কৃষ্ণা রায়ের ‘আজীবনের বিষাদ বেদনাই তাঁর গানের আধার’ (রবিবাসরীয়, ১৭-১০) শীর্ষক প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। লখনউয়ের এক নম্বর ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ বাংলা গানের জগতেও সৃষ্টি করে গিয়েছেন এক সোনালি ইতিহাস। লখনউ সঙ্গীত ঘরানার রংবেরঙের সুর চয়ন করে তিনি বাংলা গানে সূচনা করেছিলেন এক নবদিগন্তের। এই প্রসঙ্গে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছেন— “অতুলপ্রসাদের লখনৌয় বাস বাংলাদেশের সংগীত ইতিহাসে একটি আধুনিক অধ্যায়।” মার্গ-সঙ্গীতের সুরের সঙ্গে দেশজ গানের সুর মিশিয়ে তিনি স্বকীয়ভঙ্গি গড়ে তুলেছিলেন, যা ‘অতুলপ্রসাদী সুর’ নামে পরিচিত। খাঁটি হিন্দুস্থানি সঙ্গীতকে তিনি সাজিয়েছিলেন বাঙালিয়ানায়। টপ্পা-ঠুংরিকে ভেঙে অসাধারণ মুনশিয়ানায় গান বেঁধেছিলেন বাংলায়। ‘আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী’ টপ্পার মুক্তো বসানো অপূর্ব এক সৃষ্টি। আবার তিনি ‘ভবানী দয়ানী মহাবাকবাণী’র সুরে বেঁধেছিলেন ভৈরবীতে ‘সে ডাকে আমারে’র মতো রসসিদ্ধ গান। এই মানুষটিই আবার দেশপ্রেমের উত্তাল তরঙ্গে মাতিয়েছিলেন ‘বলো বলো বলো সবে’র সঙ্গে ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর’ লিখে।
ভারতীয় সাধন সঙ্গীতের পরিচিত অনুষঙ্গের মধ্যেও আত্মনিবেদনের আকুলতায় অতুলপ্রসাদের ভক্তিগীতি আজও অনন্য। তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল ‘কোথা হে ভবের কান্ডারি!/একা আমি জীবনতরী বইতে নারি’র মতো গান। শুধুমাত্র বিষাদ বেদনাই নয়, বিরহ-ব্যথা ঝরে পড়েছে ‘বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে’র মতো গানে। সরল উচ্ছ্বাসী এক কবি-হৃদয়ের আনন্দ, বেদনা, আশা, নিরাশার পসরা নিয়ে এ-ভাবেই মনের হাটে তিনি আজও বিরাজমান।
সাংসারিক সংঘাত মাঝেও বিভিন্ন আড্ডায় হাস্যপরিহাসেও অতুলপ্রসাদ ছিলেন প্রাণপুরুষ। সুকুমার রায়ের ‘মানডে ক্লাব’-এর তিনি সদস্য ছিলেন। আবার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘খামখেয়ালী সভা’র সভ্যও। অতুলপ্রসাদ অত্যন্ত রবীন্দ্রানুরাগীও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। চলত উভয়ের মধ্যে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান। জীবনের উপান্তে পৌঁছে কবি রবীন্দ্রনাথ এক পূজাপর্বে অতুলপ্রসাদকে লিখেছিলেন— “মনে সংকল্প ছিল বিজয়া দশমীতে তোমাকে কবির আশীর্বাদ পাঠাব—... বিশেষ কিছু নয়, আমার স্বরচিত গুটিকতক বই— সম্পাদকের সমালোচনার জন্য নয়, সমজদারের সম্ভোগের জন্যে।” কবি অতুলপ্রসাদ তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে কিছুটা হলেও আজ অশ্রুত, কখনও বা অবহেলিতও। অথচ, তাঁর উদারতা ও মানব হিতৈষণা থেকে কোনও দিন কেউ বঞ্চিত হননি।
সুদেব মাল
খরসরাই, হুগলি
নন্দনকানন
‘বিদ্যাসাগরের নন্দনকানন এখন মহাবিদ্যার স্বর্গরাজ্য’ (রবিবাসরীয়, ২৪-১০) শীর্ষক প্রবন্ধের শিরোনাম সম্পর্কে কিছু কথা। শৈলী বা প্রয়োগরীতি ধরে বিশ্লেষণ করলে বাক্যটিতে ‘মহাবিদ্যা’ এবং ‘স্বর্গরাজ্য’ এই শব্দের উপর জোর পড়েছে বলেই মনে হয়। অতি সাধারণ বিদ্যাসাগর-প্রেমী, বাংলা ভাষাভাষী মানুষ, পত্রিকার একনিষ্ঠ পাঠকদের কাছে, রচনার শিরোনাম পড়ে কেমন একটা খটকা লাগে।
‘বিদ্যাসাগরের নন্দনকানন’ হঠাৎ মহাবিদ্যার স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠল কী করে? মহাবিদ্যা বলতে এখানে চুরিবিদ্যার কথাই বলা হয়েছে। কথায় আছে— ‘চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা’। কিন্তু বিদ্যাসাগরের নন্দনকানন নিয়ে এ রকম রচনা কেন? নন্দনকাননের ভিতরে দু’চারটে জিনিস চুরি হয়নি, সে কথা বলা যাবে না। কিন্তু এখানে ‘মহাবিদ্যা’ হল ‘সাইবার ক্রাইম’। তার কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখক বিস্তারিত জানিয়েছেন। নন্দনকানন থেকে দূরে দূরে থাকা কয়েকটা গ্রাম (১২ কিমি দূরে নারায়ণপুর মূলকেন্দ্র) এ সবের জন্য বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। ঝাড়খণ্ড থেকে দূরে, বহু দূরেও তো ‘মহাবিদ্যা’ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এর জন্য বিদ্যাসাগরের নন্দনকানন শিরোনামে আসবে কেন?
বিদ্যাসাগর তিন একর উনিশ শতক জমি-সহ একটি পুরনো বাড়ি কিনেছিলেন। তাঁর পুত্র নারায়ণ তা কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার মল্লিকদের কাছে বিক্রি করেও দিয়েছিলেন। পরে ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি রক্ষা কমিটি’ ১৯৭৪ সালের ২৯ মার্চ কলকাতার মল্লিকবাড়ির উত্তরাধিকার শ্রী বীরেন্দ্রনাথ মল্লিক ও শ্রী জিতেন্দ্রনাথ মল্লিক মহাশয়ের কাছ থেকে ২৪০০০ টাকার বিনিময়ে উদ্ধার করে। পটনার সদাজাগ্রত বিহারি-বাঙালি সমিতির (তখন ঝাড়খণ্ড রাজ্য হয়নি) উদ্যোগে বিদ্যাসাগরের এই বাড়িটি সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে ঝাড়খণ্ড-বাঙালি সমিতির যৌথ উদ্যোগে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়িটি রক্ষিত। বহু মানুষের আর্থিক সাহায্যে এটি এখন বর্তমান অবস্থায় এসেছে। যাঁরা আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন, তাঁদের অনেকে তাঁর বংশের লোক এবং আরও যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের আত্মিক যোগ।
নন্দনকাননে রয়েছে সেই বাড়ি, তাঁর নিজের হাতে লাগানো দু’-একটা আমগাছ, আর অতীতের অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর মূর্তির পিছনে একটি প্রাচীন বট, যার তলায় বসে তিনি গরিব মানুষের হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। অতিথি, ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আলাদা একটি বিল্ডিং আছে।
সদ্য আমরা তাঁর দুইশত জন্মবর্ষ পার করেছি। তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’ লাইব্রেরি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বই সংগ্রহ করা হচ্ছে। শুধু রেলস্টেশনে মূর্তি বসানো নয়, বর্তমানে করমাটাঁড়ের নাম হয়েছে বিদ্যাসাগর। দ্বিশতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে তাঁর জন্মভূমি বীরসিংহ থেকে মাটি এনেছেন আসানসোলের বিদ্যাসাগর অনুগামীরা। অনেক আগেই নন্দনকানন প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হয়েছে, কাননের দু’দিকে দুটো গেট তৈরি হয়েছে। সন্ধ্যার পর সেখানে তালাও পড়ে। সরকারি সাহায্যে ভিতরের রাস্তাগুলো বাঁধাই হয়েছে, যাতে এলাকাবাসী প্রাতঃভ্রমণ সারতে পারেন। ২৪ ঘণ্টার জন্য সেখানে কেয়ারটেকার আছেন। অনেক বার গিয়ে সেখানে থেকেছি বলেই বলতে পারি, বাইরে থেকে যাঁরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে রাত্রিযাপন করেন অতিথি ভবনে এবং জামশেদপুর ভবনে, তাঁদের খুব অসুবিধা হয় না।
এত অল্প পয়সায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ঝাড়খণ্ডের অন্য কোথাও কমই আছে। বিদেশিরাও নির্দ্বিধায় এখানে থাকতে পারেন। তাঁদের গবেষণায় যথেষ্ট সাহায্য করেন কমিটির মানুষজন। পুলিশ-প্রশাসনের কাছে কী খবর আছে জানি না, তবে ক্রাইম বলতে যা বোঝায়, তা নন্দনকাননের ভিতরে নেই। এর চত্বরে বসে সাইবার ক্রাইমের মতো অপরাধমূলক কোনও কাজ হয় না। কমিটি এ ব্যাপারে সদা সতর্ক।
বিদ্যাসাগরকে যাঁরা ভালবাসেন তাঁরা সবাই এখানে আসুন, পরামর্শ দিন। তাঁর মহত্ত্বকে অনুভব করুন। যেটা অনুভব করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “...যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না... এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।” আসুন, সেই নামকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করি। মূলত তিন রাজ্য জুড়ে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রচেষ্টায় নন্দনকানন সুরক্ষিত আছে, সুরক্ষিত থাকবে।
রমজান আলি
মিঠাপুকুর, বর্ধমান
ঘটক বিদায়
একটা সময় ছিল যখন পাত্রপাত্রী যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ঘটক। ডায়েরির পাতায় পাত্রপাত্রীর ঠিকানা-সহ সমস্ত বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ থাকত। এখনকার মতো সেই সময়ে এ ভাবে খবরের কাগজ জুড়ে এত পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপন ছিল না, ছিল না সমাজমাধ্যমও। এক জন পেশাদার ঘটকই যোগাযোগের কাজটি করতেন। এই পেশায় যিনি, তিনি বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, বাক্পটু ও ধৈর্যশীল। যোগাযোগ করিয়েই না তাঁর আয়। কথার মারপ্যাঁচে ও সত্যি-মিথ্যের মিশেলে দু’পক্ষকে রাজি করিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করতেন ঘটক। ঘটক বিয়ের পাকা কথা পর্যন্ত থাকতেন, যত ক্ষণ না তাঁর পাওনা তিনি পাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে কিছু অশান্তি সৃষ্টি হলে অবশ্য অনেক সময় দোষ পেতে হত ঘটককেই। আবার ঘটক বিদায়ের ব্যাপারেও চলত কথা কাটাকাটি।
এখন বিবাহযোগ্য পাত্র কিংবা পাত্রীর বাড়িতে ঘটকের আনাগোনা সে ভাবে নজরে আসে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পেশাতেও নেই সেই জৌলুস। তবুও এখনও কেউ কেউ আছেন এই পেশাকে আঁকড়েই।
সনৎ ঘোষ
খালোড়, হাওড়া