ঈশা দাশগুপ্তের প্রবন্ধে (‘প্রথমারও আগে যাঁর লড়াই’, ৬-৮) কিছু তথ্যবিভ্রান্তি ঘটেছে। চন্দ্রমুখী আইএ পরীক্ষা দেননি। অতএব আইএ পরীক্ষায় বসার অনুমতি চেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চিঠি দেওয়ার প্রশ্নও ওঠেনি। ১৮৭৬ সালের ২৫ নভেম্বর চন্দ্রমুখী এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে চেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন করেন। তখন তাঁকে রেজিস্টার্ড পরীক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করা যায়নি। কারণ কোনও মেয়েকে পরীক্ষা দিতে অনুমতি দেওয়ার বিধান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছিল না। ১৮৭৬ সালের ডিসেম্বরে চন্দ্রমুখী এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসেন এবং ১৮৭৭ সালের জানুয়ারিতে ফল বেরোয়। কিন্তু ‘পার্সন’ বলতে যে মেয়েদেরও বোঝায়, তা কর্তাব্যক্তিরা মান্য না করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেজ়েটে চন্দ্রমুখীর নাম প্রকাশিত হয় না। পরের বছর কাদম্বিনী বসুকে পরীক্ষায় বসার অনুমতি দিতে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মে বদল আনে।
১৮৮৩ সালের ১০ মার্চ চন্দ্রমুখী এবং কাদম্বিনী দু’জনেই একসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বিএ ডিগ্রি পান। আমি নানা কাগজপত্র থেকে প্রমাণ করি যে, ১৮৭৬-৭৭ সালের নিয়ম অনুসারেই চন্দ্রমুখী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এন্ট্রান্স উত্তীর্ণা মহিলার সম্মান পাওয়ার অধিকারী। ২৯ নভেম্বর, ২০১৩ সালে তৎকালীন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে চন্দ্রমুখীর এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফল ও শংসাপত্র বেথুন কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে সমর্পণ করেন।
সুনন্দা ঘোষ
প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বেথুন কলেজ
দুই রত্ন
ঈশা দাশগুপ্তের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য স্মরণ করতে চাই। ১৮৭৬ সালের শেষ দিকে ‘দেহরা বোর্ডিং স্কুল ফর নেটিভ ক্রিশ্চান গার্লস’-এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট রেভারেন্ড ডেভিড হেরন চন্দ্রমুখী বসুকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদনপত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মিটিং-এ আলোচিত হয়। এই সময়ে উপাচার্য ছিলেন নারী হিতৈষী স্যর আর্থার হবহাউস, এবং জে স্যাটেলাইট ছিলেন রেজিস্ট্রার। দু’জনেই মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিলেন। চন্দ্রমুখী বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ত মেনেই পরীক্ষায় বসলেন। ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি মিনিটস অব দ্য সিন্ডিকেট রেজ়লিউশন (২৭-১-১৮৭৭)’ চন্দ্রমুখীর ফল প্রকাশ করল। “দ্য অফিশিয়েটিং রেজিস্ট্রার রিপোর্টেড দ্যাট চন্দ্রমুখী বসু, আ পিউপল অব নেটিভ ক্রিশ্চান গার্লস স্কুল অ্যাট দেহরা হ্যাড বিন ডিক্লেয়ারড বাই দ্য জুনিয়র বোর্ড অব এগজ়ামিনারস ইন আর্টস টু হ্যাভ অ্যাটেন্ড দ্য এন্ট্রান্স স্ট্যান্ডার্ড...ইট অ্যাপিয়ার্স, দেয়ারফোর, টু দ্য সিন্ডিকেট দ্যাট দ্য টাইম হ্যাজ় নাউ কাম টু মেক ডেফিনিট প্রভিশন ফর অ্যাডমিশন অব ফিমেল ক্যান্ডিডেটস ইন ফিউচার।’’ অর্থাৎ, পাশ করলেন, আবার করলেনও না। দি ইংলিশম্যান ও হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় এই নিয়ে যথেষ্ট লেখা হয়েছিল সেই সময়ে।
এ বার এগিয়ে এলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী কাদম্বিনী বসু ও সরলা দাশ যাতে পরের বছর প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে পারে, তার জন্য উপাচার্য স্যর আর্থার হবহাউসের কাছে আবেদন করলেন। উপাচার্যের নির্দেশ, প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার অনুমতি পেতে আগে একটি যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। ১৮৭৭ সালে কাদম্বিনী ও সরলা সেই পরীক্ষায় পাশ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত হল। কাদম্বিনী বসুর নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারে উঠল ১৮৭৮ সালে প্রথম প্রবেশিকা পাশ করা মহিলা হিসেবে।
এতে চন্দ্রমুখীর কৃতিত্ব কিন্তু বিন্দুমাত্র কমে যায়নি। তাঁর নাম সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারে ওঠেনি, তবে একটা অলিখিত পাশের স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন সিন্ডিকেট রেজ়লিউশনে। তা ছাড়া এটা মনে রাখতে হবে চন্দ্রমুখী এফএ পরীক্ষায় সরাসরি বসার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং ১৮৭৭ সালের ওই পরীক্ষাই যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়েছিল।
লেখক লিখেছেন, খ্রিস্টান বলে চন্দ্রমুখীকে বেথুন কলেজে ভর্তি করা হয়নি। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। কাদম্বিনীর জন্যই বেথুন স্কুলে কলেজ বিভাগ শুরু হয় ১৮৭৯ সালে এফএ ক্লাস দিয়ে। চন্দ্রমুখী ফারসি ভাষা নিয়েছিলেন ফ্রি চার্চ মিশন স্কুলে। বেথুন স্কুলে ফারসি ভাষা পড়ানোর উপযুক্ত শিক্ষক না থাকায় চন্দ্রমুখী ওই স্কুল থেকেই এফএ পরীক্ষা দিলেন কাদম্বিনীর সঙ্গে ১৮৮১ সালে। বেথুন স্কুলে বিএ ক্লাস খোলা হলে চন্দ্রমুখীও ভর্তি হলেন। ১৮৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে সমগ্র ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েটের স্বীকৃতি পেলেন চন্দ্রমুখী ও কাদম্বিনী।
রাজীব গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা-৬৪
বিস্মৃত নন
কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় চন্দ্রমুখীর পিতা ভুবনমোহন বসুকে খ্রিস্টধর্মে অনুরক্ত করেননি। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় (যাঁর আদি নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬১ সালে। সেই হিসেবে তিনি ভুবনমোহন বসুর জ্যেষ্ঠা কন্যা চন্দ্রমুখীর (১৮৬০) থেকে এক বছরের ছোট। ভুবনমোহন এফএ পড়ার সময়ে ধর্মান্তরিত হন। তখন তাঁর বয়স আঠেরো বছর। অর্থাৎ, উপাধ্যায়ের পক্ষে তাঁকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা সম্ভব নয়।
চন্দ্রমুখীর জন্ম ‘অধুনা বাংলাদেশে’ নয়, মহানাদ, হুগলিতে। তাঁর জন্মের অল্প পরেই ভুবনমোহন বসু সপরিবারে দেহরাদূনে চলে যান, এবং সেখানে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। চন্দ্রমুখী তৎকালীন কলকাতার সমাজে পরিচিত মানুষ ছিলেন। বিদ্যাসাগরের স্নেহধন্য চন্দ্রমুখী এমএ পাশ করার পর তাঁর কাছ থেকে একটি অভিনন্দন পত্র লাভ করেন ও শেক্সপিয়রের সম্পূর্ণ গ্রন্থাবলি উপহার পান। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত পত্রালাপ হত। স্বর্ণকুমারী দেবীর সখী সমিতির সদস্য ছিলেন তিনি। সেই সময়ের কিছু রক্ষণশীল মানুষ বেথুন কলেজের হস্টেলে মেয়েদের বিলাসিতার প্রশ্ন তুললে তিনি ডেইলি মিরর কাগজে সমুচিত জবাব দেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর প্রথম স্মরণসভাটি হয় বেথুন কলেজের হল-এ। আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যক্ষা চন্দ্রমুখী বসু। সেখানে সমবেত বেথুন কলেজের শিক্ষিকারা সিদ্ধান্ত নেন, বেথুন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির মেধাবী বালিকাকে বিদ্যাসাগরের নামে একটি পুরস্কার দেওয়ার। তাঁরা নিজেরাই উদ্যোগ করে একটি ট্রাস্ট ফান্ড তৈরি করেন। ওই পুরস্কারটি এখনও চালু আছে। সেই সময়ের এডুকেশন গেজ়েট নামক পত্রিকায় চন্দ্রমুখী ও তাঁর সহকর্মীদের প্রশংসা করে খবরটি ছাপা হয়।
চন্দ্রমুখী মোটেও বিস্মৃত চরিত্র নন। ২০০৪ সালে বেথুন কলেজের ১২৫তম বার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করেই প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থটির নামকরণ করা হয় ইন দ্য ফুটস্টেপস অব চন্দ্রমুখী। এর আগে ১৯৮৩ সালে এঁদের দু’জনের গ্র্যাজুয়েশনের শতবার্ষিকীতে কলেজ পত্রিকার ‘চন্দ্রমুখী কাদম্বিনী’ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী ভবনের সর্বোচ্চ তলায়, একটি সেমিনার কক্ষ, গ্যালারি এবং কনফারেন্স ঘর-সহ অতি সুশোভন কাদম্বিনী-চন্দ্রমুখী সভাঘর আছে। প্রবেশের মুখে এঁদের খোদাই-করা ছবি-সহ ফলকও আছে।
উত্তরা চক্রবর্তী
প্রাক্তন অধ্যাপিকা, ইতিহাস বিভাগ, বেথুন কলেজ
বাংলা ভাষণ
গত ২২ শ্রাবণ, বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সমাবর্তনে রবীন্দ্রনাথকে বাংলায় ভাষণ দিতে অনুরোধ করেন। ব্রিটিশ শাসনে তা ছিল এক কঠিন সিদ্ধান্ত।
প্রসঙ্গক্রমে জানাই, ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন স্যর দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী। তিনি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেশক রূপে প্রবন্ধ পাঠ করার অনুরোধ করলে রামেন্দ্রসুন্দর তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, যদি বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ পাঠ করার অনুমতি দেওয়া হয়, তবেই তিনি বলবেন। দেবপ্রসাদ তাঁর অনুরোধ মেনে নিলে পরবর্তী বছরে রামেন্দ্রসুন্দর বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ পাঠ করেন।
অসিতাভ দাশ
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, নদিয়া
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।