“‘সাঁইবাড়ির ভূতে’ অস্থির বাম-কংগ্রেস” (১৪-৬) প্রসঙ্গে বলতে চাই, অতীতের সেই ভয়ানক ঘটনার ভূত ২০২১ সালে প্রশ্ন তুলছে, বাম-কংগ্রেস জোট সত্যি কি হওয়া উচিত ছিল? ১৯৪৭-১৯৭৭, এই দীর্ঘ সময়ে কংগ্রেস সরকার নাকি ১২০০ বামকর্মীকে হত্যা করেছে। আবার ১৯৭৭-২০১১ এই দীর্ঘ ৩৪ বছরে বাম সরকার ৫০ হাজার কংগ্রেস কর্মীদের হত্যা করেছে বলে শোনা যায়। তবে শুধু কি সাঁইবাড়ির ভূত? মরিচঝাঁপি, বিজন সেতু, বানতলা, কেন্দুয়া, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম, দাসপুর, নেতাই-সহ বিভিন্ন নারকীয় ঘটনা হয়েছে বাম জমানায়। জনগণের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান। ক্ষমতা হারিয়ে, পুনরায় দ্রুত ক্ষমতা পেতে বাম-কংগ্রেসের জোট গড়া সত্যিই কি ইতিহাসের বিচারে সঠিক হয়েছে? গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভাবনায় আলিমুদ্দিন-গোপালন ভবন-প্রদেশ কংগ্রেস দফতরের ঠান্ডা ঘরে বসে, নিরাপদ দূরত্বে থেকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেই যে আমজনতা দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করে যাবেন, তা নেতা-নেত্রীরা ভাবেন কী ভাবে?
এই একপেশে, অসুস্থ আভিজাত্যের ভাবনার জন্যই আজ বাম-কংগ্রেসকে বিধানসভার বাইরে থাকতে আমজনতা বাধ্য করেছেন। জনগণের ভোট যখন নিতে হবে, তখন তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম কি দিতে হবে না রাজনৈতিক দলগুলোকে? বামপন্থী এবং কংগ্রেসিরা প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করেই তো রাজ্যের শাসনক্ষমতায় ছিলেন এতগুলো বছর। দু’টি দলই দ্বিচারিতার ফলে ক্ষমতা হারিয়ে, আজ জনতার বিরুদ্ধে গিয়ে এক সঙ্গে জোট গড়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে। বাস্তবে যে তারা জনগণকেই হারাতে চাইছে, তা কি এক বারও ভেবে দেখেছে?
মৃত্যুঞ্জয় বসু
কলকাতা-৩০
ভয়ানক স্মৃতি
“‘সাঁইবাড়ির ভূতে’ অস্থির বাম-কংগ্রেস” (১৪-৬) প্রতিবেদনটির সঙ্গে প্রকাশিত ছবিতে ফলকটিকে চিনতে একটুও বিলম্ব হয়নি। বরং পঞ্চাশ বছর আগে সপ্তম শ্রেণিতে পাঠরত যে কিশোর সে দিনের ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল, তার বুকের কাঁপুনি ফের অনুভব করলাম। বর্ধমানের আহ্লাদীপুর আমার জন্মভূমি। প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্যের বহুল-আলোচিত পোস্টটি পড়লাম। দু’একটি জায়গায় কিঞ্চিৎ ভ্রান্তি ব্যতীত সঠিক তথ্য ক্রমানুসারে তুলে ধরা হয়েছে। আহ্লাদীপুরের সঠিক ঠিকানা হল, ডাকঘর সরঙ্গা, থানা খণ্ডঘোষ, জেলা পূর্ব বর্ধমান। শহিদ শিবু রায়ের বাড়ি পার্শ্ববর্তী গ্রাম জুবিলায়। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১২ জুন, শনিবার, ২৮ জ্যৈষ্ঠ। আহ্লাদীপুর গ্রামের উপর কংগ্রেসের নবকুমার সাঁই-এর নেতৃত্বে নেমে এসেছিল বর্বরোচিত আক্রমণ। বিকেলের আক্রমণটিকে পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় প্রতিরোধ করা গিয়েছিল। তবুও যথেষ্ট সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এই আক্রমণের প্রধান অভিমুখ ছিল সিপিআইএম কর্মী-সমর্থক ও তাঁদের পরিবারের দিকে। কমরেড ওমর আলি মিদ্দের বাবাকে দুষ্কৃতীরা নিদারুণ শারীরিক নিগ্রহ করেছিল। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুষ্কৃতীরা পিছু হটে এবং প্রতিরোধকারী গ্রামবাসীদের সঙ্গে মুক্ত মাঠে লড়াই হয়। গুলিতে আহত শিবু রায়কে আমাদের বাড়ির পাশে পুকুরপাড়ের জঙ্গলে তাঁর সহযোদ্ধারা ফেলে রেখে পুলিশের ভয়ে চলে যান। পুলিশ এসে শিবু রায়কে ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। শোনা যায়, সন্ধ্যায় দ্বিতীয় পর্যায়ের আক্রমণের সময়ে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কংগ্রেস কর্মীরা শিবু রায়কে হত্যা করেছিল।
দ্বিতীয় পর্যায়ের আক্রমণ যখন শুরু হয়, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হাড় হিম-করা নারকীয় তাণ্ডব! মিটিং-ফেরত শয়ে শয়ে গাড়ি, সঙ্গে ততোধিক কংগ্রেসি আক্রমণকারী। শুরু হয় গ্রামের এক দিক থেকে অগ্নিসংযোগ, খুন, অত্যাচার, লুণ্ঠন। আক্রমণকারীর সংখ্যাধিক্য ও পুলিশ সঙ্গে থাকায় প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। কিছু বাড়ি ছাড়া পুরো গ্রাম জ্বলছে, বহ্নিশিখায় চতুর্দিকের মাঠ আলোকিত হয়ে গিয়েছে, আর গুন্ডাদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে পালাচ্ছে গ্রামবাসী। তাঁদের সঙ্গে ছুটছে সেই কিশোরটিও, এক হাতে তার ঘুম থেকে টেনে-তোলা ছোট ছোট মাতৃহারা ভাই-বোন, আর অন্য হাতে এক অন্ধ কাকা, যিনি এখনও জীবিত।
মাঠ থেকে শোনা যাচ্ছিল হামলাকারীদের পৈশাচিক উল্লাস, গুলির শব্দ, আর্তের কান্না। যাঁরা ঘর ছাড়তে চাইলেন না, বা সাহসে ভর করে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা প্রহৃত, লাঞ্ছিত হলেন, কয়েক জন নিহতও হলেন। শহিদরা সকলেই ছিলেন ষাটোর্ধ্ব, গরিব কৃষক। গৃহপালিত পশু, পাখি, শস্যগোলা, গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। শ্মশানপ্রায় গ্রামে আতঙ্কে অনেক দিন ঢুকতে পারেননি অনশন-ক্লিষ্ট মানুষগুলো। সে দিনের সেই কিশোরটির বোধগম্য হয়নি কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের ওই আক্রমণের হেতু।
সেই থেকে প্রতি বছর ১২ জুন দিনটি আহ্লাদীপুর গ্রামে ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে গ্রামের সকলে এই শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ফুলমালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সে দিনের সেই বারো বছরের কিশোর আজ ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অতিমারির কারণে এই বছর শহিদ দিবস অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা হল না। তাই যখন কংগ্রেসের সঙ্গে বামফ্রন্টের মোর্চা হয়, গ্রামের বিদ্বজ্জনেরা সত্যি বিস্মিত হয়েছিলেন। তবু বৃহত্তর স্বার্থে নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন।
সুদেব কুমার মল্লিক
কলকাতা-৮৯
বিরোধী নিষিদ্ধ
সম্প্রতি ভাঙড়ের এক পঞ্চায়েত প্রধান নিদান দিয়েছেন, একশো দিনের কাজ পেতে হলে তৃণমূলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে (‘বিরোধীরা কাজ পাবে না, মন্তব্য তৃণমূল নেতার’, ১৬-৪)। যারা খাম চিহ্নে ভোট দিয়েছে তারা ফুরফুরা শরিফে গিয়ে কাজ করুক, এমন কথাই বলেছেন তিনি। উল্লেখ্য, ভাঙড়ই একমাত্র বিধানসভা, যেখানে আইএসএফ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দলমত-নির্বিশেষে সব দুর্গত ভোগ করবেন, এটাই নিয়ম। প্রধানের এহেন মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক। তা হলে কি সরকারি ত্রাণ বিলিতেও অনুরূপ নিদান
দেওয়া হবে?
নিমাই দাশ
তামলিপাড়া, হুগলি
দুই সম্পাদক
বাংলার বিখ্যাত দুই সম্পাদক-লেখক গৌরকিশোর ঘোষ ও সাগরময় ঘোষের জন্মদিন (যথাক্রমে ২০ ও ২২ জুন) আমরা পেরিয়ে এলাম। দু’জনের সঙ্গেই কথাবার্তার স্মৃতি আজও অমলিন। দেশ পত্রিকার তরফে এক বার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন সাগরময়দা। বিশেষ কারণে কিছুতেই লেখাটা হচ্ছিল না। শেষে যে দিন জমা দিয়েছিলাম, উনি একটি টুকরো কাগজ দেখালেন। তাতে তারিখ ধরে ধরে লেখা, অন্তত সাত-আট বার আমি সময় চেয়েছি। এতই সুশৃঙ্খল সম্পাদক ছিলেন তিনি। কয়াডাঙার ক্ষিরোদ নট্টর ঢোল-বাজনা কেমন শুনলাম, কী আগ্রহভরেই না শুনেছিলেন।
সম্পাদক গৌরকিশোর ঘোষকে পাই আর একটি পত্রিকার দফতরে। যে কোনও লেখা হাতে জমা দিলে তৎক্ষণাৎ পড়তে শুরু করতেন। কাটাছেঁড়া আদপেই করতেন না, কিন্তু অদ্ভুত এক বাচনশৈলীতে পরামর্শ দিতেন। পরে আনন্দবাজার পত্রিকা দফতরে বিজয় চক্রবর্তীর ঘরে যাতায়াতের সূত্রে প্রায়ই এক আড্ডায় গিয়ে পড়তাম, যেখানে হাজির থাকতেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অরুণ বাগচি, রমাপদ চৌধুরী আর গৌরকিশোর ঘোষ। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের নতুন গানগুলি শ্রোতাদের মনে আলোড়ন ফেলবেই, রবীন্দ্রনাথের গানে যত নিরীক্ষা হবে, তত বাঙালি তাঁকে হারাবে— এ সব আলোচনার মধ্যমণি ছিলেন গৌরকিশোর।
অলক রায়চৌধুরী
কলকাতা-৫৫