—ফাইল চিত্র।
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘ফাঁকা মাঠে খেলা হবে’ (২১-১২) প্রবন্ধটি সময়োপযোগী এবং তথ্যবহুল। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকা এবং সক্রিয় বিরোধিতা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, শাসককে সঠিক পথ দেখাতেও সাহায্য করে। শাসকের কাছে বিরোধীরা নিন্দক; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘তোতাকাহিনী’-তে নিন্দকের ভূমিকা যে কতখানি, তা পাঠকের গোচরে এনেছেন। সপ্তদশ লোকসভার শেষ অধিবেশন চলাকালীন সংসদ ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ প্রমাণ করে দুই যুবকের ঢুকে পড়ার ঘটনায় সকলেই স্তম্ভিত। আর এই নিয়েই শোরগোল শুরু হয়েছিল। তাতে বিরোধীরা একযোগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন, তাঁর পদত্যাগ নয়।
ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া, নিরাপত্তা ব্যবস্থার খামতি দূর করা— এ দাবি সংসদীয় রীতি। আর তাতেই বিপর্যয় ঘটল। লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে প্রায় দেড়শো সদস্যকে সাসপেন্ড করা হল। এ-ও সংসদের এক কালো দিন। বিরোধীরা কোনও প্রতিবাদ করতে পারবেন না, এটা মেনে নেওয়া গণতন্ত্রের পক্ষে সঠিক বার্তা নয়। মোদী সরকার এর মধ্যে বিরোধীদের ষড়যন্ত্র খুঁজছেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৩০০-র বেশি আসন পাওয়ার পর সপ্তদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোদীজি বলেছিলেন, “আমি আশা করব, বিরোধীরা সরব হবেন। সংসদে সক্রিয় হবেন।” কিন্তু তাঁর দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি, সেই নমনীয়তা কোথায়? এ তো হিটলারি কায়দায় পেশিশক্তির প্রতিফলন। হিটলারের মতো বিরোধীদের গ্রেফতার করেননি— এটাই যেন তাঁদের ভাগ্য। মোদী সরকার বিরোধীদের অন্ধকারে রেখে কার্যসিদ্ধিতে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু লক্ষণীয়, বিরোধীদের আনা উপরোক্ত নানান প্রশ্নের সদুত্তর দিতে সরকার নারাজ। কারণ, লোকসভায় তাঁদের সদস্যদের সংখ্যাতত্ত্ব। যেন বিরোধীদের প্রয়োজন নেই। দেখে মনে পড়ে যায় সেই প্রবাদবাক্য— যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।
অতীত ভুললে চলবে না, ইউপিএ সরকারের সময় বিজেপি বিরোধী শিবিরে অবস্থান করত। সেই সময় সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৩-২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত তাঁরাই বার বার সংসদ অধিবেশন অচল করে দিয়েছেন। কিন্তু আজকের মতো সে দিন সাংসদদের দলে দলে সাসপেন্ড করা হয়নি। এখন ফাঁকা ময়দান, বিরোধীমুক্ত সংসদ। ইচ্ছেমতো হাত-পা ছড়িয়ে বসা। বিল পাশ করানোর এই তো সুযোগ!
কিন্তু প্রবন্ধকার এক বারের জন্যও আলোর দিশা খোঁজেননি। ভাবতে হবে, একটা সরকারের সবটাই খারাপ হতে পারে না; তার কিছু কিছু ভাল দিকও থাকে— তিনি হিটলার হলেও থাকে। যেমন, জিএসটি নীতি, ডিজিটাল ভারত, এক দেশ এক আইন, স্বচ্ছ ভারত— দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, যে কোনও দেশেই কোনও একটি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে এবং শাসক দলের নেতৃত্বে কোনও দোর্দণ্ডপ্রতাপ ও প্রবল জনপ্রিয় নেতা থাকলে সংসদ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এই তথ্য মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগ নয়।
তবে লক্ষ করার বিষয়, আজ গণতন্ত্র সর্বত্র বিঘ্নিত। যে কোনও অঙ্গরাজ্যের দিকে আঙুল তোলা যায়। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা কি সত্যিই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করছেন? আজ এ দেশের অঙ্গরাজ্যগুলি নানা দুর্নীতিতে ভরা। শঙ্খ ঘোষের ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ আমরা তো ভুলে যাইনি। তবুও তার মধ্যে রাজ্যগুলির কিছু কিছু ইতিবাচক কাজকর্ম পরিলক্ষিত হয়। ‘জোর যার, মুলুক তার’ সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই আছে। তাও আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
অগণতান্ত্রিক
“‘পৌঁছ’-সংবাদ” (২২-১২) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। বিরলতম উদাহরণ সৃষ্টি করে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সংসদ রাজ্যসভা ও লোকসভা মিলিয়ে প্রায় দেড়শো সদস্যকে সাসপেন্ড করেছে। অবশ্যই তাঁরা বিরোধী দলীয় সদস্য, এবং সকলেই সংসদকে কাজ করতে না দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। গণতন্ত্রের স্বার্থে এই কাজ কতটা নৈতিক কিংবা অনৈতিক, তা বিচারের ভার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তার চেয়ে বরং বেশি জরুরি হল, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার আগামী দিনে সংসদ পরিচালনার জন্য কেমন সংসদের প্রত্যাশী— সেটা পর্যালোচনা করে দেখা। ‘এক দেশ এক আইন’— এই স্লোগানকে মান্যতা দিয়েই এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং ধীরে ধীরে তাদের লক্ষ্যে অবিচল থেকে আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
বিরোধীদের এটাই ব্যর্থতা যে, তাঁরা কখনও সঙ্ঘবদ্ধ ঐকমত্যে পৌঁছে বিজেপির প্রতিপক্ষ হিসাবে উঠে আসতে পারেননি। ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি আসলে সোনার পাথরবাটি। তাই ক্ষমতায় আসার পর সব শাসকের একটাই উদ্দেশ্য হয়, গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নির্দেশিত গণতান্ত্রিক ছকে শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠলে পুঁজিপতি ও পুঁজিবাজার যে মুখ থুবড়ে পড়বে, তা বিলক্ষণ জানে শাসক দল। দেশে দেশে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে গণতন্ত্রের মলমলটিকে সামনে রেখে দলতন্ত্র-একনায়কতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র ইত্যাদি নামধারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
খুবই ন্যায্য একটি দাবি তুলেছিলেন বিরোধী সদস্যরা। তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেছিলেন। বিবৃতি না দিয়ে কেন বিরোধী সদস্যদের সাসপেন্ড করার ঝুঁকি নেওয়া হল?
সমগ্র ভারতের নিবদ্ধীকৃত ভোটদাতাদের মাত্র তেত্রিশ শতাংশের সমর্থন নিয়ে বাকি সাতষট্টি শতাংশের ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা হয়ে ওঠার কৌশল এক দিনে আয়ত্ত হয়নি। এর জন্য অনেকটা পথ দৃঢ়তার সঙ্গেই পেরিয়ে এসেছে বিজেপি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর এই পর্যন্ত সময়কালে একটাও সাংবাদিক সম্মেলন না করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, এটাই স্বাভাবিক হতে চলেছে আগামী দিনে ভারতীয় শাসনকাঠামোয়।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর অগ্রজের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন মাত্র।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
নজরদারি
স্বাগতম দাস ২০২৩ সালকে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বছর’ (২২-১২) চিহ্নিত করে চেয়েছেন, ভারতের সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ চ্যাটবট তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে ভারত নিজেদের ‘ফাউন্ডেশন মডেল’-এ স্বাবলম্বী হওয়ার দিকে এগোক। এটি সমর্থন করি। কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতির ক্রমাগত বেসরকারিকরণের মডেল ও অসরকারি ফাইনান্স পুঁজির সাঙাততন্ত্রের কথা ভেবে এই দাবি অন্য ভাবে ভাবতে অনুরোধ করি।
দুর্বলতা আর ঝুঁকি কোথায়? প্রবন্ধকারের মতে, স্টার্ট আপে বিশাল পুঁজির অভাব এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জাতীয়তাবিরোধী অপব্যবহার ও অপরাধ জগতে ব্যবহার। এবং জাতীয়তাবিরোধী অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে গণতন্ত্রে বিরুদ্ধ স্বর নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যবস্থার অপব্যবহার। তাঁর পরামর্শ, কোন তথ্য ব্যবহৃত হচ্ছে, নজর রাখা জরুরি। ঘুরিয়ে বলা যায়, সরকারি নজরদারির গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? ‘পেগাসাস’ বৃত্তান্ত সবাই জানে। আমজনতার থেকে আহরিত তথ্যভান্ডারকে সুরক্ষিত করার পথে অনেকটা হাঁটতে হবে। কিন্তু আগ্রাসী বেসরকারিকরণের যুগে এই তথ্যভান্ডার সরকারের নিয়ন্ত্রণে কত দূর আছে? অভিযোগ উঠছে সরকারি পুঁজির গোপন নিয়ন্ত্রণ, স্বার্থপর বদান্যতা বা আগ্রাসী প্রয়োগে অসরকারি পুঁজির বিশেষ কিছু উদ্যোগের ফুলে-ফেঁপে ওঠার। এতে দেশ ও দশের উন্নতি অধরা থেকে গেছে। অর্থাৎ, ব্যক্তি মূল্যবোধ ও সততার অভাবের সাধারণীকরণ হলে সরকারি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সরকারি ব্যবস্থাও শেষ কথা নয়।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, ফটকগোড়া, হুগলি