ফাইল চিত্র।
শোভনলাল দত্তগুপ্তের ‘ভুল হয়ে যাচ্ছে বিলকুল’ (২১-৩) প্রবন্ধটি শুধুমাত্র সুখপাঠ্য নয়, প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে পড়ার মতো লেখাও বটে। প্রাচ্যের জ্ঞানসম্পদ এবং দেশজ জ্ঞানচর্চার সুসমন্বয় ঘটাতে না পারলে আগামী দিনেও আমাদের মাসুল গুনতে হবে— প্রবন্ধকারের এই চেতাবনি গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রবন্ধের একটি বাক্য পড়ে রীতিমতো হোঁচট খেতে হয়— “বঙ্কিমচন্দ্রকে একটিমাত্র উপন্যাস অর্থাৎ আনন্দমঠ-এর ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করা হয় তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকীর্তি থেকে।” এ কথা বললে তো আনন্দমঠ-এর বঙ্কিমকে মুসলিম-বিদ্বেষী বলে দাগিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা, তা সামনে এসে যায়। এ কথা ঠিক, এ উপন্যাসে এমন কথা আছে যা পড়ে পাঠকের মনে হতেই পারে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন মুসলমান-বিদ্বেষী। কমিউনিস্ট বলে খ্যাত লেখক, বুদ্ধিজীবী গোপাল হালদারও যখন বঙ্কিমকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদী বলতে কসুর করেননি, সাধারণ পাঠকের ভুল হওয়ার অবকাশ তো থাকেই। এই ভুলের নিষ্পত্তি কেমন করে ঘটবে? প্রসঙ্গত, শব্দার্থ নিরূপণের ক্ষেত্রে অভিপ্রায় ভেদের কথাটা এসে যায়। বঙ্কিমের মূল্যায়নে হিন্দু, হিন্দুত্ব, ধর্ম, হিন্দুধর্ম ইত্যাকার শব্দগুলো যে অর্থবিভ্রাট ঘটিয়েছে, বা বলা যায় যে জট পাকিয়েছে, আজও তা থেকে আমাদের নিষ্কৃতি মিলছে না। ‘হিন্দু’ বা ‘ধর্ম’, দু’টি শব্দই নানার্থবোধক। গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ— সকলেই এ শব্দদ্বয়ের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা শুনিয়েছেন। বঙ্কিমও ধর্মতত্ত্ব, হিন্দুধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে গম্ভীর প্রবন্ধ লিখেছেন। তাতে আছে: “...মনুতে যাহা কিছু আছে, তাহাই যে ধর্ম নহে, ইহা এক উদাহরণেই সিদ্ধ হইতেছে। এ সকলকে যদি ধর্ম বলা যায়, তবে সে ধর্ম শব্দের অপব্যবহার।”
যিনি “যবন ও ম্লেচ্ছের সঙ্গে একত্র ভোজনে কোনও আপত্তি করেন না” তেমন আচারভ্রষ্ট ধার্মিক ব্যক্তিকেও বঙ্কিম হিন্দু বলে সম্বোধন করেছেন। এ-হেন লেখককে কি মুসলিম-বিদ্বেষী বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়? বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন জ্ঞানান্বেষণে প্রবৃত্ত এক দুর্ধর্ষ লেখক। তাঁর মতে, চিত্তশুদ্ধিই ধর্ম। কাজেই তাঁর অনুশীলনতত্ত্বকে না বুঝে তাঁর হিন্দুত্ববাদকে বোঝা সম্ভব নয়। ২০১২ সালে চটি বই (যে ভাবে বঙ্কিম পড়ি) লিখেছিলেন তপোব্রত ঘোষ। তাঁর লেখায় পড়ি, “...আনন্দমঠ-এ যদি অত্যাচারী মুসলিম শাসকদের প্রতি বিদ্বেষ ক্রমে ক্রমে মুসলিম বিদ্বেষের দিকে গড়িয়ে গিয়েও থাকে, তবু সেই মুসলিমবিদ্বেষের সঙ্গে বঙ্কিমের নিজের কোনো সহমর্মিতা ছিল না।” সম্ভবত এই বইটি প্রবন্ধকারের নজর এড়িয়ে গিয়েছে।
শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪
চিকিৎসক
শোভনলাল দত্তগুপ্ত আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, “নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রোথিত হবে ভারতবর্ষের দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীরে— সেখানেই লুকিয়ে আছে হিন্দুত্বের রাজনীতি, যেখানে ভারতীয়ত্ব এবং হিন্দুত্ব সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।” এখানেই প্রশ্ন, কেন এমন হচ্ছে? স্বাধীনতা-উত্তর শিক্ষাব্যবস্থায় আজও ঔপনিবেশিক শিক্ষার রেশ রয়ে গিয়েছে। ফলে প্রাচীন ভারতের সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞান চর্চা সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হয়নি। সত্যিই কি প্রগতিবাদী শিক্ষাবিদদের একটা বড় অংশ বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, অরবিন্দ, গান্ধীর মতো মানুষকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপে ব্রাত্য করে রেখেছিলেন? এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধ সঙ্কলনের (আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে, ২০১৫) একটি অধ্যায়ে (বঙ্কিম-গরিমার উত্তরাধিকার) লিখেছিলেন, “সবাই জানি বঙ্কিমবাবুর ইচ্ছা ছিল ঝান্সীর রানীর প্রদীপ্ত জীবন অবলম্বনে লিখবেন। কিন্তু ইংরেজের চাকরির অভিশাপ মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন বলে মনের ইচ্ছা মনেই চেপে রাখলেন। কি যন্ত্রণাই পেতে হয়েছিল আনন্দমঠ (১৮৮২) প্রকাশের পর। সাহেবরা যাতে প্রচণ্ড খেপে না যায় সেজন্য বইটি ইংরেজদের বিপক্ষে লেখা হয়নি তার সাফাই গাওয়াতে হয় সমালোচকদের দিয়ে আর প্রথম সংস্করণকে রীতিমতো বদলাতে হয়— যেখানে ইংরেজ, গোরা ইত্যাদি শব্দ শিল্পগত যুক্তি ছাড়াই বদলে করতে হল যবন আর মুসলমান।” অন্য দিকে, আনন্দমঠ উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে যুদ্ধ যখন শেষ, তখন এক জন চিকিৎসকের আবির্ভাব ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে দিয়ে বলান, “এখন এদেশে অনেক দিন হইতে বহির্ব্বিষয়ক জ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে— কাজেই প্রকৃত সনাতনধর্ম্মও লোপ পাইয়াছে। সনাতনধর্ম্মের পুনরুদ্ধার করিতে গেলে, আগে বহির্ব্বিষয়ক জ্ঞানের প্রচার করা আবশ্যক।... ইংরেজ বহির্ব্বিষয়ক জ্ঞানে অতি সুপণ্ডিত, লোকশিক্ষায় বড় সুপটু। সুতরাং ইংরেজকে রাজা করিব।”
২০০৮ সালে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রাজেশ কোছার একটি নিবন্ধে (‘কাল্টিভেশন অব সায়েন্স ইন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল’, ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজ়িক্স, ৮২-৮, পৃ ১০২১) এই মূল্যায়ন করেন যে, আনন্দমঠ উপন্যাসে উল্লিখিত ‘চিকিৎসক’ হলেন সম্ভবত ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার, যিনি চাইতেন যে, দেশের মানুষকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বিজ্ঞানের আঙিনায় মানুষকে নিয়ে যেতে হলে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি এবং ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন-এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এই নিবন্ধে এটা সুস্পষ্ট যে, বঙ্কিমচন্দ্র মহেন্দ্রলাল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর উন্নতিকল্পে ৫০০ টাকা দানও করেছিলেন। তাই মনে হয় আনন্দমঠ-এ বঙ্কিমচন্দ্র হঠাৎ করে চিকিৎসককে নিয়ে আসেননি, হয়তো মহেন্দ্রলালের আধুনিক চিন্তা এবং পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতি অনুরাগ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল।
শ্যামল ভদ্র, কলকাতা-৬৮
দায়ী বাম
বিজ্ঞানবাদী, উদারপন্থী বামেরা কী ভাবে রক্ষণশীল চিন্তাধারার ফাঁদে পা দিচ্ছেন, শোভনলাল দত্তগুপ্ত তা দেখিয়েছেন। এ দেশের সংস্কৃতি ও চিন্তানায়কদের প্রতি বামপন্থীদের অজ্ঞানতাই তাঁদের সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। অরবিন্দ, বিবেকানন্দ, গান্ধী বা বঙ্কিমচন্দ্রের মতো চিন্তানায়কদের ব্যবহার করার কর্মকৌশল জানা নেই বামপন্থী বা কংগ্রেসের নেতাদের। জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, বামপন্থীরা এ দেশের রাজনৈতিক দল হলেও তাঁদের কাজের আদর্শ বিদেশি। কিন্তু নিজের দলের দুর্বলতা তিনি দূর করতে পারেননি। বামপন্থীরা দেশের সতেরোটি সাধারণ নির্বাচনের কোনওটিতে ১০ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। তাঁদের সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে এ দেশের উদারবাদী, বিজ্ঞানবাদী শিক্ষার প্রয়োজনের অনুভব। জাতীয় শিক্ষানীতিতে যদি কুসংস্কার আর ভ্রান্ত চিন্তা স্থান পায়, তার জন্য কংগ্রেস আর বামপন্থীরাই দায়ী।
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-২৬
ঠিক পথ
নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত করার একটি সচেতন প্রয়াস আছে। সে জন্য অতীত ভারতের সব কিছুকেই যদি নির্বিচারে শ্রেষ্ঠ ভেবে নেওয়া হয়, তবে তা ভ্রান্তির সৃষ্টি করবে। আবার ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ের বাইরে কিছু নেই, এমন সিদ্ধান্তও সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার শামিল। প্রয়োজন নিরপেক্ষ বিনির্মাণ, যাতে বিদ্যাচর্চা একটি যুক্তিনির্ভর পথে চলতে পারে।
সুদীপ্ত দেবরায়, শিলচর, অসম