‘মূল সঙ্কটের চিকিৎসা চাই’ (১৮-৬) নিবন্ধে জয়া মিত্র বলেছেন যে, বিপদের বিষয়ে আগে থেকে জানা থাকলে তা মোকাবিলা করা যায় তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী ভাবে। আমরা সচরাচর দেখতে পাই, তাৎক্ষণিক মোকাবিলায় মানুষের আগ্রহ বেশি। দীর্ঘস্থায়ী সমাধান করে মানুষ, পশু-পাখি ও গাছপালাকে বাঁচানোর দূরদর্শিতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় না। সুন্দরবনের উন্নয়ন মানে কেবলমাত্র পাকা রাস্তা বা বড় বাঁধ তৈরি করা নয়। এই ধরনের ভৌগোলিক অঞ্চলে মানুষের ঘর-বাড়ি ঠিক কেমন হওয়া উচিত, নদীর গতিপ্রকৃতি কোথায়, কী ভাবে রুদ্ধ হওয়ার জন্য বছরের পর বছর প্রলয়ের মুখে গরিব মানুষদের পড়তে হচ্ছে, তা খুঁজে বার করে উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এগোনো দরকার। শুধু বিপদের সময় ত্রাণ আর ত্রিপলের জোগান নয়, ভাবতে হবে বিপদের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়েও।
উন্নয়ন মানে সব কিছু সিমেন্ট আর টাইলস দিয়ে মুড়ে ফেলা নয়। কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় এক সময় বাড়ি আর পাকা রাস্তার মাঝে এক ফালি মাটি আর সবুজ ঘাসের অংশ থাকত। এখন, তা আর চোখে পড়ে না। পুরোটা কংক্রিট দিয়ে মোড়া। বাড়ি আর রাস্তার মাঝের এক চিলতে সবুজ কীট-পতঙ্গ, কেঁচোর আবাসস্থল। বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে তাদের ভূমিকা ফেলে দেওয়ার নয়। এই সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি মাটির নীচের জলস্তরও রক্ষা করে। বর্ষার জল এই মাটি দিয়েই নীচে চুইয়ে ঢোকে। কংক্রিটে ঢেকে দেওয়ায় এখন এই জল জমে রাস্তায়। যাঁরা উন্নয়নের নকশা করেন, তাঁরা এই ছোট্ট ঘাসে ঢাকা অংশের গুরুত্ব ভুলে গিয়েছেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কলকাতার উচ্চতা মোটামুটি ৩০ ফুট। কলকাতা থেকে সুন্দরবন খুব দূরে নয়। ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করে কলকাতাকে এযাবৎ সুন্দরবন রক্ষা করে আসছে। কিন্তু সুন্দরবন যদি না বাঁচে, তা হলে কলকাতাও বাঁচবে না। তাই তাৎক্ষণিক লাভের জন্য প্রকৃতি-পরিবেশ নষ্ট না করে কী ভাবে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন করা যায়, তা শিখতে হবে।
চম্পা খাতুন, কলকাতা-৯৯
সুন্দরবনপ্রেমী?
সত্যিই যদি ‘শহুরে বাবু-মেম’দের তথাকথিত জনসেবা দুর্যোগগ্রস্ত জনগণের সত্যিকারের উপকারে আসত, তা হলে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার নামখানা ব্লকের মৌসুনি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে মাঝিমাল্লাদের বলতে হত না, ত্রাণকার্যে আসা দলকে নৌকায় না নিতে। জনপ্রতিনিধিদের পাঁচ বছর পর পর ভোটে জিতে আসতে হয়। তাই কোনও জনপ্রতিনিধিই জনগণকে বঞ্চিত করতে চাইবেন না।
একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এই তথাকথিত জনসেবামূলক ত্রাণ পর্যটনের পরতে পরতে লুকোনো আছে সমাজমাধ্যমে নিজেকে জাহির করার, নাম কেনার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। সেই সঙ্গে আছে আর্থিক লোভ। সমাজমাধ্যম খুললেই ভেসে আসছে ‘দাও দাও’ চিৎকার। লকডাউন, আমপান, আবার লকডাউন, আবার ইয়াস— উপলক্ষের কমতি নেই। আর সেই সুযোগে মাথা তুলেছে রিলিফ টুরিজ়ম। সুন্দরবনের আবাসিকদের দুঃখে সবার প্রাণ কেঁদে উঠেছে। তাই, ‘তোমরা টাকা দাও, বাকিটা আমরা বুঝে নেব’।
এঁদের যাবতীয় উদ্যম টাকা চাওয়াতেই শেষ। সেই টাকা নিয়ে কী হবে বা কী হয়েছে, সে বিষয়ে দাতাদের কোনও তথ্য দেওয়ার বালাই নেই অনেকের মধ্যেই। কী ভাবে ‘বেনিফিশিয়ারি’ বাছা হবে, কী ভাবে ত্রাণসামগ্রী কেনা হবে, কার কাছ থেকে কেনা হবে এবং তা কিসের ভিত্তিতে, এই সমস্ত খরচের অডিট হবে কি না— এ সব বিষয়ে বেশির ভাগ ত্রাণ দানকারী দল আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব। ব্যক্তিগত সেভিংস অ্যাকাউন্ট-এ যে এ ভাবে টাকা তোলা যায় না, সেই নৈতিকতাও নেই। কারও কাছ থেকে টাকা নিলে তার হিসাব দেওয়ার দায়বদ্ধতা থাকে। তা ছাড়া, শুকনো আর্থিক হিসাবের বাইরেও একটা হিসাব থাকে। বেনিফিশিয়ারির জীবনে কতখানি বস্তুগত উন্নয়ন এসেছে, তা জানানো। পরিভাষায় এর নাম ‘ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’।
ছোটবেলায় শিখেছিলাম, সুন্দরবনে ঢুকতে হয় মাথা নিচু করে, হাত জোড় করে বনবিবি আর গাজির নামে দোহাই দিয়ে। চাকরি জীবনে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় উন্নয়নমূলক প্রকল্পের তদারকিতে গিয়ে এক বাউলির (সুন্দরবনে মধু, কাঠ, গোলপাতা সংগ্রহকারী দলের পথপ্রদর্শক) সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিনি পশুপাখিদের ভাষা বুঝতে পারেন। তাঁকে অবিশ্বাস করিনি। বাঁধ, বাদাবন, কটাল না বুঝে; সুন্দরী, গেঁওয়া, কেওড়া, গরান, গর্জন, গোলপাতা, কাঁকড়া না চিনেই যাঁরা এখন সুন্দরবনপ্রেমী হয়েছেন, তাঁদের জন্যে দুঃখ হয় আজকাল।
তপন পাল, কলকাতা-১৪০
ঘোড়ামারা
‘দুর্যোগের পর্যটন’ শীর্ষক চিঠি (২৪-৬) প্রসঙ্গে কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই। এক অভিযাত্রী সংগঠনের পক্ষে ২০ জুন আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে সাগরদ্বীপ এবং ঘোড়ামারায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে যাই। আমি ছিলাম ঘোড়ামারার দলে। মুড়িগঙ্গা পার হওয়ার সময় অযাচিত ভাবে এক দল এসে নৌকায় ত্রাণসামগ্রী তুলে দাবি করল ২,৫০০ টাকা। ইতিমধ্যে ঘোড়ামারা থেকে খবর এল যে, মানুষজন অস্থির। তাই তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আবহাওয়াও খারাপ হয়ে আসছে। তাই দরাদরি বা তর্কের সুযোগ ছিল না। স্থানীয় সূত্রে শোনা গেল, যাঁরা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যান, তাঁরা নিজেরা জিনিসপত্র নৌকায় তুললেও এঁদের হাতে কিছু না দিয়ে পার পাওয়া যায় না। প্রশাসনের কাছে এই ধরনের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার অনুরোধ রইল।
এ বার আসি ত্রাণ প্রসঙ্গে। ঘোড়ামারা যাওয়ার আগে অনেক পরিচিতের কাছে শুনেছিলাম, ওখানে ত্রাণসামগ্রী প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি গিয়েছে। কিন্তু তথাকথিত সভ্য জায়গা থেকে কোনও ভাবে আঁচ করা কঠিন, দুরবস্থা কতটা বা কেমন— কত যে বাড়ি মাটিতে কাদাতে মিশে গিয়েছে! ধ্বংসস্তূপে পরিণত ভিটের উপরেই কোনও ভাবে ভাঙাচোরা কাঠামো দাঁড় করিয়ে ত্রিপল জড়িয়ে মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই বানানো হয়েছে। এক হতভাগ্য পরিবারের গৃহিণীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, ভিতরে জল পড়ে কি না? উনি উত্তরে ‘না’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই পাশে দাঁড়ানো এক জন বললেন, “যদি জল পড়েও বা কী করার আছে? এখানেই তো থাকতে হবে।” ছোট্ট দ্বীপের মন্দিরতলা এলাকায় একটু উঁচু জায়গায় কয়েকশো পরিবারের অস্থায়ী আস্তানা প্লাস্টিক আর ত্রিপলের ছাউনির তলায়। গোটা দ্বীপেই বিদ্যুৎ আসেনি। ভরসার সৌরবাতিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিছু প্যানেল অক্ষত থাকলেও ব্যাটারি জলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নোনাজলে জমি আর চাষের উপযোগী নেই। পানের বরজও নষ্ট। এমন দুর্যোগের মধ্যে মানুষ নিজেকে বাঁচাবে, না পোষ্যকে? গরু, বাছুর, হাঁস, মুরগি অনেকেরই ভেসে গিয়েছে। নষ্ট হয়েছে ঘরের ধান, চাল, শস্য। রীতিমতো খাদ্যসঙ্কট! এমতাবস্থায় সরকারি উদ্যোগে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ব্যক্তিগত বা সংস্থাগত উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার জন্য কিছু সুরাহা হলেও তা নেহাতই সাময়িক। তবুও স্থানীয় মানুষ তথা পঞ্চায়েত সদস্যরাও খুব কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই স্বীকার করছেন এই অবদানগুলি। কিন্তু অনিশ্চয়তা তাড়া করছে প্রতি মুহূর্তে— কাল কী হবে?
এখন সমাজমাধ্যমে দেখছি অনেকেই ‘ত্রাণ পর্যটন’ জাতীয় নেতিবাচক লেখা ছড়াচ্ছেন স্থান-কাল-ঘটনা সংক্রান্ত কোনও সত্যতা যাচাই না করেই। ঘোড়ামারাকে দেখে মনে হয়েছে, সেখানকার পরিস্থিতির দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ এক স্বতন্ত্র পরিকাঠামো, সঠিক পরিকল্পনা এবং নিবেদিত দল চাই। তবে, ত্রাণ না পৌঁছলে বর্তমানকেই বাঁচানো সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতের পরিকল্পনাই বা কাদের নিয়ে হবে?
দীপ্তেশ মণ্ডল, চালুয়াড়ি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা