স্মৃতির সলতে উস্কে দিয়েছেন শ্যামল চক্রবর্তী (‘শশী ডাক্তারের কথা মনে পড়ে’, ২৯-৬)। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘অরক্ষণীয়া’ উপন্যাসে (১৯১৬-১৭) হরিপালে ম্যালেরিয়ার ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের কথা তুলে ধরেছিলেন— ‘‘হরিপাল! ম্যালেরিয়ার ডিপো! ...পল্লীগ্রামে সাপের কামড়ে আর ক’টা লোক মরে, মরে যা তা ঐ ম্যালোয়ারীতে।’’ সেই সময় হরিপালে আসেন ডাক্তার আশুতোষ দাস। তিনি হরিপালে চিকিৎসালয় খুললেন। দেখলেন, অসংখ্য মানুষ ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, কলেরা ও বসন্ত রোগে অকালে মারা যায়। তিনি বেশ কয়েক জন উদ্যমী যুবককে প্রশিক্ষিত করে প্রত্যন্ত গ্রামে রোগীদের সেবার জন্য পাঠান। নিজে সাইকেলে, ঘোড়ায় চড়ে রোগীদের খোঁজ নিতেন। হরিপাল স্টেশনের কাছে ‘কল্যাণ সংঘ’ নামে দাতব্য সেবা প্রতিষ্ঠান এবং ভ্রাম্যমান চক্ষু চিকিৎসা কেন্দ্রও খুলেছিলেন।
স্বদেশপ্রীতির কারণে তাঁকে একাধিক বার কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। অতিরিক্ত পরিশ্রম, রোগীদের সংস্পর্শ, কারাবাস প্রভৃতি কারণে আশুতোষ দাসের স্বাস্থ্য ক্রমেই ভেঙে পড়ছিল। কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এক দিন হরিপাল থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে রাজবলহাটে রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধরা পড়ে তিনি নিজেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে ১৯৪১ সালের ৩১ জুলাই তিনি মারা যান।
প্রসন্নকুমার কোলে
শ্রীরামপুর, হুগলি
তুলনা চলে না
শ্যামল চক্রবর্তী বহু পুরনো উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে আজকের সমস্যা-দীর্ণ ডাক্তারদের তুলনা করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের ডাক্তার চরিত্র সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকেই ছিল কি না, সন্দেহ। সেই ‘শশী ডাক্তার’কে ভাবতে হত না যে প্রত্যেক মুহূর্তে তাঁর ওপর শারীরিক আক্রমণ হতে পারে, বা হঠাৎ এক দিন তাঁর নামে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের শমন আসতে পারে। প্রবন্ধ-লেখকদের আর একটি প্রিয় চরিত্র ‘অগ্নীশ্বর’। বনফুলের সত্তর বছর আগে লেখা কাল্পনিক চরিত্রের উল্লেখ করে এখনকার চিকিৎসা ব্যবস্থার নিন্দা করা প্রতি বছর পয়লা জুলাইয়ের বাঁধাধরা ঘটনা।
বাঙালি অতীতমুখী হওয়ায় আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব ঘটনাই চোখের আড়ালে থেকে যায়। আজ ডাক্তাররা যে প্রায় অসাধ্য সাধন করছেন, ক্যান্সার, এইচআইভি বা এসএলই-র মতো বহু অসুখ থেকে মানুষকে সুস্থ করে তুলছেন, তার কথা আর মনে থাকে না। এই ২০২০ সালে, যখন হৃৎপিণ্ডের ১০০ শতাংশ ব্লক হওয়া ধমনীও খুলে আবার নতুন প্রাণসঞ্চার করা যায়, সেই সময়ে চর্বিতচর্বণ চলছে, কেন আজকের ডাক্তাররা সাইকেলে করে বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করেন না! আজকের তরুণ ডাক্তাররা জানেন যে, সামান্য একটা ভুল হলেও তাঁদের ভাগ্যে রয়েছে মিডিয়ার বিচার, সমাজমাধ্যমে অকথ্য গালাগালি, প্রতিবেশীদের অপমান, ক্রেতা সুরক্ষা আদালত, পুলিশ, স্বাস্থ্য কমিশন, মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং ওপরমহলের তিরস্কারের নাগপাশ।
বিদেশে ‘ম্যানস্লটার’ এবং খুনের মধ্যে আইনি পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এ দেশে নেই। ফলে এখানে রোগী মারা গেলে (যে কারণেই হোক) সরাসরি ডাক্তারের নামে খুনের মামলা করা যায়। অর্থাৎ ছাত্রাবস্থা থেকেই ডাক্তারকে জানতে হয় ৩০৪ বা ২৯৯ ধারায় মামলা হলে কী করতে হবে। কিন্তু যখন তাঁরা রাত জেগে এবং পড়াশোনা করে রোগীকে সুস্থ করে তোলেন, তখন তাঁর জন্য কোনও সম্মান বরাদ্দ নেই। সেটা তো তাঁর ‘কাজ’। এ আর এমন কী ব্যাপার!
বাঙালির এক প্রিয় বিষয় হল, ডাক্তারদের শপথের প্রসঙ্গ টেনে দাবি করা যে তাঁদের প্রাণপাত করে, বিনা পয়সায়, রোগীর হাতে মার খেয়েও ‘সেবা’ করে যেতে হবে। গত কয়েক বছরে এই রাজ্যে ডাক্তারদের ওপর বার বার আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। অনেক সময়ে ক্যামেরার সামনেই ডাক্তারকে নিগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু যে বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা ১ জুলাই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার নিন্দা করে বিশাল প্রবন্ধ লিখলেন, তাঁদের কাউকে তখন এক কলমও লিখতে দেখা যায়নি। বরং সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ সিনেমার দৃশ্যের তুলনা করে বলা হয়েছে যে, ডাক্তারদের সহনশীল হতে হবে। যে হেতু সেই ৬০ বছর আগের সিনেমায় এক চরিত্র আর এক চরিত্রকে চড় মেরেছিল, সুতরাং ২০২০ সালের কলকাতাতেও ডাক্তারকে চড় খেয়ে ‘সহনশীল’ থাকতে হবে!
বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সমাজ যেমন আর ফিরবে না, তেমন সেই সব কাল্পনিক ডাক্তাররাও আর ফিরবেন না। আমাদের এই জেন-ওয়াই ডাক্তারদের নিয়েই চলতে হবে।
রুদ্রজিৎ পাল
কলকাতা-৩৯
হারিয়ে যাননি
শ্যামল চক্রবর্তী লিখেছেন ‘‘সেই ডাক্তারবাবুরা হারিয়ে গেছেন সেই কবে!’’ রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে দেখেছি বিপদে মানুষের পাশে থাকা ডাক্তারবাবুরা ছোট-বড় শহর, গ্রামগঞ্জে এখনও আছেন। তবে তাঁরা সংখ্যায় কম, মানুষ এখনও তাঁদের ভগবান ভাবেন। এঁদের কথা সংবাদমাধ্যমে খুব একটা উঠে আসে না। আমাদের বর্ধমান জেলার কালনা শহরের এক চিকিৎসক চল্লিশ বছর ধরে পাঁচ টাকায় রোগী দেখেন। অনেকে পাঁচ টাকা ফি না দিলেও তিনি নির্বিকার। রাত-বিরেতে কলে যান। নামমাত্র খরচে অপারেশন করেন। এই লকডাউনের সময়েও তিনি চিকিৎসা করে চলেছেন।
বর্ধমান শহরে থাকেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষক ডাক্তার। তিনি লকডাউনের আগে পর্যন্ত সকালে বিধান এক্সপ্রেসে কলকাতায় যেতেন, সন্ধের পরে ফিরে গভীর রাত পর্যন্ত বিনা পয়সায় রোগী দেখতেন। এক রবিবার অনেক সকালে নাম লেখাতে গিয়ে দেখি, ৯০ জন আমার আগে নাম লিখিয়েছে। বর্ধমান শহরের আরও এক জন চিকিৎসক কুড়ি টাকা ফি নেন। সুযোগ পেলেই গ্রামে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করতে বেরিয়ে পড়েন। ফি না নিয়ে প্রতি শনিবার একটি গ্রন্থাগারে চিকিৎসা করেন। এই আদর্শতাড়িত চিকিৎসকেরা রোগীদের পাশে সর্বদা আছেন। সেবাই এঁদের ধর্ম।
পঙ্কজ পাঠক
শ্রীপল্লী, বর্ধমান
সোনার স্বপ্ন
ভারতের এক নম্বর মহিলা জিমন্যাস্ট, প্রণতি নায়েক মেদিনীপুরের পিংলায় দুটি সরু গাছের সঙ্গে বাঁশ বেঁধে জিমন্যাস্টিক্স করছেন (‘প্রণতিদের অলিম্পিক স্বপ্নেও ধাক্কা’, ৩-৭)। নেই অনুশীলনের উপযুক্ত পরিকাঠামো, নেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় অনুশীলনের কোনও ব্যবস্থা। স্বপ্ন, আগামী টোকিয়ো অলিম্পিক্সে জায়গা করে নেওয়া। করোনার গিঁটে আটকে আরও এক প্রতিভাময়ী জিমন্যাস্ট, প্রণতি দাস। বাংলার উঠতি তরুণ-তরুণীদের অনেকের এমনই হাল। এঁদের আছে উপরে ওঠার অদম্য ইচ্ছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই। জিমন্যাস্টিক্স সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। অলিম্পিক্সে তা ফুটবল, অ্যাথলেটিক্সের মতোই কদর পায়। কিন্তু জিমন্যাস্টিক্স নিয়ে এ দেশের কেউ ভাবে না।
ক্রিকেটের যা পরিকাঠামো ও তার প্রতি সকলের যা দৃষ্টিভঙ্গি, তার পঞ্চাশ শতাংশও যদি জিমন্যাস্টিক্সের মতো খেলাগুলিতে থাকত, তা হলে বোধ হয় আমাদের বছরের পর বছর পদকের আশায় হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হত না অলিম্পিক্সে, এমনকি এশিয়ান গেমসেও। রিও অলিম্পিক্সে ত্রিপুরার দীপা কর্মকার তাঁর গুরু, বিশ্বনাথ নন্দীর উপদেশকে পাথেয় করে একক প্রচেষ্টায়, স্রেফ মনের জোরে ফাইনালে পৌঁছন। একটুর জন্য পদক হাতছাড়া হয়তো করতে হত না যদি দীপা কর্মকার, প্রণতি নায়েক, প্রণতি দাস, টুম্পা দেবনাথরা আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, জাপানের মতো দেশগুলিতে জন্মাতেন। তা হলে তাঁরাও সিমোন বাইলস, ওলগা করবুট বা নাদিয়া কোমানেচি হয়ে উঠতেন, যাঁদের দেশ মাথায় তুলে নাচত। ভারতবাসী ক্রিকেট ছাড়া আর কিছুই বুঝল না।
তাপস সাহা
শেওড়াফুলি, হুগলি
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।