পূজাবার্ষিকী নিয়ে ছোটবেলার স্মৃতি।
যশোধরা রায়চৌধুরীর ‘বেছে নেওয়ার ধৈর্য কই’ (২-১০) মনে করিয়ে দিল পূজাবার্ষিকী নিয়ে ছোটবেলার স্মৃতি। তখন আনন্দমেলা, শুকতারা আর কিশোর ভারতী-র পুজোসংখ্যা নেওয়া হত বাড়িতে। শারদ সংখ্যাগুলো হাতে আসা মাত্রই গোগ্রাসে পড়তাম সেগুলো পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে। সব লেখা শেষ করে তবে শান্তি।
এ ছাড়াও বাড়িতে আসত শারদীয় দেশ। বাড়ির বড়দের মতো আমিও তার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকতাম। কারণ, ওতেই থাকত ফেলুদার নতুন গল্প। সেই সময়, আমার মতো ফেলুদার ভক্তরা সারা বছর বসে থাকত ওই গল্পগুলোর জন্য। জটায়ু আর তোপসের মতো ফেলুদার সঙ্গে রহস্যের জাল ভেদ করতে আমিও শামিল হয়ে যেতাম ওদের অ্যাডভেঞ্চারে।
এখনও ওই চারটি পুজোসংখ্যা পড়ি। আজ শৈশবের অনেক প্রিয় লেখক-লেখিকাই আমাদের মধ্যে নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসিকে নিয়ে উপন্যাস বা নারায়ণ দেবনাথের নতুন কমিকস যখন পাই না এখনকার পুজোসংখ্যাগুলোয়, পাঠক হিসেবে খারাপ লাগে তো বটেই। কিন্তু অনেক নবীন লেখকও দারুণ লেখা উপহার দিচ্ছেন। আছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারের মতো নামকরা লেখকও— তাঁদের লেখা দিয়ে প্রতি বছর পুজোয় পাঠক-পাঠিকাদের মুগ্ধ করার জন্য।
সৌরীশ মিশ্র, কলকাতা-৯১
কাড়াকাড়ি কই?
‘বেছে নেওয়ার ধৈর্য কই?’ শীর্ষক প্রবন্ধে যশোধরা রায়চৌধুরী লিখেছেন— আজ পাঠকের হাতে বেছে নেওয়ার বস্তু অগণিত। বাছার জন্য যে ধৈর্য ও মেধা দরকার, সেটাই শুধু বেমিল। আর বেমিল অবসর। আমার মনে হয়, এই সমালোচনা পাঠকের প্রাপ্য নয়। বরং এই সমালোচনা বাংলা সাহিত্যের লেখকদেরই করা উচিত। বাংলা সাহিত্য কি তার আগের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে?
অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি যে ব্যাঙ্কের শাখায় কাজ করতাম, সেখানকার লাইব্রেরির জন্য পুজোর সময় আমরা প্রায় সব ক’টি শারদীয় সংখ্যা কিনতাম। কাড়াকাড়ি পড়ে যেত কে আগে কোনটা নেবে। শেষে লটারির মাধ্যমে শারদ সংখ্যাগুলো বণ্টন করতে হত। এখন আমি অবসরপ্রাপ্ত। শুনলাম বহু দিন হল সে শাখায় শারদ সংখ্যা কেনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কারণ পড়ার লোক নেই! এখন বাঙালি পাঠক ঠিক সময় বার করে টিভি সিরিয়াল ও মোবাইল দেখেন, কিন্তু বই পড়ে সময় কাটান না। লেখকরা কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছেন। এই প্রতিযোগিতায় জিততে গেলে তাঁদের লেখার মান বাড়াতে হবে। কিন্তু সেখানে আমরা কী দেখছি? বাংলা সাহিত্য ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক লেখকরা সহজ-সরল প্রকাশভঙ্গি ভুলে গিয়েছেন। গল্প যদি গল্পের মতো করে না বলা হয়, তবে সেটা আর গল্প থাকে না। পরীক্ষানিরীক্ষা করার হলে করা হোক, কিন্তু মূল জায়গাটা তো ঠিক রাখতে হবে। তাই পাঠকরা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন।
বাংলা সাহিত্যকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে গেলে লেখকদের আরও ভাবতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে, পরিশ্রমী হতে হবে। প্রতিভার অভাব নেই, সেই প্রতিভাকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে গেলে ধৈর্য ধরে, সঠিক পথে এগিয়ে যেতে হবে। প্রবীণ সাহিত্যিকদেরও উচিত সক্রিয় ভাবে নবীন সাহিত্যিকদের সাহায্য করা। কী ভাবে সৃষ্টিমূলক (গল্প, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদি) সাহিত্য সৃষ্টি করতে হয়, সে নিয়ে কোনও সফল বাঙালি সাহিত্যিকের লেখা গাইড বই নেই। অথচ, ইংরেজি বা বিদেশি ভাষায় এই ধরনের বইয়ের অভাব নেই। এই দিকেও নজর দিতে হবে।
অশোক বসু, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
জীবনের সঙ্গী
যশোধরা রায়চৌধুরী লিখছেন, শারদ সাহিত্য নাকি আর আগের মতো নেই। কথাটা অনেকাংশেই সত্যি। অতীতে সাহিত্যিকদের অসাধারণ সৃষ্টিতে যে ভাবে আমাদের মন ভরে যেত, হৃদয়ের গভীরে যে অপূর্ব অনুভূতি হত, এখন আর তা পাচ্ছি কই? খানিক পড়েই লেখা স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু, কোন সেই শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে পড়া গল্পগুলির স্মৃতি, তাদের আবেদন, মাধুর্য এখনও মনের মণিকোঠায় অমলিন হয়ে আছে! সৃষ্টি যদি মনে দাগ না কাটে, পড়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে যায়, তা হলে সেই লেখার কোনও মানে হয় না! বিজ্ঞাপনসর্বস্ব অনেক নামীদামি পত্রিকার থেকে কিছু লিটল ম্যাগাজ়িনের লেখার মান অনেক উন্নত। যদিও তা সংখ্যায় খুবই নগণ্য!
আমাদের ছোটবেলায়, আশুতোষ লাইব্রেরি থেকে শিশুসাথী নামে একটি কিশোর পত্রিকা প্রকাশিত হত। এতটাই প্রিয় ছিল সেটা আমাদের যে, বন্ধ হয়ে গেলে অঝোরে কেঁদেছিলাম! যত দূর মনে পড়ে, এই পত্রিকাতেই আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। শিশুমনে আনন্দ দিতে, তাদের চরিত্র গঠনে সহায়তা করতে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে, প্রকৃত মানবতায় সমৃদ্ধ হতে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে শিশু সাহিত্যের ভূমিকা বড়! সাধারণের মধ্যে রুচি তৈরি করার উপকরণের অভাব দূর করার প্রয়োজন অনস্বীকার্য!
কৃষ্ণা চৌধুরী, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
স্মৃতির সাহিত্য
যশোধরা রায়চৌধুরী ‘বেছে নেওয়ার ধৈর্য কই’ শীর্ষক প্রবন্ধে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকের শারদীয় সাহিত্য সম্ভারের সঙ্গে এখনকার শারদ সাহিত্যের তুলনা করে ডিজিটাল যুগে পাঠকসমাজে যে পরিবর্তন লক্ষ করেছেন, তা আমাদের মতো প্রবীণদের স্মৃতি উস্কে দিয়ে মন খারাপ করে দেয়। এখন ই-বই ও ই-পত্রিকার রমরমা এবং ডিজিটাল দুনিয়ার সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের সামনে মুদ্রিত বই-পত্রিকা-কাগজপত্রের অসহায় অবস্থা ও ক্রমশ পিছিয়ে পড়া ব্যথিত করে।
এই প্রসঙ্গে দু’টি বিষয়ের প্রতি লেখিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে মিনির বাবা এক জন ‘বইমুখো কেরানি’ ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক জন লেখক, যিনি সর্বদাই ব্যস্ত থাকতেন তাঁর লেখার কাজে। দ্বিতীয়ত, রমাপদ চৌধুরীর এখনই উপন্যাসটি ষাটের দশকের মাঝামাঝি দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় এবং তখনকার রীতি অনুযায়ী তাতে কোনও রকম ‘ইলাস্ট্রেশন’ থাকত না। তাই এই উপন্যাসটির সঙ্গে সুধীর মৈত্রের আঁকা কোনও ‘ছিপছিপে মেয়ে ও গুরুশার্ট পরা চুলে কেয়ারি করা সুঠাম ছেলে’-কে দেখতে পাওয়ার কথা নয়। অবশ্য সেই সময়ে পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত অন্যান্য গল্প-উপন্যাসে এদের দেখতে পাওয়া যেত।
আত্রেয়ী মিত্র, কলকাতা-১০৬
আকুল পাঠক
‘বেছে নেওয়ার ধৈর্য কই’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে দু’এক কথা। এটা ঠিক, এখন প্রযুক্তি বিপ্লবের কল্যাণে চার দিকে ই-পত্রিকার রমরমা। লেখার সুযোগ বাড়ছে, লিখছেন অনেকেই। কিন্তু পাঠক? যাঁরা একনিষ্ঠ পাঠক, পাঠের মধ্যে দিয়ে নিজেকে ঋদ্ধ করতে ভালবাসেন, খুঁজে নিতে আগ্রহী অজানা আনন্দ-ভান্ডার, তাঁদের মনের খবর কে রাখে! প্রসঙ্গত, প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় টানা ৪ দিন সংবাদপত্রগুলোর কোনও মুদ্রিত সংস্করণ বেরোয় না। তবে হাতের কাছে মোবাইলে ই-পত্রিকা মজুত। আছে টিভি, রেডিয়ো সবই। কিন্তু রোজের অভ্যাসমতো মন যে কেবল ছটফটায়। স্বাদহীন চায়ের কাপ, খেলার পাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি নেই, শব্দছক-এরও অনুপস্থিতি। প্রশ্ন জাগে, আগামী দিনে মনের এই আকুলতা দূর করার শক্তি কি অর্জন করতে সক্ষম হবে কোনও ই-পত্রিকা?
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া