হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
‘সপ্তক’ ক্রোড়পত্রে (২২-১) জয় সরকারের লেখা ‘গায়ক হেমন্তে ঢাকা পড়েন সুরকার হেমন্ত’ লেখাটির সূত্রে এই চিঠি। সুরকার হেমন্তর বহুমুখী প্রতিভার কথা যথাযথ উদাহরণ সহযোগে সুলিখিত হলেও, অধরা রয়ে গেল বাংলা ছবির আবহসঙ্গীতে তাঁর অসামান্য কাজ।
‘দেশ’ পত্রিকায় (১৬ অগস্ট ১৯৮৬) ‘কান পেতে রই’ নিবন্ধে প্রকাশ পেয়েছিল হেমন্তর সঙ্গীতভাবনার নানা দিক। এখানেই তিনি বলেছেন, ‘‘বিদেশি ছবিতে আবহসঙ্গীত ছবির মুখ্য ব্যাপার হলেও আমাদের বাংলা ছবিতে এ দিকে তেমন নজর দেওয়া হয়নি।’’ কথাটা নিদারুণ সত্যি। সত্যজিৎ, ঋত্বিক বা তপনের কথা বাদ দিলে, মূলধারার বাংলা ছবিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ বিষয়টি অবহেলিত। কিন্তু এখানেও হেমন্ত উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
‘সপ্তপদী’তে কৃষ্ণেন্দু যখন ধর্মান্তরিত হয়, আর রিনা তাকে ভুল বোঝে, আবহে ভেসে আসে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি— মিশে যায় গির্জার ‘বেল’-এর শব্দে। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির সেই বিখ্যাত ‘সিগনেচার টিউন’-এর কথা ছেড়ে দিলেও, নায়ক তাপসের মানসিক বিকারের বিভিন্ন স্তর বোঝাতে অসাধারণ আবহ সৃষ্টি করেছেন হেমন্ত। একটি যন্ত্রসঙ্গীত-নির্ভর নাচের অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে তার মনে ফিরে আসে আঘাত-অপমানের স্মৃতি। এখানে উচ্চগ্রামে আড়বাঁশির সঙ্গে বাজতে থাকে দ্রুতলয়ের তালবাদ্য। নায়কের চোখের পাগলাটে অভিব্যক্তির সঙ্গে নেশা-ধরানো এই কুহকী আবহ মিশে যায়; মূর্ত হয়ে ওঠে প্রেম, প্রতারণা ও যন্ত্রণার এক মর্মস্পর্শী চিত্রভাষা। আবার হাসপাতালে ভর্তি তাপস যখন আলো-আঁধারি দেওয়ালে কল্পনা করে সেই মেয়েটির ছায়া, যে তার মন নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা খেলে গিয়েছে— আবহে তখন বাজতে থাকে শিরা-ছেঁড়া বেহালার সুর। এর পাশাপাশি ভোলা যায় না ‘হারানো সুর’-এর শীর্ষসঙ্গীত আর আবহও। স্মৃতি-বিস্মৃতির দোলাচল ধরা পড়ে শীর্ষসঙ্গীতে এক যন্ত্র থেকে অন্য যন্ত্রে অনায়াস যাত্রায়: ক্ল্যারিয়নেটের সুর ধরে নেয় পিয়ানো, সেখান থেকে ভাইব্রাফোন, গিটার, বেহালা হয়ে আবার গিটারে শেষ— এক অদ্ভুত ইঙ্গিতময়তায়।
‘শাপমোচন’ ছবির আবহসঙ্গীত তৈরি হয়েছিল চার জনকে নিয়ে। হেমন্ত তখন ব্যস্ততার তুঙ্গে। হাতে সময় এক দিন। গান তৈরিতেই অনেক রাত হয়ে গেল। তাই কলকাতার শব্দযন্ত্রীরা থাকতে চাইলেন না। সবাই চলে গেলে, নবীন সুর আর রিজবার্ট ধরলেন পিয়ানো আর স্যাক্সোফোন, হেমন্ত নিজে বসলেন হারমোনিয়াম নিয়ে, তবলার অভাবে টেবিল বাজালেন তাঁর সহকারী রবি। কিন্তু তাতেই আবহসঙ্গীত কোন মাত্রায় পৌঁছেছিল, ভাবতে অবাক লাগে।
‘জিঘাংসা’ ছবির রহস্যময়, ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে আবহসঙ্গীতের ভূমিকা অপরিসীম। এ ছবিতেও সময় কম পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ভাষায় ‘‘পুরো কাজটা ধ্যানস্থ হয়ে করতে হয়েছিল।’’
গানের ক্ষেত্রে কথা, সুর ও যন্ত্রানুষঙ্গের সামঞ্জস্য রক্ষার ক্ষেত্রে হেমন্ত যেমন কোনও দিন আপস করেননি, বাংলা ছবির সাংস্কৃতিক পটভূমির সঙ্গে মেলে না, এমন যন্ত্রতাণ্ডবকেও আবহের ক্ষেত্রে তেমনই প্রশ্রয় দেননি। লোকসঙ্গীত নির্ভর ছবির আবহে বাঁশি, দোতারা বা গোপীযন্ত্রের অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছেন নামমাত্র। ‘শুকসারি’ বা ‘ফুলেশ্বরী’ ছবিতে ছড়িয়ে আছে তার উদাহরণ। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’য় সুর দেওয়ার আগে পরিচালককে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। লেখককে অনুরোধ করা হল, কোপাই উপত্যকার কাহার-মানুষজন কেমন সুরে গান করেন, তার একটা আভাস দিতে। তপন সিংহের কথায়, ‘‘উনি বললেন, আমি গান জানি না। আমি বার কয়েক বলার পর উনি একটু গুনগুন করলেন। তার মধ্যে থেকেই হেমন্তবাবু সুর করলেন।’’
‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ছবিতে আবহে ব্যবহার করলেন নিজের কণ্ঠ। এটি তাঁর সুরারোপিত প্রথম রবীন্দ্র-কাহিনি আশ্রিত ছবি। সেখানে আবহসঙ্গীতে কণ্ঠপ্রয়োগের প্রত্যয় বোধ হয় তাঁকেই মানায়।
পৃথা কুণ্ডু
কলকাতা-৩৫
নলিনীকান্ত
দীপেশ চক্রবর্তী ‘কী জাদু বাংলা গানে’ (‘সপ্তক’, ২২-১) প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, দিলীপকুমার রায় নিজের গান ছাড়াও পুদুচেরি অরবিন্দ আশ্রমের বাসিন্দা নিশিকান্ত বাবুর গান বাংলায় এনেছিলেন। এই নিশিকান্ত বাবু আসলে হলেন নলিনীকান্ত সরকার। মুর্শিদাবাদ জেলার নিমতিতার কাছে জগতাই গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বাংলার বিপ্লবীদের কলকাতা থেকে বহু দূরে নিমতিতা গ্রামে গা-ঢাকার ব্যবস্থা করতেন। স্থানীয় পুলিশ তাঁকে সন্দেহ করত না। কারণ তিনি সেই অঞ্চলে লেখক, কবি, গায়ক এবং দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের ভাবশিষ্য বলেই পরিচিত ছিলেন। তিনি নিমতিতার জমিদার পরিবারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এই পরিবারের এক বিবাহ অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলাম নলিনীকান্ত সরকারের সঙ্গে বরযাত্রী হিসেবে এসেছিলেন।
১৯২৪ সাল নাগাদ নলিনীকান্ত, দিলীপকুমার রায়কে কলকাতায় প্রথম প্রত্যক্ষ করেন। যদিও তাঁদের আলাপ হয় আরও কিছু দিন পর। ধীরে ধীরে সখ্য বাড়ে। এই ঘটনার কিছু দিন পর দিলীপবাবু ঋষি অরবিন্দের শিষ্যত্ব পেতে ব্যর্থ হলে, নলিনীকান্তের পরামর্শে, নজরুল ইসলামের যোগগুরু বরদাচরণ মজুমদারের শরণাপন্ন হন। নলিনীকান্ত বরদাচরণের স্নেহধন্য ছিলেন। বরদাচরণ দিলীপকুমারকে আশ্বাস দেন, অরবিন্দ যথাসময়ে তাঁকে শিষ্যত্ব দেবেন।
নলিনীকান্ত পরবর্তী কালে আকাশবাণীতে বেতারশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। নিজের অসংখ্য গান ছাড়াও, তাঁর গুরু দাদাঠাকুরের হাস্যরস সৃষ্টিকারী গান পরিবেশন করেন। ধুলিয়ান-কাঞ্চনতলার ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে তাঁর বিখ্যাত ‘কাঞ্চনতলার কাপ’ গানটি রচনা করেন। গানটি গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি রেকর্ড আকারে প্রকাশিত করেছিল এবং তা জনপ্রিয়ও হয়েছিল। কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষযাত্রার যে ধারাবিবরণী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র দিয়েছিলেন, তার জন্য তথ্য সরবরাহ করেছিলেন নলিনীকান্ত, টেলিফোন-যোগে।
সুমিত ঘোষ
কলকাতা-৭৩
মতাদর্শ
ষাটের দশকে সারা পৃথিবী জুড়ে তিনটি মতাদর্শের লড়াই চলছিল। ১) গণতন্ত্র+ধনতন্ত্র, ২) সমাজতন্ত্র+সর্বহারার একনায়কতন্ত্র, ৩) ইসলামতন্ত্র বা প্যান ইসলামিজ়ম। মূল লড়াইটা ছিল প্রথম দু’টি মতাদর্শের মধ্যে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর থেকে সমাজতন্ত্রের পতন শুরু হলে, সেই জায়গাটি পূরণ করতে এগিয়ে আসে প্যান ইসলামিজ়ম। এরই পথ ধরে তালিবান, আল কায়দা, বোকো হারাম, আইএসআইএস ইত্যাদি নানা উগ্রবাদী এবং সন্ত্রাসবাদী মুসলিম সংগঠন সক্রিয় হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এদের লক্ষ্য, গায়ের জোরে ইসলামিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা। এমনকি উদারপন্থী এবং গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মুসলিমদেরকেও এরা ইসলামের শত্রু মনে করে। এই শক্তির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই যেমন আমেরিকার ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান প্রভৃতি জায়গায় সামরিক পদক্ষেপ, তেমনই ভারতেও হিন্দুত্ববাদের উত্থান এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। ভারতে গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে যদি প্যান ইসলামিজ়ম বেশি করে প্রভাব এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বাড়াতে থাকে, তা হলে হিন্দুত্ববাদীরা গণতন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করে একনায়কতন্ত্রের দিকে যাবে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জি অন্তত সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ এখন তাই গভীর সঙ্কটে।
পৃথ্বীশ কুমার সানা
কলকাতা-৮৪
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।