শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবন্ধটি (‘বহুজন সমাজের বহুস্বর’, ২৪-৪) তথ্যসমৃদ্ধ এবং বিশ্লেষণমূলক। তবে একটি তথ্যগত ত্রুটি আছে। উনি লিখেছেন, “সেই সময়ে, ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার আনল এক নতুন নাগরিক আইন। বলা হল, ভারতের নাগরিকত্ব পেতে হলে ১৯৭১-এর মার্চ মাসের আগে ভারতে প্রবেশ করতে হবে।” ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে ১৯৭১-এর কোনও তারিখের উল্লেখ নেই। এমনকি এই আইনের আওতায় যে নিয়মাবলি তৈরি হয় (সিটিজ়েনশিপ রুলস, ২০০৩) তাতেও ১৯৭১-এর আগে বা পরে ভারতে প্রবেশ করা সম্বন্ধে কিছুই বলা হয়নি। এই আইনে কেবল বলা আছে, কোনও বিদেশি পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া ভারতে প্রবেশ করে থাকলে, অথবা ভিসার সময়সীমা অতিক্রান্ত হলে আইনের চোখে সে ‘অবৈধ অভিবাসী’। এ-ও বলা হয়, কারও বাবা অথবা মা অবৈধ অভিবাসী হলে তিনি আর জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক হতে পারবেন না।
এই আইনের ভিত্তিতে যে নাগরিকত্ব নিয়মাবলি তৈরি হয় তাতে বলা হয়, প্রথমে জনপঞ্জি (পপুলেশন রেজিস্টার বা এনপিআর) করে তার থেকে ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ নাম বাদ দিয়ে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি করে তালিকাভুক্ত সকলকে জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে হবে। এখানেও ‘সন্দেহজনক’ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ১৯৭১-এর পরে ভারতে আসা, বা অন্য কোনও মাপকাঠির কথা বলা নেই। নাগরিকত্ব নির্ণয়ে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর আগে বা পরে ভারতে আসার বিষয়টি আছে অসম চুক্তিতে, যা ১৯৮৫ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী শুধু অসমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাকি রাজ্যের ক্ষেত্রে এই তারিখ অনুযায়ী ভারতীয় নাগরিকত্ব নির্ণয়ের কোনও আইনি ভিত্তি নেই।
প্রসেনজিৎ বসু
কলকাতা-৮৯
মূলে অর্থনীতি
শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সময়োপযোগী পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিযুক্ত অনুসিদ্ধান্ত, “বাংলার দলিতরা স্বার্থ অনুসারেই বিভিন্ন দলকে সমর্থন করেন।” তবে শুধুমাত্র দলিতরা কেন, বর্ণহিন্দুরা যখন কোনও রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন, তখন কি ব্যক্তি-স্বার্থের ঊর্ধ্বে ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর প্রেরণা তাঁদের সিদ্ধান্তকে উদ্বুদ্ধ করে? সামাজিক পরিচয়, অর্থনৈতিক সুবিধা, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি আদায়ের ক্ষেত্রে নানা স্বার্থের খেলার নিয়ম লক্ষ করে, সমাজতাত্ত্বিক আর ইতিহাসবিদরা নানা তত্ত্বের অবতারণা করেছেন।
এম এন শ্রীনিবাস ‘সংস্কৃতায়ন’ নামে একটি তত্ত্ব চালু করেছিলেন। তাঁর মতে, এ দেশের নিম্নবর্গের জাতিগোষ্ঠীরা, প্রাক্-ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ যুগে উচ্চবর্ণের ধর্ম-সংস্কৃতি ও আচরণবিধি আত্মস্থ করে সাংস্কৃতিক ঊর্ধ্বায়নের চেষ্টা করেছেন। যেমন আদি গোপ গোষ্ঠী, মধ্যকালীন বাংলায় সদ্গোপ নামে পরিচিত হয়ে সামাজিক ঊর্ধ্বায়নের চেষ্টা করেছিল। আবার বার্নার্ড কোন দেখিয়েছেন, জৌনপুরের চামারগোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতি আত্মস্থ করে রাজপুত-ঠাকুর-জমিদারদের পীড়নের মধ্যেও কী ভাবে মানসিক সান্ত্বনার প্রলেপ খঁুজেছে। কেরলের এজ়াভা সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ্য-প্রতাপের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে এবং মন্দিরে প্রবেশাধিকারের দাবির মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতায়নের প্রেরণা পেয়েছে। তবে বিরুদ্ধ-তথ্যও ইতিহাসে আছে। সমাজবিজ্ঞানী গেল ওমভেট দেখিয়েছেন, মহারাষ্ট্রের অব্রাহ্মণরা সংস্কৃতায়নের পরিবর্তে ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতি প্রস্তাবিত আচার-অনুষ্ঠান ও জাতি-কাঠামোকে অস্বীকার করেছে।
সামাজিক মর্যাদায় উঁচুতে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় প্রেরণা অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন। ব্রিটিশ ভারতে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, তত বৃদ্ধি পায় শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিম্নবিত্ত, নিম্নবর্গ ও নিম্নবর্ণের সুযোগ ছিল অসম। আধিপত্যবাদী স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন আর স্বজাতির সঙ্গে ঐক্যবন্ধনের মাধ্যমে তাঁরা উচ্চবর্ণ হিন্দুদের সামাজিক বজ্জাতি ও অর্থনৈতিক অসম যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। হিন্দু-ভারতে দলিতরা অহিন্দু, অস্পৃশ্য। হিন্দুরা তাঁদের ঘর দেননি, অথচ তাঁদের জন্য ‘ঘরে ফেরা’ আন্দোলনের ভণ্ডামি করেছেন। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যত্র দেখিয়েছেন, এই জন্য পূর্ব বাংলার চণ্ডালরা তাঁদের অন্ত্যজ নাম ঘুচিয়ে হন ‘নমশূদ্র’, তামিলনাড়ুর
‘শানান’-রা ‘নাদর’, মেদিনীপুরের ‘কৈবর্ত’-রা ‘মাহিষ্য’।
কিন্তু সাংস্কৃতিক চিহ্ন বদল হলেই তো সামাজিক ঠাঁই বদল হয় না। হয় না অর্থনৈতিক সুরাহা। তাই যেতে হয় রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায়। বাংলার দলিতদের স্বার্থের লড়াই তাই নিছক সমাজে উঁচুতে ওঠার প্রয়াস নয়, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন আর আত্মমর্যাদায় পুনর্বাসনের সংগ্রাম।
অরবিন্দ সামন্ত
কলকাতা-৫৫
ভুলের মাসুল
শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “তফসিলি জাতির এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনেকেই কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ জোটকে সমর্থন করায় ১৯৩৭-এ কংগ্রেসের পক্ষে সরকার গড়া সম্ভব হয়নি।” কৃষক প্রজা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাশেম ফজলুল হক ছিলেন জমিদার বংশের সন্তান, চিত্তরঞ্জন দাশের স্নেহভাজন, কৃষকদের সহমর্মী। শোষণের করাল গ্রাস থেকে কৃষকদের মুক্ত করার লক্ষ্যে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি তৈরি করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে অখণ্ড বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টি সবচেয়ে বেশি আসন লাভ করে। ফজলুল হক কংগ্রেসের সঙ্গে একযোগে সরকার গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেন, তাঁদের দল অন্য দলের প্রধানমন্ত্রিত্বে কাজ করবে না। শরৎচন্দ্র বসু বা অন্য বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের অবশ্য ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আপত্তি ছিল না। বাধ্য হয়ে ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়লেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি খাজনার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিলেন, বকেয়া ঋণ মকুব করলেন। জনসংখ্যার ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণ করলেন।
কলকাতার সমস্ত বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার শুরু হল। তিতিবিরক্ত হয়ে ফজলুল হক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে বিধায়কদের নিয়ে এক সময় তাঁর তীব্র বিরোধী মুসলিম লীগে যোগ দিলেন। ফলে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের একাধিপত্য। কংগ্রেসের ভুলের মাসুল দেশকে দিতে হয়েছিল। তথ্যগুলির সূত্র: অশোক মিত্র প্রণীত অমিত্রাক্ষর এবং, আনন্দ)
শিবাজী ভাদুড়ি
হাওড়া
দলিতের লক্ষ্য
স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী কাল থেকে মতুয়া তথা দলিত আন্দোলনের যে সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় তুলে ধরেছেন, তা ইতিহাসসম্মত। এটা সত্যি যে, মতুয়াদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন আজ নাগরিকত্ব লাভের আন্দোলনে পর্যবসিত। কিন্তু লেখকের দৃষ্টি সার্বিক ভাবে দলিতকেন্দ্রিক হলে এই সত্য উদ্ঘাটিত হত যে, বৃহত্তর দলিত আন্দোলন মূলত অম্বেডকর-পন্থাকেই শিরোধার্য করে বর্তমানে এগিয়ে চলেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন বাবাসাহেব, তাঁর অনুগামীরা সেই লক্ষ্যে আজও অবিচল। বাবাসাহেব যেমন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ্যবাদের শৃঙ্খল ভেঙেছিলেন, দলিতদের মধ্যে পৌণ্ড্র, কাহার, মুচি, বাগদি, হাড়ি, বাউড়িরা ইদানীং বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছেন। বিবাহ, অন্নপ্রাশন, গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি বিভিন্ন গৃহকৃত্যে বৌদ্ধাচার নিষ্ঠাভরে পালিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে বুদ্ধমূর্তি সংস্থাপিত হচ্ছে। আদিবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে অসুর-স্মরণের মতো ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী অনুষ্ঠান। সুতরাং, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের মতো লড়াকু দলিতরা স্বকীয়তা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।
সনৎকুমার নস্কর
কার্যনির্বাহী সদস্য, পৌণ্ড্র মহাসঙ্ঘ