—ফাইল চিত্র।
দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘রাজনীতি বনাম রাজধর্ম’ (১১-১) শীর্ষক লেখাটির পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্র। এমন একটি সময়োপযোগী লেখা আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য প্রবন্ধকারকে ধন্যবাদ জানালেও, কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। প্রথমত, বেশ কিছু কাল ধরেই এ রাজ্যে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা ভাঙার বা তা নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তারই এক ভয়ঙ্কর প্রকাশ সাম্প্রতিক সন্দেশখালির ঘটনা। স্বভাবতই একটা অবধারিত প্রশ্ন মানুষের মনে উঁকি দিচ্ছে যে, এর পরে কী? তবে কি অদূর ভবিষ্যতে অন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির উপরেও এমন আক্রমণ হবে? দ্বিতীয়ত, যে-হেতু মহামান্য আদালতের নির্দেশেই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন তাদের কাজে বাধা দেওয়ার অর্থ, ভারতের সংবিধান, আইন এবং বিচারব্যবস্থাকে অমান্য করা। রাজ্যের ভবিষ্যৎ পরিবেশের ক্ষেত্রে যা এক সাংঘাতিক ইঙ্গিত হিসাবেই ধরে নেওয়া যায়। তবে এমন পরিবেশ গড়ে তোলার নেপথ্যে কে বা কারা কলকাঠি নাড়ছেন, তা বোঝা খুব দুষ্কর কি?
আবার সন্দেশখালির মতোই প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল যখন ইডি আধিকারিকরা বনগাঁর প্রাক্তন পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসছিলেন। সেখানেও উন্মত্ত দুষ্কৃতীরা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর গাড়ি ভাঙচুর করে। কোথায় এমন নৈরাজ্যের সময় রাজ্য সরকার যথাযথ পদক্ষেপ করবে, তা নয়, বরং দেখা গেল রাজ্য সরকারের এক প্রবীণ মন্ত্রী প্রকাশ্যে হুমকি দিলেন যে, ইডি যেখানেই তল্লাশিতে যাবে, সেখানেই তাদের এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং, এটা সহজেই অনুমান করা যায় বর্তমানে এ রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। তারই ফলে মহামান্য আদালতকে প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে এবং প্রতি বারই রাজ্য সরকারের অবধারিত ভাবে পরাজয় ঘটছে, সে কথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
বিচার বিভাগকে যদি প্রতিনিয়ত রাজ্য সরকারের অনৈতিক এবং অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হয়, তবে অন্য বিচারাধীন বিষয়গুলি সুবিচারের আশায় কাল অতিবাহিত করবে। সব মিলে রাজ্যবাসীর পক্ষে এই আবহ যে এক অশনি সঙ্কেত হয়ে উঠেছে, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। যত তাড়াতাড়ি রাজ্য সরকারের অবস্থান এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে, ততই পশ্চিমবঙ্গবাসীর মঙ্গল।
অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫
কোন পথে
দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। কমিউনিস্ট ইস্তাহারে আমরা পাই— “বুর্জোয়া সমাজে পুঁজি হল স্বাধীন, স্বতন্ত্র সত্তা, কিন্তু জীবন্ত মানুষ হল পরাধীন, স্বতন্ত্র সত্তাবিহীন।” আবার, কবি জয়দেব বসু ‘হে চিরাগ’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছিলেন, “...কার খেত জ্বলে যায়, কার ঘর ভেঙে যায় ঝড়ে/ কার গান জমে থাকে ভয়ের গহীন কন্দরে/ কার আর কেউ নেই, শুধু মুখে দুঃখের দাগ-/ কথা বলো হে চিরাগ, থেকো না অমন নির্বাক...।” আগুনের পরশমণির ছোঁয়াটুকু সঙ্গী করে বেঁচে থাকা জনতার দল নির্বাক নয়নে দুঃসময়ের সহনশীলতা বুকে নিয়ে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে ফেরে। এ দেশের রাজ্য জুড়ে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার চালচিত্র প্রতিটি অনুভূতিশীল মানুষের বুকে তির বিঁধে দিয়ে যায়।
আমাদের বিস্ফারিত নয়ন নির্বাক পলকহীন। একের পর এক অঘটনের ঘনঘটায় আমরা আমাদের ‘নিরাপদতম’ আবাসভূমির রাজনৈতিক কার্যকলাপ অন্ধের মতোই দেখে চলি। ভাল-মন্দ বিবেচনা বোধের তাপ-উত্তাপহীন সমাজের বুকে বসে রাজনৈতিক আস্ফালনের অদম্য উৎসাহে যতিচিহ্ন এঁকে দিতে পারি না। অসহায় আমরা শীর্ষ আইনরক্ষকদের কঠোর কঠিন মুখগুলির দিকে ফিরে ফিরে তাকাই। নির্লজ্জ পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসনের নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের দুয়ারে বসে প্রমাদ গুনি। অবক্ষয়ের সমাজ মানবিকতার পাষাণ খণ্ডটিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করবে আর আমরা শুধুই চেয়ে রইব শীর্ষ ন্যায়ালয়ের অন্তরমহলে? কেবলমাত্র শীর্ষ আদালতের উপর নির্ভর করে কি কোনও দেশে গণতন্ত্র অগ্রসর হতে পারে? নীতি নৈতিকতার শাঁসে-জলে পুষ্ট হয়েই বাদী-বিবাদীর মতান্তরে যুক্তি তর্কে সুস্থ গণতন্ত্রের অগ্রগমন।
প্রবন্ধকার রাজদণ্ডের যুক্তিপূর্ণ পরিচালন ক্ষমতার ক্ষেত্রে রাজনীতি এবং রাজধর্মের মাঝখানের ভেদরেখাটির ধূসর থেকে ধূসরতম হয়ে যাওয়ার যে প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন, তা যথার্থ। ভোটপ্রত্যাশী রাজনীতিকরা যদি জনতা জনার্দনকে নির্বোধ মনে করে বারংবার ঘুরেফিরে রাষ্ট্রযন্ত্রের অভিসন্ধিমূলক আচরণকেই দেগে দেয়, তা হলে এক সময় বৃহত্তর সমাজেও সন্দেহের বীজ দানা বাঁধে। যদিও এই সকল ন্যায়নীতির কাব্যকথা রাজনৈতিক পরিসরে বা মঞ্চে কেবলমাত্র কয়েকটি মূল্যহীন শব্দ ছাড়া আর কিছুই না। কারণ ভোট বড় বালাই। সেখানে সংখ্যাতত্ত্বের কচকচানিতে কেবলই এগিয়ে যাওয়ার আস্ফালন। আর আঞ্চলিক দাদাদের সহায়তা ব্যতিরেকে কোনও রাজনৈতিক দলই যে নির্বাচনে সাফল্য লাভ করতে পারবে না, তাও বলা বাহুল্য। উপর্যুপরি দলের ব্যয়বহুল প্রচারকার্য বজায় রাখার তহবিল হিসাবে সেই সকল দাদাকে পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে প্রত্যহ ‘লেভি’ বা খাজনা সংগ্রহ পরস্পরকে ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’— এই আপাতনিরীহ বাক্যবিন্যাসে ভর করে পথ চলতে শেখায়। তাই শাসকের উদ্ধত আচরণ আশপাশের সব জঙ্গলকেই সাফ করতে চায়। আর গণতন্ত্রে এই বিরোধী স্বর নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অছিলাতেই যুগে যুগে শাসকের ছত্রছায়াতেই বেড়ে ওঠে আঞ্চলিক অবিসংবাদী বীরপুঙ্গবের দল। তেমনই এক-একটি ‘সম্পদ’ অঞ্চলভেদে জন্ম নেয়। সাম্প্রতিক সন্দেশখালি তাই খালি চোখেই দেখিয়ে দেয় দোর্দণ্ডপ্রতাপ শেখ শাহজাহানের ক্ষমতার আস্ফালন। রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায় কিংবা অন্যায্য আক্রমণের মুখে পড়ে (যদি কারণ ছাড়াই এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি কোনও বাড়িতে হানা দেয়) দাদার গুণমুগ্ধ ভক্তরা একেবারে লাঠিসোঁটা নিয়ে সেই সব অন্যায্য কাণ্ডের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কারণ, দাদা বিনা প্রাত্যহিক জীবনের পথ চলাটুকু ভক্তদের নিকট কুসুমাস্তীর্ণ হয়ে উঠবে না।
এ ভাবেই দূষিত জল-হাওয়ায় গণতন্ত্রের বাড়বৃদ্ধি হয়। তবে সন্দেশখালিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নেতা মন্ত্রী-পারিষদবর্গের কণ্ঠে ইডি আধিকারিকদের প্রতি আক্রমণটিকে যে ‘জনরোষ’ বলে চালানোর প্রচেষ্টা চলেছে, তা সুস্থ গণতন্ত্রের নিকট আরও ভয়াবহ একটি বিষয়। রাজনীতিকে হাতিয়ার করে রাজধর্মের শিথিলতায় অভ্যস্ত বর্তমান সময়ের গণতন্ত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘রক্ষাকবচ’ নামক শব্দটিকে আপন আত্মার চেয়েও প্রিয় বলেই মনে করে থাকেন। এমন নিশ্চিত রক্ষাকর্তার আশ্রয়েই তাঁদের দুর্নীতিগুলিও সমাজে এক সময় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। কিন্তু সীমাহীন অপশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে শাসকের রাজদণ্ড গণতন্ত্রে দুর্নীতির ক্ষেত্রে কতটা অসীম হতে পারে, সেই নিদর্শনই বর্তমান নাগরিক সমাজকে বিস্ময়বোধে আবিষ্ট করে। এমন তথাকথিত অপাপবিদ্ধ গণতন্ত্রে ‘মাস্টারমশাই’-এর দল আরও কত দিন চক্ষু মেলে না দেখেই থাকবেন, সেই সম্বন্ধেও ঘোরতর সংশয় দানা বাঁধে। তাই মনে হয়, মেকি গণতন্ত্রের পথে করে খাওয়ার রাজনীতিতে বিশ্বাসী অধিকাংশ রাজনৈতিক অভিভাবকগণ নিজেদের আচরণ শুদ্ধ না করে কেবলই আত্মপক্ষ সমর্থনের স্বার্থে অভিযোগের তিরগুলিকে যদি শুধুমাত্র বিপরীত দিকেই নিক্ষেপিত করতে থাকেন, তা হলে সেই সব ছলচাতুরি এক দিন ধরা পড়বেই।
তখন সেই সকল সত্যিকারের ‘জনরোষ’ সামলানোর ক্ষমতা এই যুগের রাজনীতির কারবারিদের আদৌ আছে কি না, সে বিষয়েও প্রশ্ন থেকেই যায়।
সঞ্জয় রায়, হাওড়া