অমিতাভ গুপ্তের ‘মিসটেক, মিসটেক!’ (১১-৭) শীর্ষক নিবন্ধ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। এ এক অদ্ভুত সময়। সমাজের একটি পেশার লোক অন্য পেশার লোককে সম্মান তো করছেনই না, বরং সন্দেহের চোখে দেখছেন। ‘সব রাজনীতিকই দুর্নীতিগ্রস্ত’, ‘সব পুলিশই ঘুষখোর’, ‘সব ডাক্তারই অমানবিক ও টাকার পিছনে ছোটে’, ‘সব শিক্ষকই ফাঁকিবাজ’, ‘সব উকিলই গড়িমসি করে কেস টানে’, ‘সব সাংবাদিকই বিকিয়ে গিয়েছে’, এই বিশেষণগুলি কোন সমাজকে চিহ্নিত করে?
যে কোনও পেশার লোক কেমন হবে, তা ঠিক হয় সেই সময়কার সামাজিক গঠন ও ধারণার ওপর। সমাজে যদি ত্রিশ শতাংশ মানুষ অসৎ হন, তা হলে সেই সমাজে যে কোনও পেশারই ত্রিশ শতাংশ মানুষের অসৎ হওয়ারই সম্ভাবনা।
সারা পৃথিবীতে কিছু মানুষ অসৎ। তাদের সংখ্যা যদি অল্প হয়, তা হলে অন্যদের ঠকার সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া যদি আইন-শৃঙ্খলার সঠিক প্রয়োগ থাকে, ওই অসৎদেরও ভয় থাকে বহু গুণ। অসৎদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কম হতে থাকে। সততাই অভ্যাসে পরিণত হয়।
‘টাকা খেয়ে লেখা’, ‘ইয়েলো জার্নালিজ়ম’ চিরকালই ছিল এবং হয়তো থাকবেও। আজকাল তার আধিক্যই সমাজ-মনে সন্দেহকে ঘনীভূত করছে। অন্য পেশাগুলির ক্ষেত্রেও তা-ই।
সাংবাদিকদের নিরপেক্ষতার কথা তুলেছেন নিবন্ধকার। কথায় আছে, ‘কোনও মানুষই আসলে নিরপেক্ষ নন, সবারই এক পক্ষ আছে।’ কথাটি হয়তো অতিসরলীকৃত। সমাজে বেশ কিছু সংখ্যক লোক আছেন, যাঁরা ‘ইসুভিত্তিক’ মতামত জ্ঞাপন করেন, ‘দলভিত্তিক’ নয়। এঁদেরকেই আমরা নিরপেক্ষ বলি। অর্থাৎ সবুজ দল ভাল করলে ভাল বলা, আবার গেরুয়া দল ভাল করলে ভাল বলা। যে কোনও খারাপ কাজে উভয়কেই নিন্দা করা। কিছু ক্ষেত্রে তা বেশ কড়া ভাবেই।
এই নিবন্ধে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। ‘‘সংবাদমাধ্যম বৈধতা হারালে সবচেয়ে বেশি লাভ রাজনীতিকদের’’— এই পর্যন্ত লিখলেই তো ঠিক ছিল। কিন্তু পারলেন না। পরেই লিখলেন ‘‘নরেন্দ্র মোদীদের।’’ এক বালতি দুধে এক ফোঁটা নুন দিয়ে ফেললেন। নিবন্ধে নিরপেক্ষ, নির্ভীক সাংবাদিকতাকে সবার সামনে তুলে ধরতে গিয়ে এবং তার পক্ষে সওয়াল করতে গিয়েই, নিজেই হারিয়ে গেলেন পক্ষপাতিত্বের অতলে। বড় ‘মিসটেক’ হয়ে গেল যে!
সুকুমার বারিক
কলকাতা-২৯
আত্মসমীক্ষা
‘মিসটেক, মিসটেক’ নিবন্ধ সম্পর্কে বলি, এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না যে সাংবাদিক নিগ্রহ অত্যন্ত নিন্দার্হ ঘটনা। কিন্তু কেন সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমের প্রতি এই অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে তা একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখা দরকার, প্রয়োজনে আত্মসমীক্ষাও। তা না করে ‘‘মোদীদের কৃতিত্ব ,তাঁরা এই বিশ্বাসের জায়গাটাকে ভেঙে দিতে পেরেছেন, কেড়ে নিতে পেরেছেন সংবাদমাধ্যমের বৈধতা’’ জাতীয় বক্তব্য কেবল অতিসরলীকরণ দোষে নয়, একদেশদর্শিতা দোষেও দুষ্ট।
এ রকমই আর একটি মন্তব্য: ‘‘সংবাদমাধ্যম বৈধতা হারালে সবচেয়ে বেশি লাভ রাজনীতিকদের। নরেন্দ্র মোদীদের।’’ ব্যস, এই পর্যন্ত! এ রাজ্যের সংবাদপত্র বলে এই একটি মাত্র নামই এখন বারংবার নিশ্চিন্তে বলা যায়! আর কোনও উদাহরণ স্মরণে আসে না, চোখেও পড়ে না! এমন বক্তব্যই পরিস্ফুট করে, কেন বিশ্বাসের জায়গা ভেঙে গিয়েছে। মূল প্রশ্নটি এড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে দোষারোপ দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার এক কৌশলী প্রয়াস হতে পারে, কিন্তু এ ভাবে হৃত বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার কি সম্ভব?
যে কোনও সংবাদপত্রের নিজস্ব পলিসি থাকে। থাকতেই পারে বিশেষ রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য না হলেও ঝোঁক, কখনও ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণেও। কিন্তু অহংবোধে পাঠককুলকে নির্বোধ ভাবাও নির্বুদ্ধিতা। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলকে মসনদে আরোহণে সহায়তাকল্পে সংবাদ পরিবেশনে চতুর পক্ষপাত, এমনকি নির্বাচনে বিশেষ দল (অপছন্দের) জয়ী হলে নির্বাচকমণ্ডলীর বিবেচনাকে কটাক্ষ, সচেতন পাঠকবর্গের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। দুর্ভাগ্য, যাঁরা সর্বদা দেশের সরকারকে বা অন্য কোনও শক্তিকে সহিষ্ণুতার বাণী শোনান, তাঁরা নিজেদের ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভিন্নমত ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অসহিষ্ণু।
সোশ্যাল মিডিয়া হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ‘অপরাধ’মুক্ত নয়, কিন্তু ভিন্ন মত প্রকাশের অন্য সব পথ রুদ্ধ করে দিলে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া আর কী গত্যন্তর থাকে? যে কোনও শক্তিই একচেটিয়া ক্ষমতায় মানুষের চিন্তাভাবনা বা মত প্রকাশের অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে, স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ বিকল্প পথের সন্ধান করে নেবে। এতে আক্ষেপ কিংবা ‘গেল গেল’ রব তোলা কোনও বিশেষ স্বার্থ রক্ষার তাগিদ বলে প্রতিভাত হতেই পারে।
শান্তনু রায়
কলকাতা-৪৭
ঝুঁকি ও ঝোঁকা
অমিতাভ গুপ্ত লিখেছেন, ‘‘এই প্রথম বার কোনও অরাজনৈতিক, নাগরিক সমাজের একাংশের আন্দোলনে মার খেলেন সাংবাদিকরা।’’ সাংবাদিকরা তো এই জগতের রক্তমাংসের মানুষ। তাঁদের জীবিকাতে ঝুঁকি থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার। সেই ঝুঁকি কী ভাবে সামলাতে হয়, জেনে-শিখে তাঁরা সংবাদ সংগ্রহ করতে আসেন। ক্রমবর্ধমান জটিল আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় এখন কোন জীবিকা সহজ-সরল আছে? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কাজ করার শুরুতে চিন্তাই করিনি, টাকা লেনদেন এমন ঝুঁকির ব্যাপার হতে পারে, যেখানে মার খাওয়া ছাপিয়ে প্রাণ চলে যাওয়ার উপক্রম হয়! খেলাপি ঋণ আদায় করতে গিয়ে সহকর্মীর প্রাণভয়ের নিদারুণ অভিজ্ঞতা বুঝিয়েছিল, কঠিন পরিস্থিতিতে চাকরি বাঁচাতে যা কিছু নিজের দায়িত্বে নিজেকেই করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়াকে নন্দ ঘোষ বানিয়ে লেখকের আত্মসম্মান, আত্মরক্ষার প্রয়াস হাস্যকর। সোশ্যাল মিডিয়া (ব্যক্তিগত, সামাজিক মতামত আদানপ্রদানের বৈদ্যুতিন মঞ্চ) আর মিডিয়া— দুই ব্যবস্থার জন্ম, চরিত্র, কর্তব্য, দায়িত্ব সব আলাদা। কোনও তুলনাই হয় না।
আসলে লেখক সংবাদমাধ্যমের এক দায়িত্ব উল্লেখ করেননি। সংবাদ জগতে দৃশ্য-শ্রাব্য, মুদ্রিত নানা তথ্য আহরণ করা হয়। পরিবেশনের সময় সব তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া সম্পাদনার ব্যাপার থাকে। সংবাদ পরিবেশনে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। অন্যান্য জীবিকার জগতের মতোই, সংবাদজগৎ আজ অসুস্থ প্রতিযোগিতার শিকার। ফলে সংবাদ বাড়িয়ে, সাজিয়ে, নানা রকম ভাবে পরিবেশন করতে গিয়ে, সংবাদ বিকৃতির অভিযোগ এসে যায়। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন না-করাও ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
‘‘এই প্রথম নাগরিক সমাজ সাংবাদিকদের শত্রু হিসেবে দেখল’’ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক পৌঁছলেন ‘‘সনাতন সংবাদমাধ্যমকে সরিয়ে নরেন্দ্র মোদী সোশ্যাল মিডিয়াকেই জনসংযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন’’-এ। ফলে নিবন্ধের বক্তব্য, গুরুত্ব লঘু হল।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
ফটকগোড়া, হুগলি
মোদী ও মিডিয়া
অমিতাভ গুপ্ত মোদীর প্রতি অভিযোগ জানিয়েছেন যে তিনি মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিয়েছেন। অভিযোগ সঠিক কিন্তু অসম্পূর্ণ। মোদী মিডিয়ার স্বাধীনতাও কেড়ে নিয়েছেন। গুটিকয়েক চ্যানেল বাদে বাকিরা সবাই আজ ভারতের শাসক দলের দাসত্ব করছে। সরকারের সমালোচনা করা তো দূর, তারা সরকারের খারাপ কর্মসূচিকেও ভাল বলে উপস্থাপিত করছে, যার খারাপ প্রভাব পড়ছে সমাজের উপর। মানুষের বিচার ও সমালোচনার মানসিকতাকেই শেষ করে দেওয়া হচ্ছে, যা বিপজ্জনক।
ওয়াকার নাসিম সরকার
দাঁপুর, হুগলি