—প্রতীকী ছবি।
‘শব্দযন্ত্রণাই কি ভবিতব্য’ (৩-১১) প্রবন্ধে জয়ন্ত বসু এ রাজ্যের শব্দদূষণ বিধি শিথিল করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সারা দেশে শব্দবাজির সর্বোচ্চ সীমা ১২৫ ডেসিবেল থাকলেও আমাদের রাজ্যে তা দীর্ঘ দিন ধরে ৯০ ডেসিবেল ছিল। তাতেও শব্দের দূষণ রোধ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। কোথাও কোথাও ভয়ঙ্কর শব্দের দাপটের প্রতিবাদ করায় একাধিক ব্যক্তির প্রাণ পর্যন্ত গিয়েছে। এই অবস্থায় হঠাৎ করে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ শব্দসীমা দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে গিয়ে ১২৫ ডেসিবেল পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও এ রাজ্যের পৃথক শব্দনিয়ন্ত্রণ বিধিকে সম্পূর্ণ আইনসম্মত বলে কেন্দ্রীয় পরিবেশ দফতর জানিয়েছিল। তা সত্ত্বেও এই বাড়তি ছাড় দেওয়ার কারণ কী?
আসলে আমরা সকলেই জনকল্যাণের চেয়ে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলীয় লাভের দিকটায় গুরুত্ব দিই বেশি। সেই জন্য আইনের বিভিন্ন ফাঁকফোকর খুঁজে বার করে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বাজি ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসায়িক স্বার্থে, ব্যবহারকারীরা আমোদ-আহ্লাদ পূর্ণমাত্রায় বজায় রাখতে শব্দবাজি ব্যবহারের অবাধ ছাড়পত্রের পক্ষে সওয়াল করেন। চোরাগোপ্তা শব্দবাজি ক্রয়-বিক্রয়ের রমরমা কারবার চালিয়ে যান। সরকার তাঁদের ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখার স্বার্থে এই সব অনিয়ম দেখেও দেখতে পায় না।
শব্দবাজির সীমা ১২৫ ডেসিবেল করে দেওয়া থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, মুখে যা-ই বলা হোক না কেন, অনেকের ভাবনায় দীর্ঘমেয়াদি লাভের চেয়ে তাৎক্ষণিক লাভ বেশি গুরুত্ব পায়। সরকারের চিন্তায়-চেতনায় পরিবেশ সচেতনতা অপেক্ষা ক্ষমতায় টিকে থাকাই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, আদালতের রায় অমান্য করে ছটপুজোয় রবীন্দ্র সরোবর নোংরা হলেও পুলিশ চুপ করে থাকে। ঠিক একই ভাবে শব্দবাজির শব্দসীমা বেড়ে যায়। পরীক্ষা না করেই সবুজ বাজির নামে সাধারণ বাজি বিক্রির ছাড়পত্র পেয়ে যায়। অথচ, একটু চেষ্টা করলে স্বাভাবিক জনজীবন অক্ষুণ্ণ রেখেও শব্দদূষণ অনেকটা রুখে দেওয়া সম্ভব।
প্রদ্যোৎ পালুই, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
হৃদয়হীন
জয়ন্ত বসুর প্রবন্ধটি প্রাসঙ্গিক। শব্দবাজি না বলে শব্দদানব বলাই যুক্তিযুক্ত। আনন্দ করার অধিকার সকলের আছে, তবে তা অন্যের অসুবিধা করে নয়। এই কথাটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। শব্দবাজির মাত্রা যতই বেঁধে দেওয়া হোক, বাস্তবে এই নিয়ম সকলে মেনে চলেন কি? অনিয়মই যেন এখন নিয়ম হয়ে গিয়েছে। আর আমাদের রাজ্যে নিয়ম না মানায় উৎসাহীদের সংখ্যা বেশি। আইন তৈরি হয় জনগণের কল্যাণের কথা ভেবে। তাই আইনকে সম্মান করা প্রত্যেকের কর্তব্য। তা ছাড়া বিবেক বলেও তো একটা জিনিস রয়েছে। কিন্তু সে সব অবজ্ঞা করেই উৎসাহীদের দাপটে দীপাবলির ক’টা দিন শিশু থেকে বয়স্ক, সকলেই ভয়ে থাকে। এখানেই আসে প্রকৃত শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসঙ্গ। সমাজে আমার দ্বারা যেন কারও ক্ষতি না হয়— এই চেতনা সকলের মধ্যে জাগাতে হবে। মানবিক ও সহৃদয় হওয়ার শিক্ষা প্রথম থেকে না পেলে শব্দবাজির দৈত্যের হাত থেকে কেউ নিস্তার পাবে না। আরও অনেক বিয়োগান্তক ঘটনার সাক্ষী আমাদের থাকতে হবে।
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
দূষণের পক্ষে
জয়ন্ত বসু খোলাখুলি লিখেছেন, কাদের স্বার্থে শব্দবাজির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হল। চলতি বছরের মে মাস থেকে রাজ্য সরকার বাজি সংক্রান্ত বিষয়ে একটার পর একটা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বেআইনি বাজি ব্যবসায়ীদের মদত জুগিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ দফতর দেশের মধ্যে সর্বাধিক পুরনো। বামফ্রন্ট সরকারের একটি রাজনৈতিক অংশ খোলাখুলি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার মালিক ও দূষণকারীদের মদত দিয়েছিল। জলা বুজিয়ে বহুতল বানানোর বিষয়ে পর্ষদের নিজের রিপোর্টকে ‘অবৈধ’ বলা এবং অবৈধ বাড়ি ভেঙে ফেলার নির্দেশকে অমান্য করে তদানীন্তন সরকার পরিবেশের বিরুদ্ধে অনেক কাজ করেছেন। আমরা প্রতিবাদ করেছি, বার বার সরকারের কাছে গিয়েছি। কখনও বিচার পেয়েছি, কখনও পাইনি।
কিন্তু সরকারি তরফে পরিবেশের স্বার্থবিরোধিতার এমন দৃষ্টান্ত আগে কোনও দিন দেখিনি। বর্তমান সরকার গত ৪০ বছরে এমন একটা উদাহরণ দেখাক, যেখানে পরিবেশ দফতর এমন খোলাখুলি ভাবে বাজি ব্যবসায়ীদের পক্ষে সর্বত্র সওয়াল করেছে। পরিবেশ দফতর পরিবেশ সুরক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আদালতের নির্দেশ চাইছে, এমন উদাহরণ আগে আছে? নেই। বাজি ব্যবসায়ীরা বহু বার আদালতে গিয়েছেন শব্দের ঊর্ধ্বসীমার পক্ষে সওয়াল করতে, কিন্তু পরিবেশ দফতর সর্বদা শব্দবাজির সীমা ৯০ রাখার পক্ষে সওয়াল করেছে। ১৯৯৬ থেকে বার বার কমিটি তৈরি করেছে, তার রিপোর্ট নিয়ে আদালতে গিয়েছে। এ সব তো করেছে রাজ্য পরিবেশ দফতরই, পরিবেশকর্মীরা নন। তবে আজ উল্টো পথে হাঁটা কেন?
প্রশ্নটা শব্দবাজির ঊর্ধ্বসীমা বেড়ে যাওয়া শুধু নয়। পরিবেশের স্বার্থ তথা জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার যে পরম্পরা দেখা গিয়েছে এ রাজ্যে, তার জন্য দফতরের যে সম্মান সর্বত্র তৈরি হয়েছিল, তা বর্তমান মন্ত্রী-আধিকারিকরা ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন। বাম আমলে এমনও দেখা গিয়েছে যে, অনেক ক্ষেত্রে সরকার পরিবেশের বিরুদ্ধে থাকলেও, পরিবেশ দফতর নিজস্ব অবস্থান নিয়েছে। আজ দেখা যাচ্ছে, পরিবেশের সামগ্রিক সুরক্ষার প্রশ্নে একটা রেগুলেটরি সংস্থা তার নিজস্ব স্বাধীন অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে পরিবেশ দূষণের পক্ষে সওয়াল করছে। এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
নব দত্ত, সাধারণ সম্পাদক, সবুজ মঞ্চ
গণতন্ত্রের শব্দ
বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে লাউডস্পিকার আর আতশবাজি, এই দু’টি হল শব্দদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস, যা সদিচ্ছা থাকলে মানবকল্যাণের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আতশবাজি পোড়ালে শব্দদূষণের সঙ্গে জড়িত রাসায়নিক দূষণও মানবদেহের ক্ষতি করে। এগুলি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার জন্য সাধারণ মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, দু’ভাবেই মাসুল দিতে হচ্ছে। জয়ন্ত বসুর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, এ ব্যাপারে ১৯৭০-এর দশক থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানের গবেষক, পরিবেশ আন্দোলনকারী সংস্থাগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রচার করছে, আইনি লড়াই করছে, যা রাজ্য সরকারের কর্তব্য। এই দূষণ উৎসমুখে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা। সেখানে দুর্বলতার জন্য আইনি লড়াইয়ে হ্যাপা বাড়ছে, শ্রম, অর্থ ও সময়ের অপচয় হচ্ছে, পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। এর সুযোগ নিচ্ছে বেআইনি আতশবাজি ব্যবসায়ী। এই গোষ্ঠী এতটাই শক্তিশালী যে, প্রায় নিঃশব্দে শব্দদূষণের বৈধ মাত্রা ৩৫ ডেসিবেল বেড়ে যায়।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, কেন্দ্রীয় পরিবেশ সংস্থা ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল এঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট’, রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন, জাতীয় পরিবেশ আদালত, হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট সবাই ব্যতিব্যস্ত। আতশবাজি উৎপাদকদের সংগঠনগুলি সবুজ বাজি বিক্রির বিধি, অনুমোদনের যুক্তি ইত্যাদি নানা তাত্ত্বিক কারণ দেখাচ্ছে। প্রতিবেশী রাজ্যের ব্যবসায়ীদের উপর দোষ চাপানো যায় না। এই ভয়াবহ দূষণে সবচেয়ে অসহায় প্রবীণ ও শিশুরা। সম্প্রতি বোমা বিস্ফোরণে বিভিন্ন জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে। নিরীহ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। বোমাই হোক বা বাজি, তার শব্দে এ রাজ্যে প্রকৃত গণতন্ত্রের আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে। উন্নত সমাজে শব্দযন্ত্রণা ‘ভবিতব্য’ হতে পারে না। বড় থেকে ছোট, সব বোমার উৎস ধরতে হবে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি