দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা। —ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের ‘দিল্লি চলো’ যাত্রা দেখে মনে হল, একটা দুর্নীতি আর একটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে বলা হয়, দু’টি বিপরীত আদর্শের দ্বন্দ্বে প্রগতি আসে। ক্যাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, এখানে তো কেন্দ্র-রাজ্য দুই দলই সমান দুর্নীতিগ্রস্ত। অসার নীতি। গান্ধীজি, সুভাষচন্দ্র বসুর ডাকেও মানুষ দিল্লি গিয়েছিল স্বাধীনতা আনতে। বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের মতো তাঁরা আদর্শ বিক্রি করেননি। আজ যে লোকগুলো দিল্লি গেল, কয়েক দিন পরে তারা দেখবে, আজ নেতারা যাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে কাল তাদের সঙ্গেই জোট করবে। নব্বই দশকের শেষ দিকের রাজনীতিটা ভাবুন এক বার। মানুষ ঠকানোর রাজনীতি। স্মৃতিভ্রমে আক্রান্ত আজ নব্বই লক্ষ ভারতীয়। সিঙ্গুর রাজনীতির ঘোলা জলে পশ্চিমবঙ্গ শিল্প হারাল। তার বিকল্প কী হতে পারে? শাসকের সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি আর একটা কাজ শুভবুদ্ধির জাগরণ করা। নিজেরা রাজনীতি করুন, দয়া করে গরিব মানুষগুলোকে মুক্তি দিন।
ভারতে এখনও মাথাপিছু আয় অনেক কম, সঙ্গে অভাব, অপুষ্টি, ক্ষুধা। তবু বিশাল আয়োজনে নির্মিত হয়েছে সংসদ ভবন। এ যেন শাহজাহানের দিল্লি! অন্য দিকে, বঙ্গে চাকরির হাহাকার চরমে উঠেছে, কাটমানি ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে, গ্রামীণ নাবালিকা বিয়ের হার উদ্বেগজনক। শুধুমাত্র আর্থ-সামাজিক প্রকল্পগুলিতে ভিড় বাড়ছে। শাসক একে সাফল্য বললেও এটা মানুষের অর্থনৈতিক দীনতা। এত প্রকল্পের টাকা বাকি, তবু জি২০-র মতো সম্মেলনে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হল। কেন্দ্রের শাসক সংবিধান পাল্টাতে ব্যস্ত, আর রাজ্যের শাসক প্রমাণ করতে ব্যস্ত কার ক্ষমতা বেশি।
কনফুসিয়াস বলেছিলেন, উত্তম মানব যা খোঁজে তা রয়েছে তার নিজের মধ্যে, আর অধম মানব যা খোঁজে তা অন্যের মধ্যে। আর কবে শিখব আমরা?
তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান
হিন্দির জোর
জহর সরকারের প্রবন্ধ “‘হিন্দিত্ব’ আরও ভয়ঙ্কর’ (১১-৯) সম্পর্কে কিছু কথা। প্রথমত, ভাষা একটি মাধ্যম। মাধ্যমের সহজতা একান্ত জরুরি। দ্বিতীয়ত, বাংলা এবং অসমিয়া— এ দু’টি ভাষার লিপি আলাদা ঠিকই, তবে দু’টির মধ্যে অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ, এ দু’টির উৎপত্তি মাগধী ভাষা থেকে। ঠিক তেমনই হিন্দি ভাষার পাঁচটি উপভাষা আছে, রাজস্থানি হিন্দি, পূর্বি হিন্দি, পশ্চিমি হিন্দি, বিহারি হিন্দি ও পাহাড়ি হিন্দি। এই উপভাষাগুলির আবার আলাদা-আলাদা ‘বোলী’ অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষা আছে, যেমন বুন্দেলখণ্ডি, ছত্তীসগঢ়ী, ভোজপুরি ইত্যাদি। তাই আসলে ‘হিন্দি’ এই সকল ভাষার মা। পাশাপাশি বর্তমান জীবনযাত্রায় বাঙালিরা যেমন বাংলার বাইরে যাচ্ছে, সেই রকম অবাঙালিরাও বাংলায় থাকছে। তাই হিন্দিকে একটি সাধারণ সেতুর রূপ দেওয়া কি খুব অযৌক্তিক?
এখন হিন্দির যে রূপ দেখা যায়, তা খুব সরল। যে কোনও অ-হিন্দিভাষী তা সহজেই বুঝতে পারেন। অতএব হিন্দি ভাষার নিজস্ব ক্ষমতা আছে মধ্যমণি হওয়ার। তাই ‘চাপিয়ে দেওয়া’ কথাটা মনে হয় না ঠিক হবে।
শুভস্বপ্না মুখোপাধ্যায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
সঙ্কীর্ণতা কেন?
জহর সরকারের প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন সংসদের ‘অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ কমিটি’ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পেশ করেছে— ১) সব আইআইটি, আইআইএম এবং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম হবে হিন্দি, ২) কেন্দ্রীয় সরকারের আধিকারিক ও কর্মীদের ‘অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স অ্যাপ্রেইজ়াল রিপোর্ট’-এর ক্ষেত্রে তাদের হিন্দি ভাষার ব্যবহারের বিষয়টি দেখা হবে, ৩) প্রশাসনের যোগাযোগের ভাষা হবে হিন্দি।
২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশে ১২১টি মাতৃভাষা আছে। প্রায় পঞ্চাশটি অ-হিন্দি ভাষা উপভাষাকে হিন্দি বলে দেখিয়ে, পাইকারি হারে অ-হিন্দিভাষীদের সংখ্যা কমিয়েও দেখা যাচ্ছে ৫৬% ভারতবাসীর মাতৃভাষা হিন্দি নয়। আইআইটি, আইআইএম ও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির পরীক্ষাগুলি সর্বভারতীয় ভিত্তিতে হয়। অতএব বলতে পারি— হিন্দি চালু করে ওই পরীক্ষাগুলির প্রতিযোগিতার মাঠ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের নিঃশব্দে বার করে দেওয়ার পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করা হচ্ছে, যাতে একমাত্র হিন্দিভাষীরাই হতে পারে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি, শাসন বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন উচ্চ পদের দাবিদার। আর প্রশাসনের যোগাযোগের ভাষা হিন্দি হলে অ-হিন্দিভাষী কর্মীরা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বেন, এ কথা বলা বাহুল্য। এ সব থেকে পরিষ্কার যে, বর্তমান হিন্দিত্ববাদী শাসকরা অ-হিন্দিভাষী ভারতীয়দের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন।
বিহার থেকে রাজস্থান, হিমাচল থেকে উত্তরাখণ্ড— হিন্দি ভাষার বৈচিত্র এবং সেই বৈচিত্রজনিত সৌন্দর্যসম্পদের ভান্ডার বিশাল ও গৌরবজনক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী। কিন্তু বর্তমান হিন্দিত্ববাদী শাসকরা যে হিন্দি চালু করতে চাইছেন, তা সংস্কৃত-ঘেঁষা এলিট শ্রেণির হিন্দি, যা তাঁদের রাজনীতির মতোই দেশের এই সুবিশাল বৈচিত্রকে নির্মূল করে তাকে এক ছাঁচে ঢালাই করতে চায়। এই প্রচেষ্টা হিন্দির মাধুর্য সম্পদকেও ধ্বংস করবে। আমরা হিন্দি ভাষার বিরোধী নই, হিন্দির আগ্রাসনের বিরোধী। যে কোনও ভাষা সঙ্কীর্ণতার বিরোধী। আমরা সব ভারতবাসীর মাতৃভাষা শিক্ষার ও অন্য ভাষাভাষীদের সঙ্গে সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকারের পক্ষে। তাতেই নিরাপদ হবে আমাদের জাতীয় সংহতি ও ঐক্য। বহুভাষাভাষী মিশ্র সংস্কৃতির এই ভারতবর্ষের মর্মবস্তুকে আমাদের যে কোনও উপায়ে রক্ষা করতেই হবে।
তৈয়েব মণ্ডল, হরিপাল, হুগলি
শংসাপত্র
‘বাতিল করা হবে জনজাতি শংসাপত্র, নির্দেশ’ (৯-৯) শীর্ষক সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। আশার কথা, নবান্ন দেরিতে হলেও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে এবং অযথার্থ জনজাতি শংসাপত্র বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে। এই অভিযোগ জনজাতির মানুষজন দীর্ঘ দিন ধরেই করে আসছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, শংসাপত্রগুলি কি নিছক ভুলবশতই জারি করা হয়েছিল, না কি কোনও চক্র অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে তা করেছিল? এর উদ্দেশ্য কি রাজ্য সরকারকে অপদস্থ করা, না কি প্রকৃত জনজাতিদের বঞ্চিত করে, অন্যায্য ভাবে সাধারণ প্রার্থীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেওয়া? এই শংসাপত্র জারি করার জন্য, কোনও প্রকার আর্থিক লেনদেন হয়েছিল কি? ঘটনা যে ভাবেই ঘটে থাকুক, এতে পিছিয়ে থাকা প্রকৃত জনজাতিদের যে ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুয়ারে সরকার প্রকল্পে তড়িঘড়ি কাজ করার তাগিদে এবং অতি অল্প সময়ে সাফল্য দেখার লক্ষ্যে, শংসাপত্র জারির সময়ে ভুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তেমনই, ইচ্ছাকৃত ভাবে এই শংসাপত্র জারির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সরকারের দায়িত্ব, প্রকৃত জনজাতিদের লেখাপড়া, চাকরি, অথবা অন্যান্য ন্যায্য সুযোগ-অধিকারের ক্ষেত্রে তাঁদের যাতে বঞ্চিত না হতে হয়, তা সুনিশ্চিত করা। তাই, সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের অনুরোধ, বেআইনি শংসাপত্র বাতিলের সঙ্গে জনজাতি শংসাপত্র জারি করার সময়ে আবারও যাতে তা অ-জনজাতিদের হাতে না যায়, তাঁরা যেন সতর্ক নজর রাখেন।
বিশ্বনাথ মুর্মু, খাটখুরা, ঝাড়গ্রাম