Bharat Jodo Yatra

সম্পাদক সমীপেষু: বিদ্বেষের বিপরীতে

রাহুল গান্ধী তাঁর পদযাত্রায় অনেকটাই পথ পেরিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, কোথাও তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘৃণা বা বিদ্বেষ দেখতে পাননি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ ০৪:৩৩
Share:

ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল গান্ধী। ফাইল ছবি।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারত জোড়ার প্রথম শর্ত’ (৩-১) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বলি, কংগ্রেসের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি রাহুল গান্ধীকে সাধুবাদ না জানানোর কারণ নেই। তিনি আদ্যন্ত এক জন রাজনৈতিক নেতা। তাঁর এই পদযাত্রার পরিকল্পনায় রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের দিকটিই মুখ্য। তবুও দেশ জুড়ে বিদ্বেষ ওস্কানোর চেষ্টাকে দমন করে এক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে এটিকে গ্রহণ করা যেতেই পারে।

Advertisement

সংবিধান অনুযায়ী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও, এখানে প্রতি দিন সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়ার পরিকল্পনা চলে অন্তরালে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলির চেয়ে জাতপাত গুরুত্ব পায় বেশি। এমনিতেই ভোগবাদের ফলে দেশ জুড়ে একান্নবর্তী পরিবারগুলি বিপন্ন, অণু পরিবারের সন্তানদের কাছ থেকে সৌভ্রাতৃত্বের আশা করা বাতুলতামাত্র। তারাই কিন্তু আজকের সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর বাইরে রাজনীতির কারবারিরা যাঁদের উপর ভরসা রাখেন, সেই শ্রমজীবীদের ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে রাজনৈতিক কারবার চলে রমরম করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রধান লড়াইটা জাতের নয়, ভাতের জন্য।

রাহুল গান্ধী তাঁর পদযাত্রায় অনেকটাই পথ পেরিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, কোথাও তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘৃণা বা বিদ্বেষ দেখতে পাননি। সাম্প্রতিক অতীতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনাগুলি হয়তো তিনি ইচ্ছা করে এড়িয়ে গিয়েছেন। শান্তির বাণী দেশ জুড়ে প্রচার করার যে ব্রত এক সময় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিয়েছিলেন, তা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের স্মরণে থাকবে। সেই পথ ধরেই রাহুল গান্ধীর এই যাত্রা যদি সফল হয়, তা হলে ধর্মের কারবারিরা নিশ্চিত ভাবেই আশাহত হবেন।

Advertisement

তবে প্রবন্ধকারের সঙ্গে একটি বিষয়ে আমি একমত। আপাতদৃষ্টিতে সব কিছু ঠিকঠাক মনে হলেও বাস্তবে সংখ্যালঘুদের প্রতি সংখ্যাগুরুদের একাংশের (সম্ভবত তারাই সংখ্যায় বেশি) মনোভাব, “ওদের বাড়াবাড়ি কিছুতেই সহ্য হয় না!” এখানে ‘নরম হিন্দুত্ব’ আর ‘উগ্র হিন্দুত্ব’-এর একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা চলে প্রতি দিন। প্রকৃতপক্ষে, ‘নরম’ ও ‘উগ্র’ বলে আদৌ কিছু হয় না। উগ্র হিন্দুত্বের প্রবল আস্ফালন আজ দেশ জুড়ে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশের পরিপন্থী। তাকে ‘নরম হিন্দুত্ব’ দিয়ে নয়, বরং প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি দিয়েই রুখে দিতে হবে।

রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

অনন্য নজির

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারত জোড়ার প্রথম শর্ত’ শীর্ষক প্রবন্ধে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রার সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে এক দিকে লিখছেন, রাহুল গান্ধী এই মুহূর্তের সঙ্কটের গভীরতা নিয়ে কত সচেতন, সে বিষয়ে যেমন উনি সন্দিহান, তেমনই লেখার উপসংহারে এসে বলেছেন, শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ের প্রশ্নে রাহুল গান্ধীর দলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও তিনি নিশ্চিত নন। অনিশ্চয়তা থেকে বিচ্ছিন্নতা ও বিচ্ছিন্নতার সুযোগে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর মধ্যে ঘৃণার বাতাবরণ সৃষ্টি করে মূল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার যে রাজনীতি, রাহুল গান্ধী তা কতটা অনুধাবন করতে পেরেছেন, সে বিষয়েও লেখক সন্দিহান।

অনিশ্চয়তার মূল কারণ কেবল কর্মহীনতা, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি ও পুঁজির কেন্দ্রীকরণ, এবং সেই পটভূমিকায় সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, এটুকু বললে সবটা বলা হয় না। বিশ্বায়ন যে ভোগবাদের জন্ম দিয়েছে, তার ফলে মানুষ ক্রমশ পণ্যমুখী এবং সংগঠনবিমুখ হয়ে উঠেছে। তাই বাড়ির বাইরে জঞ্জাল পরিষ্কার না হলে আমরা গাড়ির কাচ তুলে দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পেতে চাই। কারণ, পুর কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে দরবার করার মতো সময় নেই। এই আন্দোলন-বিমুখতার সুযোগে গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অপহৃত হচ্ছে।

রাহুল গান্ধী সমস্যার গভীরে যেতে পেরেছেন বলেই ভারত জোড়ো যাত্রায় স্লোগান তুলেছেন, ‘নফরত ছোড়ো, ভারত জোড়ো’। কারণ, নফরত দূর করতে না পারলে, বিচ্ছিন্নতা কাটানো যাবে না, আর বিচ্ছিন্নতা অপসারিত না করতে পারলে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই অধরা থেকে যাবে। ২৬ নভেম্বর মধ্যপ্রদেশের মউয়ের জনসভায় দাঁড়িয়ে যখন বলছেন, “আমার ঠাকুমা ঘৃণার বলি, আমার বাবা ঘৃণার বলি, তবু আমি ঘৃণার কথা নয়, ভালবাসার কথা বলতে এসেছি, আমি দু’হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছি, দেখো, আমার চেহারায় কোনও ক্লান্তির ছাপ আছে কি?” যখন আমজনতার কাছে মূল্যবৃদ্ধি, নজিরবিহীন বেকারত্ব, শাসকের প্রশ্রয়ে কতিপয় পরিবারের হাতে পুঁজির পুঞ্জীভূত হওয়ার উদাহরণ তুলে ধরে শ্রমজীবী মানুষের লড়াইকে গতিশীল করে তুলতে চাইছেন, তখন শ্লেষের সঙ্গে ‘মঞ্চরূপেণ সংস্থিত’, ‘পুষ্পের হাসি’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করে কেবল তাঁর প্রয়াসকে অপমান করা হচ্ছে না, পরোক্ষে স্বৈরাচারী শাসকের হাতকেই শক্ত করা হচ্ছে।

যখন এই চিঠি লিখছি, তখন রাহুল গান্ধীর তিন হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করা হয়ে গিয়েছে। আধুনিক ভারতে গান্ধী ১৯৩০ সালে হেঁটেছিলেন ২৪০ মাইল পথ (ডান্ডি যাত্রা)। ১৯৮৩-তে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর কন্যাকুমারী থেকে দিল্লি পর্যন্ত এসেছিলেন, তিনিও শ্রীনগর অবধি যাননি। রাহুল গান্ধী সবাইকে ছাপিয়ে এক নজির সৃষ্টি করলেন, তাঁকে নিয়ে তাচ্ছিল্যের ভাষা প্রয়োগ পাঠকের কাছে অনৈতিক বলেই মনে হয়।

কে বলল আমরা “বিপন্নতার গহ্বরে সেঁধিয়ে যাচ্ছি...?” ২০১৯ সালে হিন্দুত্বের স্লোগান ৬৩ শতাংশ মানুষ উপেক্ষা করেছে, ৯৫ শতাংশ হিন্দু অধ্যুষিত রাজ্য হিমাচলে শাসক দল পরাজিত হয়েছে। “আজকের ভারতে এক নম্বর বিভাজন রেখাটি অবশ্যই ধর্ম পরিচয়ের” লেখকের এই মন্তব্যের সঙ্গে সহমত হলেও বলি, ধর্মই কি এ দেশের রাজনীতির অভিমুখ নির্ধারিত হওয়ার একমাত্র নির্ণায়ক শক্তি? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে চল্লিশ হাজার মরাঠির মৃত্যু হলেও, কোনও জাঠ বা রাজপুত হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও মরাঠিদের পাশে সে দিন দাঁড়ায়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন সিপাহি বিদ্রোহ দমন করছে, তখন তার তিন লক্ষ সেনার ভিতর কেবল ২৬ হাজার গোরা সৈন্য, দু’লক্ষ চুয়াত্তর হাজার দেশি সেনা যখন কোম্পানির হয়ে লড়ছে, তাদের এক বারও মনে হয়নি যে, তারা বিদেশি এবং বিধর্মী শক্তির হয়ে সম-ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে লড়ছে।

আবার মিরাট থেকে ১০ মে মূলত যে হিন্দু দেশীয় সেনারা বিদ্রোহ করে চার দিনের মাথায় দিল্লি দখল করেছিল, তাদের এক বারও মনে হয়নি, আমরা হিন্দু হয়ে এক জন ক্ষমতাচ্যুত মুসলিম বাদশা (বাহাদুর শাহ জাফর)-কে কেন আবার মসনদে বসাচ্ছি! রাহুল গান্ধী তাঁর সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এই সমন্বয়ের ভারতটাকে দেখেছেন বলেই তিনি বলেছেন, “আমি কোথাও ঘৃণার বাতাবরণ দেখিনি।”

এ দেশের মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ চায়নি, স্বাধীনতার শর্ত হিসাবে দেশভাগ তাদের মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ ভাগ তারা কেবল লড়াই করে নয়, আত্মাহুতি দিয়ে আদায় করেছে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন এ দেশের মানুষের আন্দোলনের ফসল। তাই মানুষ কী চায়, আর তাকে দিয়ে কী চাওয়ানো হয়, তার তফাতটা তুলে ধরতে ও মেকি ধর্মানুগত্যের মুখোশটা ছিঁড়ে ফেলার প্রচেষ্টাতেই ভারত জোড়ো যাত্রা।

রাহুল গান্ধীর দল যদি দেশের মানুষকে কাজের অধিকার দিতে পারে, বনাঞ্চলের মানুষকে যদি জল জঙ্গল ও জমির অধিকার দিতে পারে, শিক্ষাকে যদি মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে পারে, খাদ্য সুরক্ষার আইনি অধিকার নিশ্চিত করে থাকতে পারে, তা হলে যেখানে ‘পুঁজির বলয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের জীবনটাকে নিজেদের হাতের মুঠোয় আর একটু দৃঢ় করে বাঁচার চেষ্টা করছেন’, সেখানে রাহুল গান্ধীর দল তাঁর পাশে দাঁড়াতে পারবে না কেন? বিহার একটা পথ দেখিয়েছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সার্বিক ঐক্য, যেখানে রাহুল গান্ধীর দল ও দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই লড়ছে।

দেবপ্রসাদ রায়, কলকাতা-১৪

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement