— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘অর্থনীতির বিষচক্রে’ (২০-২) শীর্ষক প্রবন্ধটি সময়োপযোগী। প্রবন্ধকার শুরুতেই তেভাগা আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন। তেভাগা আন্দোলনের জনক হিসাবে কৃষক নেতা হাজি মোহাম্মদ দানেশ স্মর্তব্য। তৎকালীন দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দানে বামপন্থী নেত্রী ইলা মিত্রের অবদান চিরস্মরণীয়। তেভাগা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ভূমি সংস্কারের প্রভাবে জমিদারি প্রথার অবসান হওয়ার পরবর্তী কালে জমির প্রকৃত চাষিকে আইনানুগ পথে বর্গা এবং রায়তি স্বত্ব প্রদান করা। সেই ব্রিটিশ আমলের মধ্যস্বত্বাধিকারী তথা মহাজনি প্রথার বিলোপসাধন খুব সহজসাধ্য ছিল না। সেই জমি ব্যবহারের একাধিপত্য, বর্গাচাষিদের অধিকারকে অস্বীকার করার আগুন আজও নির্বাপিত হয়নি। সন্দেশখালি তথা সুন্দরবনের জমির চাষাবাদ নোনা মাটি হওয়ায় খুব সহজসাধ্য নয়, বরং নদীর জলস্ফীতির সময় কায়দা করে জমিতে জল ঢুকিয়ে মাছচাষ জমি মাফিয়াদের কাছে অনেক বেশি লাভজনক। আর সরকারের কৃপাদৃষ্টি পেলে তো আর কথাই নেই!
যদিও তেভাগা আন্দোলনের অভিমুখ ছিল সন্দেশখালি এবং নদী-সংলগ্ন এলাকা, কিন্তু তদানীন্তন বামফ্রন্ট শাসনকালে ও জমি মাফিয়াদের দাপটকে প্রতিহত করার তেমন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এর পরে এল ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। সুন্দরবন এলাকার পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের বাছাই করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি এলাকার দখলদারি সেই সব জমি মাফিয়ার উপরেই অর্পণ করল, কেবল পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ‘শুদ্ধিকরণ’ করে নিল। চাষের জমিতে জল ঢুকিয়ে লাভজনক মাছচাষের রমরমা শুরু হল। মানুষ তেভাগা আন্দোলন ভুলে গেলেন, রাজনৈতিক দলগুলির অর্থ উপচে পড়ল। মাছের (বিশেষত চিংড়ির) রফতানিও বাড়তে থাকল।
বেতাজ বাদশাদের প্রতিপত্তি অবদমিত করা প্রায় অসম্ভব ছিল, কারণ ভোটযুদ্ধে তারাই ছিল বোড়ে! এ বার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটতে লাগল। জমির লিজ়ের টাকা না পেয়ে প্রতিবাদ জানালেই অত্যাচার! সুন্দরবন এলাকার শ্রমজীবীদের একটা বিরাট অংশ মহিলা। আজকের সন্দেশখালির যে সর্বাত্মক আন্দোলন, তার অগ্রভাগেও রয়েছেন মহিলারা। জনরোষকে নির্বাপিত করা সহজ নয়। আর্থিক সাহায্য দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে চাপা দেওয়া যায় না। সুন্দরবন এলাকার মানুষ, যাঁরা ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’ নিয়ে বাস করেন, তাঁদের এতটা নির্বোধ ভাবার কোনও কারণ নেই। যা ঘটেছে তা স্বৈরতন্ত্রেরই নামান্তর। বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচারী শাসকদের পতন সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা দেয়।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
পুলিশের রূপ
‘অর্থনীতির বিষচক্রে’ প্রসঙ্গে বলি, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা যখন তলানিতে ঠেকে, তখনই কামদুনি, বগটুই, হাঁসখালি, পার্ক স্ট্রিট অথবা সন্দেশখালির মতো ঘটনা ঘটতে থাকে লাগামহীন ভাবে। তাই সন্দেশখালিতে মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন রাস্তায় দা, বঁটি, ঝাঁটা ও লাঠি হাতে প্রতিবাদে প্রতিরোধে। শাসক দলের দুষ্কৃতীদের অত্যাচারে আজ যে তাঁদের পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে। সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে বলছেন তাঁদের উপর নির্যাতনের কথা। মহিলারা মুখ ঢাকা দিয়ে বলছেন দিনের পর দিন তাঁদের উপর যৌন হেনস্থার কাহিনি। দুই ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল অঞ্চলে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছচাষ এখন খুব লাভজনক ব্যবসা। গরিব কৃষকের চাষের জমিতে বলপূর্বক নোনা জল ঢুকিয়ে দিয়ে সেই জমিকে ভেড়িতে পরিণত করার মতো ঘটনায় তৃণমূল আমলের অবদান কম নয়। চাষির জমি জোর করে লিজ়ে নিয়ে ভেড়িতে রূপান্তরিত করা এবং লিজ়ের টাকা না দেওয়া, সবই বর্তমান রাজনীতির ছত্রছায়ায় ঘটছে। জানা যাচ্ছে, নিশুতি রাতে মেয়েদের ডেকে পাঠানো হত পার্টি অফিসে, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে মেয়েদের তারা পাঠিয়ে দিত আবার উত্তম সর্দার ও শিবু হাজরার কাছে। এটাই ছিল ওখানকার পুলিশ-প্রশাসনের চেহারা। পুলিশ ও অপরাধীদের এ রকম সহাবস্থান হলে সাধারণ মানুষ কার কাছে যাবেন? মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি কিছুই জানতেন না?
অনস্বীকার্য যে, রাজ্যে সমস্ত দুর্নীতির পিছনে প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত ছিল। আজ যখন পুলিশ বা রাজ্য মহিলা কমিশন বলে যে, মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনের কোনও কথা শোনা যায়নি, সেটা শুধু সত্যের অপলাপ নয়, প্রশাসনের উঁচুতলার নেতা-নেত্রীদের মন জুগিয়ে চলার এক ঘৃণ্য প্রয়াস। এই সমস্ত ঘটনার নাটের গুরু বা কিং পিন শেখ শাহজাহানকে কেন গ্রেফতার করা যায়নি ইডি আক্রান্ত হওয়ার ৪৮ দিন পরেও? নাবালিকা বিবাহে আমাদের রাজ্য প্রথম, কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু থাকা সত্ত্বেও। হয়তো এই ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই অভিভাবকরা এই অবস্থান নিচ্ছেন। রাজ্যের এই সামগ্রিক অবক্ষয়ের পরিস্থিতি যদি ৩৫৬ ধারা জারি করার উপযুক্ত না হয়, তবে সংবিধানে এই ধারা রেখে লাভ কী?
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
বিকল্পের আশা
সন্দেশখালির অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টির পিছনে যে কারণগুলি তুলে ধরেছেন অনিতা অগ্নিহোত্রী, সেগুলি অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, বিরোধীরা যখন শাসকের ‘পান থেকে চুন খসা’-র অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকেন, তখন প্রায় এক দশক ধরে চলা সন্দেশখালির জমি লুট, নারী-নির্যাতন তাঁদের নজরের বাইরে থেকে গেল কী করে? তেভাগার শরিক বাম দলের পক্ষে এটা এক চরম ব্যর্থতাও বটে। প্রবন্ধকার শাসক দলের সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনের গাঁটছড়া বাঁধার ভয়াবহ পরিণামের ইঙ্গিত করলেও, যা অনুচ্চারিত থাকল, তা হল রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান তথা মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশ্যে এ সব ঘটনার সাফাই। প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক মদতে এ রাজ্যে দুষ্কৃতী, পুলিশ এবং শাসক দলের একাংশ একে অন্যের পরিপূরকে পরিণত হয়েছে, এ কথা বললে কি খুব ভুল হবে?
সাধারণ মানুষের বোধোদয়, বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সন্দেশখালির মতো জায়গায় জনসংগঠন করা গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে খুবই কঠিন। বিকল্প অর্থনীতিকে অঙ্কুরেই গ্ৰাস করবে বেতাজ বাদশারা। রাষ্ট্রশক্তির ভ্রুকুটি তুচ্ছ করে, সমাজের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে মানুষের চেতনার উন্মেষ ঘটনা সম্ভব হলে তবেই বঞ্চিত এবং নিপীড়িত মানুষ তাঁদের অধিকার বুঝে নিতে সক্ষম হবেন।
ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭
অবুঝ
শাসক দলের ছত্রছায়ায় বিদেশে মাছ রফতানির কল্যাণে ‘ভেড়ি অর্থনীতি’ সন্দেশখালির গ্রাম জীবনকে গ্রাস করেছে। সন্দেশখালির মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘটনাগুলি যখন দিনের আলো দেখল, তখন যারপরনাই অস্বস্তিতে পড়ে গেল রাজ্যের শাসক দল। তারাপদ রায় ‘দারিদ্র্য রেখা’ কবিতায় বলেছিলেন, “কপালের ঘাম মুছে আমাকে বলেছেন,/ এই যে রেখা দেখছো, এর নিচে,/ অনেক নিচে তুমি রয়েছো।/ চমৎকার!/ আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ!” গ্রামাঞ্চলে একশো দিনের টাকা লুট হয়ে যায়, আবাস যোজনার বাড়িঘরেও উলটপুরাণ। অন্য দিকে, পঞ্চায়েত প্রধানের তিনতলা বাড়ি উঠে যায়।
শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এই সব অন্ধকারের অনুভূতিগুলো বুঝেও না বোঝার ভান করেন। কিংবা দু’ছত্র কবিতা লেখেন। সমাজের জন্য কিছুই করে উঠতে পারি না আমরা।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া