—প্রতীকী ছবি।
ঈশানী দত্ত রায়ের ‘যদি বারণ কর’ (১০-১১) পড়ে কিছু মানসিক আনন্দ পাওয়া গেল। তিনি সঠিক ভাবেই বলেছেন, বর্তমানে চার পাশে যা চলছে সে সব দেখেশুনে সাধারণ মানুষ একদমই হতবাক। বিভ্রান্ত হয়ে ভাবছে, যা ঘটছে তা সত্যিই ঘটছে, না কি দৃষ্টিবিভ্রম। যখন সারা দেশ বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলছে, চার পাশের সব মানুষকে দৈনন্দিন খেয়েপরে থাকাতেই অসহনীয় অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, সেই সময়ে কিছু মানুষের হাতে বিস্ময়কর ভাবে অগাধ টাকার ছড়াছড়ি। আরও বিস্ময়কর এটাই যে, তাঁরা সবাই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। বলাই যায় যে, শাসক দলের নেতা-নেত্রীদের হাতের কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় নির্ধন হয়ে ওঠে ধনী, সর্বহারা হয়ে ওঠে অট্টালিকার মালিক, কোনও এক সময়ের মাছওয়ালা হয়ে যায় শত শত বিঘার জমিদার এবং বহু চালকল ও তেলকলের মালিক। দু’এক বছর আগেও যে লোকটা নেতা-মন্ত্রীর পিছন পিছন ঘুরে বেড়াত, কুঁড়েঘরে হতদরিদ্রের জীবনযাপন করত, আজ তার প্রাসাদোপম বাড়ি, গলায় মোটা সোনার চেন।
এ সত্যিই এক হীরক রাজার দেশ, যেখানে শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা চাকরির দাবিতে রাস্তায় বসে থাকে। আর অন্য দিকে, কিছু জনের বাড়ির পরিচারকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোটি টাকা জমে অথবা দেহরক্ষীর নামে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। চোখের সামনে সব দেখছে, আবার কিছুই দেখছে না। খবরের কাগজের প্রতিবেদন, টিভিতে সান্ধ্যকালীন তর্কযুদ্ধ, ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতরের হানা দেখতে দেখতেও মানুষ বড় ক্লান্ত। প্রথম দিকের গা গরম করা খবরও আজ পুনরুক্তি ও একঘেয়েমিতে দুষ্ট। মানুষ দোলাচলে ভুগছে, কে দোষী আর কে নির্দোষ, বুঝতে পারছে। আবার পারছেও না।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
দেখেছেন নাকি
সব নিষেধকে যদি মান্যতা দেওয়া হত, তবে রাতের পরে দিনকে বারণ করলেও কেন তার আবির্ভাব হয়, এ প্রশ্ন করে হাস্যাস্পদ হবে কোন মূর্খ? পাড়ার বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানে এক কালে গান শেখা ভদ্রমহিলা মঞ্চে উঠে বেশ কিছুটা সময় প্যাঁ-পোঁ করে হারমোনিয়াম বাজিয়ে তার পর যখন গান ধরলেন, ‘যদি বারণ কর তবে গাহিব না,/ যদি শরম লাগে মুখে চাহিব না’, তখন প্যান্ডেলে হাসির ফোয়ারা। তিনি কিন্তু গানটা শেষ করে তবেই উঠলেন। ঈশানী দত্ত রায় তাঁর প্রবন্ধে সাবলীল উপসংহারে বলেছেন, “যদি বারণ কর, তবে গাহিব, এমনি ভাবেই গাহিব।” সেটুকু যাঁরা গাইতে পারেন, কুর্নিশ তাঁদের প্রাপ্য।
এলাকার খুচরো নেতা থেকে জনপ্রতিনিধি, সাধারণ ঘর যখন চোখধাঁধানো প্রাসাদে রূপান্তরিত হল, তখন গুজগুজ-ফুসফুস। জনপ্রতিনিধি সবার মন পেতে তাঁর এলাকায় রাস্তাঘাট ঝাঁ-চকচকে করে দিলেন, রাস্তার ধারে টিউবওয়েল বসালেন। তাঁর সঙ্গে সদাই ঘুরঘুর করতে দেখা যায় একটা বৃত্তকে, যারা তাঁকে বাইকের পিছনে বসিয়ে নানা জায়গায় নিয়ে যায়। চুন-বালি-পাথর জমা হতে থাকে তাঁর সাদামাঠা ঘরের সামনে। কাজ চলতে থাকে দ্রুত। এক দিন সেটা রুমাল থেকে বেড়ালে রূপান্তরিত হওয়ার গল্পে সকলের নজর কাড়লেও কারই বা বুকের পাটা আছে, পিছনের কাহিনি জানাতে হবে বলে হুমকি দেওয়ার? আর তার তো উত্তর মজুতই আছে! সব সাদা টাকা, পৈতৃক আয় থেকে তৈরি। উত্তরটা যাদের মনপসন্দ হল না, তারা বিগড়ে গেল।
তাঁর প্রাসাদে যখন সাতসকালে ‘সেনা-সান্ত্রি নিয়ে কিছু লোক’ ঢোকে, তখন বিগড়ে যাওয়াদের একটি অংশ বলে, “বলেছিলাম না, সাদা টাকায় এ সব হয় না।” যদিও তাদের কথা ধোপে টেকে না। আবার সব এক দিন লোপাট হয়ে যায় কোন ম্যাজিকে, কে জানে? তখন অন্য খেলার আসর বসে। কোনও এক আদ্যিকালে কোনও এক জনপ্রতিনিধির কেলেঙ্কারি রাস্তায় যত্রতত্র ছত্রখান হয়ে পড়ে থাকে। কে ধরবে কীর্তিমানদের? এই ট্র্যাপিজ়ের খেলায় চাকরি বিক্রি হয় লাখ লাখ টাকায়। আর ওই সেনা-সান্ত্রিদের আনাগোনার নাটক চলতেই থাকে।
ঘটনা যখন খবর হয়, চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচারিত হয় অমুক জনপ্রতিনিধির কেচ্ছা, তখন স্মরণে আসে মঙ্গলকাব্য রচনার প্রেক্ষাপট। দেবদেবীরা ভক্তের জন্য পারেন না এমন কোনও কাজ নেই। কিন্তু, চুরি করে ধরা পড়ার পরও হাজতবাসে থেকে তর্জন-গর্জন, মানায় কি? যারা দোষী, তাদের মধ্যে সকলেই চিহ্নিত হবে না, জানা কথা। যেমন হাজতবাস সবার জন্য নয়। ওখানেও যোগ্যতার ব্যাপার আছে। কিন্তু, সেই যে প্রবাদবাক্য— “দে সে, হোয়াট দে সে, লেট দেম সে”। তাই, সর্বনাশের স্বখাত-সলিলে নিমজ্জিত হওয়ার আগেও কি মাস্টারমশাইরা বলবেন না, তাঁরা সমস্ত কিছু দেখেছেন?
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫
শব্দ কোরো না
‘যদি বারণ কর’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। প্রবন্ধটি পড়ে কবীর সুমনের গানের কথাগুলো মনের কোণে ভেসে উঠল— “এই যে দেখেছি আবছায়াটাই লাগছে ভাল/ ঘরের কোণে একটি মাত্র মোমের আলো/ কার তাতে কী?/ আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি...”
সত্যিই, আকালে কি স্বপ্ন দেখতে নেই? অথচ, মানবজীবনে স্বপ্ন ছাড়া বেঁচে থাকার আর কী-ই বা অবলম্বন রয়েছে? ভুবনভরা এক-একটা জীবন স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। দিন বদলের স্বপ্ন দেখা চকচক করতে থাকা সেই চোখগুলো আমাদেরও চোয়াল শক্ত করে দিয়ে যায়। তবুও, ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল! গভীরে গিয়ে পঙ্কিল আবর্তে মণিমুক্তোর খোঁজ করার এক্তিয়ার নেই আমজনতার। বোঝার ক্ষমতাটুকুও নেই যে, গভীর জলে কী খেলা চলছে! তবুও আড়ালে-আবডালে আমরা দেখেই চলেছি।
রাষ্ট্রের কারবারিরা একে অপরের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আবার কেউ বা স্বার্থের মোয়াটুকু নিজের ঝুলিতে পুরে নিতে চিরশত্রুর সঙ্গেও হাত মেলায়। রাজনীতি, কূটনীতি সবই চলে আপন খেয়ালে। দেশ হয়ে রাজ্য— সর্বত্রই সর্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তিত্ব বোঝাতে ব্যস্ত— আমাকে দেখো। আমি কপর্দকহীন, সংসার-পরিবারবিহীন। আমি সাংসদ-বিধায়ক, কোনও অর্থই গ্রহণ করি না। দলের দুর্নীতি? বালাই ষাট। ওরা তো বালকের দল। খালি অক্সিজেনটা মাথায় একটু কম ঢোকে। আর দলীয় সভায় দর্শকাসন থেকে বেয়াদবকে তুলে এনে আরবান নকশাল কিংবা মাওবাদী দেগে দিয়ে জেলে পুরে দিলেই হল। তার পর দেশদ্রোহী আইন লাগিয়ে দাও কিংবা নিদেনপক্ষে গাঁজার কেস। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, শাসক সদা সর্বদা সত্য কথা বলে। তাঁদের মুখনিঃসৃত বাণী অমৃতসমান। ব্যক্তি মানুষ প্রতিবাদী হতেই পারেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে তো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। মুহুর্মুহু মামলার ঝামেলা কাঁহাতক বয়ে বেড়ানো যায়! তবুও দেশের বলশালীদের সবক শেখাতে গিয়ে দুর্বল কব্জির সবল কলমটি চালানো এক দল মানুষের চোখ বুজে থাকলে চলে না! তাঁরা অপ্রিয় সত্য কথাগুলি লিখে সম্পাদকের টেবিলে পাঠিয়ে দেন।
বরুণ বিশ্বাস খুন হন, কামদুনির অষ্টাদশী ধর্ষিতা হয়। বিলকিস বানো গুজরাত দাঙ্গায় উচ্চবর্ণের লালসার শিকার হন। সত্যিই, নিন্দুকদের অন্তর্দৃষ্টি খালি ঠুলি পরেই থাকে। ভাল কাজগুলো ওরা দেখতে পায় না। এই যে মহিলা সংরক্ষণ বিল থেকে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ— সবটাই তো জনগণের স্বার্থে। তার পর রাজ্য-কেন্দ্র উভয়েরই স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প। এ ছাড়াও রয়েছে আরও পাঁচ বছর নিখরচায় চাল-গম। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আশীর্বাদের হাত উপুড় হয়ে আছে আমজনতার জেরবার হয়ে ওঠা জীবনে।
‘ইন্ডিয়া’ অবশেষে ভারত হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল ভারত, দেশীয় পণ্য উৎপাদনে গর্বিত ভারত, রামমন্দির গড়ে ওঠা সংখ্যাগুরুদের ভারত। সবে মিলে আমরা মহান। তাই কোনও কথা বোলো না, কেউ শব্দ কোরো না।
সঞ্জয় রায়, হাওড়া