পুরনো পেনশন ব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক রাজ্যে সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন। ফাইল ছবি।
‘একটা গণভোট হয়ে যাক’ (২৬-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে মোহিত রায় শেষ সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছেন যে, সরকারি কর্মচারীদের জন্য ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা দেওয়া খুবই সঙ্কীর্ণ চিন্তার প্রকাশ। সঙ্কীর্ণতা সরকারের চিন্তায় না লেখকের চিন্তায়, সেটাই প্রশ্ন। এই প্রতিবেদক ১৪ বছর আগে রাজ্য সরকারি কর্মচারী হিসাবে অবসর নিয়েছে। এই ১৪ বছরে ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচক বৃদ্ধি ১৫৭ শতাংশেরও অধিক। অথচ, পেনশন স্থির হয়ে আছে ২০১৬ সালের মূল্যমানে। গত ১০ বছরে শুধু খাদ্যদ্রব্যের খুচরো দামই বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। তা সত্ত্বেও যদি দাবি করা হয় যে, বেতন অবক্ষয়ের ক্ষতিপূরণের জন্য মহার্ঘ ভাতা প্রদান ‘সঙ্কীর্ণতা’, তখন সন্দেহ হয়, এই তত্ত্ব আসলে সকল স্তরে বেতন ফ্রিজ় করার জন্য বর্তমান শাসক দলের প্রতি উপদেশ কি না।
শুধু সরকারি কর্মচারীদেরই মহার্ঘ ভাতা বা ডিএ দেওয়া হবে কেন, এই প্রশ্ন তুলেছেন প্রবন্ধকার। দেশের নিয়ম অনুসারে সরকারি কর্মচারী নন, কৃষিশ্রমিক থেকে শুরু করে অসংগঠিত ও সংগঠিত ক্ষেত্রের সব শ্রমিকেরই মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার কথা। ৩ এপ্রিল ২০২৩ ভারত সরকার যে অর্ডার বার করেছেন, তা দ্রষ্টব্য। বেসরকারি ক্ষেত্রের লোভনীয় হাতছানি থাকতে সরকারি চাকরিকে ‘সোনার খনি’ বলে লেখক যে মন্তব্য করেছেন, সেটা বোধ হয় বেতনক্রমের নিরিখে নয়। চাকরির নিরাপত্তাই ছিল সরকারি চাকরির একমাত্র আকর্ষণ। সেটাও তো বিভিন্ন উপায়ে খর্ব করার প্রচেষ্টা চলছে। পুরনো পেনশন ব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক রাজ্যে সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন।
বেতন কমিশন নিম্নস্তরের সরকারি কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণ করে ‘প্রয়োজনভিত্তিক ন্যূনতম বেতন’-এর নিরিখে। অর্থাৎ, চার জনের পরিবারের ভাত-কাপড় জোগান দেওয়ার জন্য এক জন উপার্জনকারীর ন্যূনতম বেতন। সেটা যদি ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের মূল্যমানের নিরিখে মাসিক ১৮,০০০ টাকা হয়, তা হলে তো কর্মচারীদের কিছু করার নেই। অন্য দিকে, ২০১৯ সালে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিয়োজিত অনুপ শতপথী কমিটি সর্বভারতীয় স্তরে দৈনিক মজুরি সর্বনিম্ন ৩৭৫ টাকা সুপারিশ করেছিল। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকার আজ পর্যন্ত সেই সুপারিশ না মেনে, দৈনিক মজুরি ২০১৯ সালে মাত্র ২ টাকা বাড়িয়ে ১৭৮ টাকায় বেঁধে রেখেছে। ২০১২ সাল থেকে ২০২১-এর মধ্যে দেশে সৃষ্ট সম্পদের ৪০ শতাংশ কেন মাত্র ১ শতাংশ মানুষের ঘরে জমা হল, এবং দেশের সর্বনিম্ন ৫০ শতাংশ মানুষ কেন খুদকুঁড়ো ৩ শতাংশের ভাগীদার হল (অক্সফ্যাম রিপোর্ট), সে কৈফিয়তও কি কর্মচারীরা দেবেন? যে অর্থনীতির মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হচ্ছে, তা-ই আয়ের ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করছে। সেই অর্থনীতির পরিচালকরাই দেশের মানুষকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে, সরকারি অনুদানের মাধ্যমে অনুগৃহীত করে রাখার রাজনীতি করছেন। পাশাপাশি, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামলব্ধ অধিকার হরণের জন্য কুযুক্তির বিস্তার করছেন। এটাই শাসক শ্রেণির রাজনীতি। লেখক সেই রাজনীতির পক্ষেই কলম ধরেছেন।
প্রণব দে, কলকাতা-৫৪
গৃহহীনের বঞ্চনা
নিজের কর্মজীবনের বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থেকে ‘হট্টমন্দির’ (১-৫) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি প্রসঙ্গে দরিদ্রদের জন্য সরকারি অর্থ সহায়তায় আবাস তৈরির প্রকল্প সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। প্রকল্পটি বহু পুরনো, প্রথম দিকে উপভোক্তাদেরই শ্রমদান করতে হত, বাড়ি তৈরির উপকরণ কেনার টাকা আসত সরকারের তহবিল থেকে। ১৯৭৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টের জয়ের পরে অন্যান্য গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পের মতো, এই প্রকল্পটির রূপায়ণও ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমেই হচ্ছিল। পঞ্চায়েতের কারিগরি সহায়তায় বাড়িগুলি তৈরি হত, আর্থিক সহায়তা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যেই ভাগাভাগি হত।
কিন্তু তখনকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় কর্মচারীদের অপ্রতুলতার সুযোগ নিয়ে ঠিকাদারদের অনুপ্রবেশ ঘটল। ক্রমে উপভোক্তাদের তালিকা প্রস্তুতির ব্যাপারে দুষ্টচক্র তৈরি হল। গৃহহীন মানুষরা যেমন ঘর পেয়েছেন, তেমনই পাকা বাড়ির মালিকও অসদুপায়ে আবাস যোজনায় বাড়ির মালিক হয়ে, সে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে। এখন কেন্দ্র ও রাজ্যের সংঘাতে প্রকল্পটির কাজ স্থগিত। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রেরিত দল যে সব ভুল-ত্রুটি পেয়েছে, সেগুলি সংশোধনের অবকাশ আছে। কেন্দ্রের অর্থের জোগান না থাকলে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়বে। গৃহহীনদের দুঃখ বাড়বে বই কমবে না। এক জন প্রকৃত উপভোক্তাও যেন বঞ্চিত না হন।
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি
পণের দাপট
যৌতুক বা পণপ্রথার এক কালে কিছু প্রয়োজন ছিল, এ কথা ঠিক। পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার না-থাকা এর একটা প্রধান কারণ। প্রহেলী ধর চৌধুরী তাঁর লেখায় ঠিকই বলেছেন, মেয়েরা কাজের বাজারে যোগ দেওয়ায় এবং উত্তরাধিকার আইন, ও সংশোধিত উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী হওয়ায় যৌতুক বা পণপ্রথা বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা (না না, পণ নয়, উপহারমাত্র, ২৬-৪)। তা যখন হয়নি, তখন বুঝতে হবে যে, তা যুক্তি-ভিত্তির সীমানা ছাড়িয়ে সুযোগসন্ধানী হয়ে উঠেছে। বিবাহিত মেয়েদের বাবা-মায়েরাই আইনকে ফাঁকি দিচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে, এবং ছেলেদের পরিবারে থাকতে হয় বলে বেশির ভাগ বাবা-মায়েরা তাঁদের বিবাহিত মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের আর্থিক সুরক্ষার কথা বেশি ভাবেন। তাই মৃত্যুর আগেই তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছেলেদের নামে লিখে দিয়ে যান। আবার মৃত্যুর আগে যদি লিখে দিয়ে না যেতে পারেন, তবুও নানা কৌশলে মেয়েদের বঞ্চিত করা হয়। ভাই-দাদাদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্টের ভয় যেমন দেখানো হয়, তেমনই মেয়েদের সম্পত্তির প্রাপ্য অংশের দাবিকে তাঁদের হীন মনের পরিচয় হিসাবে তুলে ধরাও অপর কারণ। এমনকি, মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট খারাপ হলেও আশা করা হয় যে, মেয়েটি স্বেচ্ছায় বাপের বাড়ির সম্পত্তি ছেড়ে দেবে। সুতরাং, আইন সত্ত্বেও বিবাহিত মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তি পাওয়ার অনিশ্চয়তা পণপ্রথা বিলীন না হওয়ার একটা বড় কারণ তো বটেই।
আবার বহু সচ্ছল পাত্রপক্ষের আচরণও অদ্ভুত। যাঁদের সঙ্গে এক মধুর, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হবে, যাঁদের মেয়ে তাদের বাড়ির বৌ হবে, তাঁদের কাছ থেকে কৌশলে বা নির্লজ্জ ভাবে যৌতুক আদায় করে পাত্রপক্ষ। এ ছাড়াও বিয়েতে কোন দরের পাত্রের ন্যূনতম কতটা ‘উপহার’ পাওয়া উচিত, তার একটা অলিখিত হিসাব চালু আছে। সেটা না মানলে পাত্রপক্ষ তার আত্মীয়, পাড়াপড়শির পরিসরে নাকি ‘সস্তা’ বলে বিবেচিত হয়ে যায়। যদিও কী ভাবে সম্মানহানি হয়, তার যুক্তি পাওয়া দায়।
অবশ্য মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তির অংশ পাওয়ার অনিশ্চয়তা না থাকলেও, এমনকি মেয়ে রোজগেরে হলেও যৌতুক আদায়ের ঘটনা ঘটে। এ সব থেকে মনে হয়, পণপ্রথার পিছনে পাত্রপক্ষের শুধু লোভ নয়, শুধু মান-সম্মানের প্রশ্ন নয়, দীর্ঘ কালের একটা অভ্যাসও কাজ করে। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব অভ্যাসটা জিইয়ে রাখছে।
উত্তরাধিকার আইন সম্পত্তির সমবণ্টনের কথা বলে, বণ্টনের সাম্যের কথা বলে না। কেননা আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেটা মানা সম্ভব নয়। সেটা মানবিকতার ব্যাপার। অর্থাৎ, ভাইবোনেদের আর্থিক পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্পত্তি বণ্টন হওয়া উচিত। এমনকি, প্রয়োজনে আর্থিক ভাবে দুর্বলতম ভাই বা বোনটির সমস্ত সম্পত্তি পাওয়া উচিত। নিজেদের রক্তের সম্পর্কের মধ্যে, একই মায়ের পেটের ভাই-বোনদের মধ্যে এই সাম্যটুকু আমরা বজায় রাখতে পারি না। অথচ, দেশময় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াই করি! কী বিচিত্র ভাবনা।
দুর্গেশকুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা