইশো নথিভুক্ত খেলোয়াড়ের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা সাকুল্যে পাঁচ থেকে সাত জন।
১৯১১ সালের স্বদেশি স্বাদ জাগানো ঐতিহাসিক শিল্ড বিজয়ী দলের ১১ জন বাঙালি (যদিও ভূতি সুকুল বাঙালি কি না, সে প্রশ্ন আছে) শিবদাস ভাদুড়ি-র নেতৃত্বে ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারানোর ঘটনায় কোনও তর্ক নেই। তেমনই ইতিহাস বলছে, ১৯৫৬ সালে এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে অলিম্পিক্সের সেমিফাইনালে ওঠা ভারতীয় দলের নেতৃত্বে ছিলেন সমর (বদ্রু) বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিক্সে কোচ বলাইদাস চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কিতে অধিনায়ক শৈলেন মান্না। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিক্সে অধিনায়ক পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬২-তে এশিয়ান গেমসে সোনাজয় চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বে। এক সময়ের ভারতের কিংবদন্তি ও প্রথিতযশা ফুটবলার তৈরির কারখানা বাংলা এখন উত্তর-পূর্বাঞ্চল আর দক্ষিণের রাজ্যগুলোর কাছে হেরে গিয়ে ধুঁকছে।
আশির দশকের প্রথম দিকে ফুটবলে বাংলা ছাড়াও পঞ্জাব, গোয়া কেরলের যথেষ্ট দাপট। ১৯৮২ সালের ভারতীয় ফুটবল দলে বাঙালি খেলোয়াড়দের অবস্থান এই রকম— গোলে ভাস্কর (অধিনায়ক)। ডিফেন্ডার— কম্পটন দত্ত, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, অলোক মুখোপাধ্যায়, সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। ফরোয়ার্ড— বিদেশ বসু, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, কার্তিক শেঠ। ঠিক দশ বছর পর ১৯৯২ সালের ভারতীয় দলে বাঙালি ছিলেন এঁরা— ডিফেন্ডার অচিন্ত্য বেলেল, অলোক দাস, স্বরূপ দাস। মিডফিল্ডার— সুদীপ, সত্যজিৎ, বিকাশ, তুষার। ২০০২ সালের দলে গোলে রজত, সংগ্রাম। ডিফেন্সে দেবজিৎ ঘোষ। ২০১২ সালে গোলে সুব্রত পাল, শুভাশিস রায় চৌধুরী। ডিফেন্সে রহিম, নবি। আরও দশ বছর পর ২০২২-এ ব্যাকে প্রীতম কোটাল আর শুভাশিস বসু।
এ বারের ডুরান্ডে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল মিলিয়ে সাকুল্যে বাঙালি ফুটবলার তিন জন। বাকি সব হয় বিদেশি, না হয় ভিনরাজ্যের। আগে ভিনরাজ্যের খেলোয়াড়েরা ভাবতেন, কলকাতার তিন বড় ক্লাবে না খেললে ফুটবল জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বাংলার দুই বড় ক্লাবের দুই ক্রীড়া প্রশাসক ধীরেন দে এবং জ্যোতিষ গুহ ছিলেন রত্ন বাছাই করার সেরা জহুরি। এখন কর্পোরেট ধাঁচের কোম্পানির সিইও-দের সেই আবেগ কোথায়?
১৯৪৯-৫৩ ইস্টবেঙ্গল ছিল দেশের সেরা ক্লাব। ভেঙ্কটেশ, সালে, আপ্পারাও, আমেদ আর ধনরাজ এই পঞ্চপাণ্ডব ছিলেন দাক্ষিণাত্যের খেলোয়াড়। ১৯৫৬-তে রাম বাহাদুর ও ১৯৬৫ সালে হাবিবকে একই ভাবে জ্যোতিষবাবু স্পট করেন। মোহনবাগান চিমাকে সই করিয়ে বিদেশি খেলোয়াড়দের জন্য দরজা খুলে দেয়। আশি-নব্বই দশক অবধি গরিব-ধনী নির্বিশেষে বাঙালি ফুটবল খেলে বেড়িয়েছে। এখন ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরেই প্রাইভেট টিউশনি নিতে যাচ্ছে। খেলতে যাবে কখন?
আজ বাঙালি ফুটবলাররা প্রতিযোগিতায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না কেন, কেনই বা বিভিন্ন বয়সভিত্তিক জাতীয় শিবিরে বাংলা থেকে ডাক পাওয়া ফুটবলারের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, তা কি বাংলার ফুটবল কর্তারা জানেন না? এই ব্যর্থতার দায় কার? পরিকাঠামো নেই, অ্যাকাডেমি নেই, নেই কোনও পরিকল্পনা। টেকনিক্যাল কমিটির কর্তারা কী করেন? ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের স্পনসররা তাদের অ্যাকাডেমি থেকে এক জনও দেশীয় মানের খেলোয়াড় উপহার দিতে পারছেন না। এখনই শক্ত হাতে হাল না ধরলে, আরও দশ বছর পরের কথা ভেবে আমাদের মতো ক্রীড়াপ্রেমীদের হতাশা বাড়ছে।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৭