—ফাইল চিত্র।
বাঙালিকে ইতিহাসবিস্মৃত আর আত্মঘাতী বলা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের। এই আবহে শিল্পী কলিম শরাফীর জন্মশতবর্ষে শিশির রায় তাঁর ‘বড় বেদনার মতো’ (৭-৭) প্রবন্ধ লিখে আমাদের সম্মান রক্ষা করেছেন। বর্তমান সময়ে কলিম শরাফীর নাম শুনেছেন, বা তাঁর গানের সঙ্গে পরিচিত এমন মানুষ কত, বলা কঠিন। বাংলা সঙ্গীত ও সংস্কৃতি জগতে কলিম শরাফী যে এক বিশেষ নাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আক্ষেপের বিষয়, বীরভূমে জন্ম নিলেও এই বঙ্গসন্তানকে এ দেশে রাখা যায়নি। যেমন রাখা যায়নি আব্বাসউদ্দীন আহমদকে। বিশ্বযুদ্ধ, তৎকালীন সামাজিক নেতৃত্বের দুর্বলতা আর অভ্যন্তরীণ ভুল বোঝাবুঝি যে সামাজিক সঙ্কট বাড়িয়ে তুলছিল, তারই এক বৃহত্তম রূপ দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা আর দেশভাগ।
ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ তখন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী শিল্পীর ও শিল্পের সম্ভাবনাময়তা, উদার মানবিকতা এবং প্রতিবাদী স্বরকে এক জায়গায় এনে নানা রকম শিল্পচর্চার মাধ্যমে পথে নেমে দুরবস্থার প্রতিরোধে আগুয়ান হয়। সেই দলে ছিলেন বাংলার বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, সলিল চৌধুরী, সুচিত্রা মিত্র, খালেদ চৌধুরী, সুধী প্রধান, আরও অনেকে। প্রগতিশীল সংস্কৃতির অভিঘাত পৌঁছয় তৎকালীন বম্বেতেও। ছুঁয়ে যায় ঋত্বিক ঘটক, বিমল রায়, এ কে হাঙ্গল, রাজ কপূর, কে এ আব্বাস, বলরাজ সাহনি প্রমুখকেও। কয়েকটি ছবিও এই অনুপ্রেরণায় নির্মিত হয়— জাগতে রহো, দো বিঘা জমিন, সমাজ কো বদল ডালো প্রভৃতি।
কলিম শরাফী তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে গণসঙ্গীত এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে সকলকে মুগ্ধ করেন। শাঁওলী মিত্রের এক লেখা থেকে জানা যায়, শম্ভু মিত্র বিশেষ ভাবে কলিম শরাফীর রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করতেন। তিনি এখানে ‘বহুরূপী’-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে এক আশ্চর্য সময়। তাঁর গান যত দূর জানা যায় বাংলাদেশে ভারতের দেবব্রত বিশ্বাসের মতোই সমাদৃত ও জনপ্রিয়। যখন বাংলা ভাষা ও বাংলার লেখক কবির চিহ্ন মুছে দিতে বদ্ধপরিকর, সেই সময় ওয়াহিদুল হক এবং কলিম শরাফী ঢাকায় পঁচিশে বৈশাখে অনুষ্ঠান করার মতো সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন।
সঙ্কীর্ণতার বিভেদরেখা মুছে দেওয়ার লড়াইয়ে যিনি ছিলেন অন্যতম পদাতিক, তাঁর অবদান বিস্মৃত হলে বাঙালি জাতির গৌরব বৃদ্ধি পায় না।
প্রতিমা মণিমালা, হাওড়া
উদ্বাস্তুর পরিচয়
‘রাষ্ট্রহীন, অ-নাগরিক’ (১-৬) শীর্ষক হর্ষ মান্দারের প্রবন্ধটি প্রণিধানযোগ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় নিপীড়নের দিক যেমন তিনি তুলে ধরেছেন, তেমনই এ দেশে সিএএ, এনআরসি, এনপিআর-এর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি যথার্থই হিটলারের জার্মানির ‘নুরেমবার্গ’ আইনের সঙ্গে তুলনা টেনেছেন। সেখানে যেমন এই আইনবলে ভিন্ন ধর্মে বিয়েকে ‘বেআইনি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, জার্মান ইহুদিদের নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, এবং ভিন্ন ধর্মে বিয়ে ও যৌনতা অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল, এখানেও তেমনই নানা ধরনের আইন প্রণয়ন করে মুসলমান নাগরিকদের সম-নাগরিকত্বের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি ঠিকই উল্লেখ করেছেন যে, এর ফলে সে দিন জার্মানির ইহুদিরা হয়ে যান রাষ্ট্রহীন, অ-নাগরিক। ইহুদি ও জার্মানির মধ্যে বিয়ে ও যৌনতা ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ। এখানেও নুরেমবার্গের কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। প্রবন্ধকার এর থেকে উদ্ভূত বিপজ্জনক এবং চূড়ান্ত অমানবিক দিকটি তুলে ধরে সময়োচিত সতর্কতার আহ্বান জানিয়ে জরুরি প্রয়োজন পূরণ করেছেন।
তবে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের সবচেয়ে ট্র্যাজিক যে উদ্বাস্তু সমস্যা, এই আলোচনায় তার উপর যথেষ্ট আলোকপাত করা হয়নি বলে মনে হয়েছে। অথচ, এই সমস্যাটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্যক উপলব্ধি করতে না পারলে সমসাময়িক ঘটনাবলি এবং তা থেকে উদ্ভূত সমস্যার সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। প্রায় দেড়শো বছরব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন কোনও হিন্দু রাষ্ট্র বা মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য হয়নি। জাত, ধর্ম, ভাষার ঊর্ধ্বে উঠে সকল জনগণের একটি সার্থক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। এই মহান লক্ষ্যের বুকে ছুরি মেরে ধর্মের ভিত্তিতে দু’টি রাষ্ট্র— পাকিস্তান এবং ভারতের জন্ম দিল। ভারত নিজেকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেনি। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সব হিন্দু ভারতে প্রবেশ করলেন, তাঁদের সে দিন বলা হয়েছে উদ্বাস্তু, একই ভাবে যে সব মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানে গেলেন, তাঁদেরকেও বলা হল ‘মুহাজির’, অর্থাৎ শরণার্থী। নেহরু-লিয়াকত চুক্তির পর তাঁদের একটা অংশ ভারতে ফিরে এলেও লাখ লাখ মুসলিম মুহাজিররা উভয় পাকিস্তানে স্থায়ী ভাবে বসতি স্থাপন করেছেন। পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত পঞ্জাব এবং ভারত অন্তর্ভুক্ত পঞ্জাবে সে দিন কার্যত জন-বিনিময় হয়েছে। সেই অর্থে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা মুসলিম শরণার্থীর ধারণাটা সঠিক নয়। বিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক মাইগ্রেশন-এর ঘটনা সব দেশেই কম বেশি আছে। এটাকে মূল শরণার্থী সমস্যার সঙ্গে এক করে দেখা উচিত নয়। মুসলিম অনুপ্রবেশকারী তত্ত্ব বস্তুত আরএসএস-বিজেপির সাম্প্রদায়িক ধারণাপ্রসূত। উদ্বাস্তু সমস্যার মূলে নিহিত যে ভয়ঙ্কর ঘটনাবলি, সেগুলো উভয় দেশের মানুষকেই আবেগবিহ্বল করে তুলেছিল।
এই পরিস্থিতিতেই গান্ধীজি, নেহরু-পটেল প্রমুখ নেতা পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তানে যে হিন্দুরা থেকে গিয়েছিলেন, তাঁদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন যে, তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে ভারতের দরজা খোলা থাকবে। জাতির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সংসদেও এই আশ্বাস দিয়েছিলেন। এটা জাতীয় দায়বদ্ধতা বা জাতীয় প্রতিশ্রুতি হিসেবেই লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশে এখন যাঁরা শরণার্থী, তাঁদের নাগরিকত্বের অধিকার প্রশ্নাতীত। কিছু রাজ্যে কিছু মানুষ সাম্প্রদায়িক, প্রাদেশিকতাবাদী চিন্তার শিকার হয়ে এঁদের নাগরিকত্বের বিরোধিতা করছেন। এর বিহিত জরুরি।
জয়দেব চক্রবর্তী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
দেশের কাজ?
রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের আরএসএস সম্পর্কিত বক্তব্য সংসদের রেকর্ড থেকে যে ভাবে মুছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তথা উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়, তা রীতিমতো বিস্ময়কর (‘আরএসএসের বিরুদ্ধে খড়্গের অভিযোগ বাদ দিলেন ধনখড়’, ২-৭)। খড়্গে বলেন, আরএসএস আদতে সাম্প্রদায়িক, জাতিবাদী, মনুবাদী সংগঠন। এখন তার লোকেদের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হচ্ছে। ধনখড় বলেছেন, যে সংগঠনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, তা দেশের জন্য নিরলস পরিশ্রম করছে।
দেশের জন্য পরিশ্রম মানে তো ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে দেশের সমস্ত অধিবাসীর জন্য কাজ করা। আরএসএস সংগঠনটি তাই করে কি? আরএসএস-এর লক্ষ্য ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। এমন কাজের দ্বারা দেশের ঐক্য এবং সংহতিই বিঘ্নিত হয়ে চলেছে। ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-এর যে ভারতীয় ঐতিহ্য তা এই কার্যকলাপের দ্বারা নষ্ট হচ্ছে। একে কোনও ভাবেই দেশের জন্য কাজ বলা যায় কি? তাই এই সংগঠনের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মাথায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে বসালে যে তা দেশের অগ্রগতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করবে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। অতীতে আরএসএস নেতারা ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন বলতেই রাজি হননি, তা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। বিরোধী নেতার অভিযোগগুলি সংসদের রেকর্ড থেকে জোর করে মুছে দিলেও, ধনখড় কি ইতিহাস থেকে তা মুছে দিতে পারবেন?
সমর মিত্র, কলকাতা-১৩