Mrinal Sen

সম্পাদক সমীপেষু: নিরভিমান মন

মৃণালবাবুর ছবিগুলো তো সাধারণ মানুষের জীবন, ছোট ছোট সুখ, বড় বড় যন্ত্রণা ঘিরেই! আড্ডায় আমাকে ওড়িয়ায় অনায়াসে কথা বলতে দেখে তিনি আনন্দিত হন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৩ ০৫:৫৩
Share:

মৃণালবাবুর ছবিগুলো তো সাধারণ মানুষের জীবন, ছোট ছোট সুখ, বড় বড় যন্ত্রণা ঘিরেই! ফাইল ছবি।

‘আমরা দু’জন বন্ধু’ (রবিবাসরীয়, ১৪-৫) প্রবন্ধে কুণাল সেনের লেখা পড়ে মনে ভেসে উঠল পুরনো কয়েকটি স্মৃতি। প্রথম বার— ১৯৬৬ সালে ওড়িশার কটক শহরে। তখন সেখানে তিনি মাটির মনিষ ছবিটি করছেন, ওড়িয়া ছবির জগতে পরে যা এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। কটকে সেই সময় প্রথম একটি ঝাঁ-চকচকে রেস্তরাঁ খুলেছিল। কটকে চাকরি করতে যাওয়া আমরা ক’জন তরুণ, জড়ো হতাম সেই রেস্তরাঁয়। তার মালিক আবার এই ছবিটির প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এক দিন তিনিই মৃণাল সেনকে নিয়ে এলেন আড্ডায়। তখন সময়টাই এ রকম ছিল, বিখ্যাত মানুষেরাও সহজেই মিশে যেতেন সাধারণের মধ্যে— আর মৃণালবাবুর ছবিগুলো তো সাধারণ মানুষের জীবন, ছোট ছোট সুখ, বড় বড় যন্ত্রণা ঘিরেই! আড্ডায় আমাকে ওড়িয়ায় অনায়াসে কথা বলতে দেখে তিনি আনন্দিত হন। পর দিন মহানদীর ধারে আউটডোর শুটিং দেখতে আমন্ত্রণ জানান। কাজের চাপে তা অবশ্য যাওয়া হয়নি, তবে বলেছিলাম, ছবি মুক্তি পেলে হল-এ গিয়ে দেখবই। পরের সাক্ষাৎ কলকাতায়, ওঁর মৃগয়া ছবিটি যে দিন লাইটহাউস-এ মুক্তি পেল, সে দিন ইভনিং শো-এর আগে। ওঁকে কটকের সেই আড্ডা, মাটির মনিষ-এর কথা মনে করালাম। তবে দেখলাম উনি যারপরনাই আগ্রহী মৃগয়া নিয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়া জানতে, নিজেরই পুরনো ছবিটিকে ফেলে এসেছেন অতীতে। এও এক শিক্ষা। পরে আবার দেখা অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে। শুভেন্দুবাবুর দাদা সর্বাণীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক বিদেশি ওষুধ কোম্পানির ফিল্ড ম্যানেজার, ওঁর সঙ্গে হৃদ্যতা সূত্রেই সে দিন আমার ওই আড্ডায় যাওয়া। মৃণালবাবু আমাদের বলেছিলেন, তিনি নিজেও এক সময় ওষুধ কোম্পানির ব্যাগ বয়েছেন, তবে এক দেশি সংস্থার। এমন ভাবে বলেছিলেন, ওঁর নিরভিমান মনটি বুঝতে পেরেছিলাম। ওঁর ছবি দেখেও মনে হয়েছে, নিজের জীবনলব্ধ ছোট ছোট শিক্ষা, অভিজ্ঞতাই ওঁর ছবিতে বৃহতের জানলাগুলো খুলে দিত, জীবনের সঙ্গে শিল্পের সংযোগ ঘটাত।

Advertisement

রমাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, কলকাতা-২৬

Advertisement

চোখে পড়ল না

১৪ মে চলে গেল— মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষ। শুধু কলকাতা বা এ রাজ্য কেন, বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে থাকা সিনেমাপ্রেমী বাঙালির কাছেই এ দিনটি খুব গর্বের, বিশ্বমানের এই পরিচালক ও চিন্তকের জন্মদিন। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ পূর্তি বলেই দিনটি ছিল আরও নিবিড় ভাবে উদ্‌যাপনের। কলকাতায় থাকার সুবাদে দেখলাম, জানলামও— বহু চলচ্চিত্রচর্চা প্রতিষ্ঠান, সিনে সোসাইটি বা ক্লাব ‘মৃণাল সেন ১০০’ পালন করেছে নানা অনুষ্ঠানে। তাঁর অনেক ছবির প্রদর্শন হয়েছে, তাঁর ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলী-সহ বিশিষ্ট ফিল্ম-তাত্ত্বিক, সমালোচকেরা আলোচনা করেছেন ছবির ভাষা ও দর্শন নিয়ে। তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে, প্রথম সারির সব পত্রপত্রিকা লেখা প্রকাশ করেছে, বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজ়িন চোখে পড়েছে যাদের প্রধান উপজীব্য মৃণাল সেনের শতবর্ষ।

এই সবই আশা জোগায়, যোগ্য লোকের কদর বাঙালি ভোলেনি এখনও। আশার সঙ্গে আনন্দও হত, যদি রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এই শতবর্ষের উদ্‌যাপন অনুষ্ঠান হত বড় করে, আন্তরিকতার সঙ্গে। কিন্তু তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। মনে রাখা দরকার, ভারতের কোনও রাজ্যের তরফে হওয়া প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয় এই পশ্চিমবঙ্গেই, উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৯৫ সালের ৯ নভেম্বর। তখন নাম ছিল ‘ক্যালকাটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। উদ্বোধক ছিলেন মৃণাল সেন। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের পর বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র মৃণালবাবুর আশ্রয় ও দিগ্‌দর্শন পেয়েছিল। দীর্ঘ ইহজীবনে শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন তাঁর চার পাশের সময় ও সমাজ সম্পর্কে আগ্রহী, সচেতন। কাছের মানুষকে অনেক সময়েই চেনা যায় না, বিশ্বের দরবারে ভারতীয় ছবিকে যে মর্যাদায় তিনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন তাঁর মূল্যায়ন আমরা বাঙালিরা কতখানি করতে পেরেছি সন্দেহ। বর্তমান রাজ্য সরকার কি পারত না মৃণালবাবুর জন্মশতবর্ষের উদ্‌যাপনটি বড় করে, সকলকে সঙ্গে নিয়ে করতে? তাঁকে কাছ থেকে চিনতেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন এমন বহু চেনা-অচেনা মানুষ আমাদের চার পাশে রয়েছেন, তাঁদের মতামত ও পরামর্শ নিয়ে একটি উদ্যোগ হতেই পারত। নন্দনে ‘মৃণাল সেন চলচ্চিত্র উৎসব’ করা যেত, বিশেষ বিষয়ভিত্তিক আলোচনাচক্র করা যেত, তৈরি করা যেত মৃণালবাবুর উপর সরকারি উদ্যোগে কোনও প্রামাণ্যচিত্র। প্রকাশ করা যেত না কি একটি জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ বা পত্রিকা? ব্যক্তিগত বা অসরকারি উদ্যোগে মৃণাল সেন আর্কাইভ তৈরি হয়েছে, সমৃদ্ধও হচ্ছে প্রতি দিন— রাজ্য সরকার দায়িত্ব নিয়ে সেই অতি জরুরি কাজটিও কি করতে পারত না?

মঞ্জুশ্রী রায়, কলকাতা-৮৪

স্বাতন্ত্র্য

মৈনাক বিশ্বাসের ‘তর্কের মতো সিনেমা’ (১২-৫) মনে করিয়ে দিল মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে সোজাসুজি প্রতিবাদ। অধিকাংশ চলচ্চিত্রে প্রতিবাদের মুখ সাধারণ নাগরিক। এই নাগরিক প্রতিবাদে আঙ্গিক ছিল সৃজনশীল শিল্পধন্য, আর বিষয় ছিল বিত্ত ও শ্রেণিবৈষম্যের দ্বন্দ্বধন্য। এই দ্বন্দ্ব তৈরি করছে বহু প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্ন। মহানগর থেকে শহরতলি ক্ষয়িষ্ণু, স্বপ্নসন্ধানী নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, বিত্তশালী সবাই যে যার মতো তত্ত্ব, অনুশীলন, প্রজ্ঞার চর্চা করে চলেছেন। এর মধ্যে এক দল বেকার যুবক জীবিকার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে চলেছেন। আবার শিল্পে শ্রমিকের প্রতিবাদ এসেছে। কৃষিতে জমির লড়াই, তেভাগা আন্দোলনে প্রতিবাদের মুখ হয়েছেন জমিহারা চাষি, জমিহীন কৃষিমজুর। শহর, নগরে বুদ্ধিজীবী, মেধাজীবীদের তর্ক থেকে প্রতিবাদ, আন্দোলন উঠে আসছে। সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে শ্রমিকদের মধ্যে, ভাগচাষি, খেতমজুরদের মধ্যে। মৃণাল সেন নিজে সমসাময়িক ঘটনাবলির চরিত্রের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়েছেন। তাঁর প্রতিবাদের অস্ত্র তাঁর আঙ্গিক ও বিষয় নৈপুণ্যে চলচ্চিত্রায়ন। গোটা চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে তর্কের নবজাগরণের আখ্যান।

ঠিক এইখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য। তিনি দর্শকদের কোনও মোড়ক বা খোলস দিয়ে ব্যস্ত রাখতে চাননি, অন্তর্বস্তু খুলে ধরেছেন। তাঁর ছবিতে বেশ কিছু জায়গায় কোলাজ, মন্তাজের ব্যবহার করেছেন। দেওয়াল লিখন, পোস্টার, বই ইত্যাদি দেখিয়েছেন, যেগুলো চরিত্র হয়ে উঠেছে। বামফ্রন্ট সরকারের কাছের লোক মৃণাল সেন বাম আদর্শে বিশ্বাস রেখেও মন ভাল করা ‘ফিল গুড’ চলচ্চিত্র করেননি। বিপ্লব দুয়ারে— এমন আশাবাদও স্পষ্ট দেখাননি। সত্তরের দশকে গ্রাম থেকে শহরে অনেক ক্লেদ, পাঁকও ছিল। কিন্তু চরিত্রের সংলাপ ও কথোপকথনে ছুড়ে দেওয়া তর্ক ভাবিয়েছিল, ভাবা প্র্যাকটিস করিয়েছিল। দীর্ঘ ৫০ বছর বাদে দেখা যাচ্ছে, সে তর্কের বড় অভাব। তা হলে কি মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র পিরিয়ড পিস হিসাবে সফল, কিন্তু স্মৃতির ‘ট্রান্সফর্মেশন’ ও তার প্রয়োগ হিসাবে ব্যর্থ?

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

নতুন ভুবন

শিলাদিত্য সেনের ‘ভাঙা জীবনের চিত্রকর’ (১৪-৫) শীর্ষক প্রবন্ধটি তথ্যবহুল। ভারতীয় ছবিতে প্রথম উত্তর-আধুনিক ব্যক্তি মৃণাল সেন। তাঁর একদিন প্রতিদিন, খারিজ, খণ্ডহর— এই চলচ্চিত্র ত্রয়ীতে এক ধরনের সংবেদনশীলতা ও গভীর চিন্তনের ছাপ রেখেছিলেন। তাঁর ছবি এক নতুন ভুবন দেয় ভারতীয় ছবিকে। কোনও ঘটনা নেই, অথচ নাটকীয়তাকে সূক্ষ্ম ভাবে হাজির করা হয়ছে, এই সংঘটন তাঁর ছবিতে বার বার ঘটেছে। তাঁর ছবিগুলিতে আমরা পেয়েছি মর্যাদার লড়াই, মধ্যবিত্তের বুক চিতিয়ে বাঁচার গল্প।

প্রদীপ সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement