‘চাই আর একটি নবজাগরণ’ (৯-১) প্রবন্ধে মোহিত রায় বলেছেন, বাংলায় উনিশ শতকে যে নবজাগরণ হয়েছিল, সেই সময়ে শিক্ষা ও শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে, বাঙালিদের ব্যবসার ইতিহাস বহু প্রাচীন, মনসামঙ্গল কাব্যে আমরা চাঁদ সদাগরের বিশাল বিশাল বাণিজ্যতরীর সন্ধান পাই। বাংলার মসলিন, চিনি শিল্প ইংরেজদের আকৃষ্ট করেছিল। তাম্রলিপ্ত উল্লেখযোগ্য বন্দর ছিল। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিতে বিনিয়োগ অধিক লাভজনক মনে করেন বাংলার ব্যবসায়ীরা। শিল্পের উৎসাহদাতা বহু জমিদারির অবলুপ্তি ঘটে এই সময়। আবার এই জমিদারদের কেউ কেউ, যেমন রামদুলাল দে (ছবিতে বাঁ দিকে) এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর (ছবিতে) জাহাজ নির্মাণে বিনিয়োগ করেন। তবে বাঙালিরা মহাজনি ব্যবসা বা ব্যাঙ্কিং শিল্পে অধিক আগ্রহী ছিলেন। বাংলায় প্রথম উৎপাদনমূলক লোহা-ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে হাওড়ায় কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে। ১৮৯২ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে গড়ে ওঠে বেঙ্গল কেমিক্যালস। তবে বাংলায় শিল্প আন্দোলনের জোয়ার আসে স্বদেশি আন্দোলনের হাত ধরে (১৯০২-১৯০৭), ডন সোসাইটি-র শিল্প বিভাগের উদ্যোগে। অনেক ছোট-বড় কারখানা, যেমন, বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল, মোহিনী কটন মিল গড়ে ওঠে। ডাক্তার নীলরতন সরকারের উদ্যোগে ট্যানারি কারখানা, বাঙালি মুসলিমদের উদ্যোগে হোসিয়ারি শিল্প ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল। সুতরাং, বাঙালিরা শিল্পে বিমুখ, এ কথা ঠিক নয়। বরং বিষয়টিকে সামগ্রিক ভাবে বিচার করলে দেখা যাবে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে না পারায় বাঙালিরা পিছিয়ে পড়েছে। তবে প্রশাসন এবং ট্রেড ইউনিয়নের দায়িত্বও অস্বীকার করা যায় না।
দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৬
চাকরিই সব?
মোহিত রায় স্বাধীনতার আগে বিখ্যাত বাঙালি উদ্যোগপতি ও ব্যবসায়ীদের সাফল্য এবং বাম জমানায় শিল্পক্ষেত্রে ধ্বংসের একটি রূপরেখা পেশ করেছেন। ’৭০-এর দশক থেকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘পুঁজিপতি’, ‘মেহনতি মানুষ’— এই শব্দগুলো শুনে বড় হয়েছি, কিন্তু এই শব্দগুলো দলের সাংগঠনিক বৃদ্ধি ছাড়া রাজ্যের উন্নয়নে কোনও কাজে আসেনি। একটি রাজনৈতিক দল তিন দশকের বেশি ক্ষমতা ধরে রাখলেও, শুধু মার্ক্স-এর দ্য ক্যাপিটাল নিয়ে বিভোর হয়ে থাকল। আলামোহন দাশের সাফল্যের ইতিবৃত্তান্ত তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারল না। রাস্তাঘাটের শ্রীবৃদ্ধি আর উন্নয়ন দুটো যে এক জিনিস নয়, তা এখনকার সরকার বিলক্ষণ উপলব্ধি করছে।
বাঙালি মূলত চাকুরিমুখী, তার কারণ বাঙালি ঝুঁকির জীবনের থেকে মধ্যমানের নিশ্চিত আয়ের জীবনযাত্রায় বেশি নির্ভরশীল। সামাজিক দিকটিতে নিজস্ব উদ্যোগ আর অবদানের থেকেও ব্যক্তিগত ভাবে অর্থনৈতিক সুরক্ষার দিকটিতে বেশির ভাগই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। রাজনারায়ণ বসুর সেকাল আর একাল গ্রন্থে তদানীন্তন বাঙালি সমাজের ইংরেজি শিক্ষার দুর্দশাগ্রস্ত চেহারাটা কৌতুকের মোড়কে বর্ণনা করা হয়েছে। তথাপি সেই সময় ইংরেজদের সঙ্গে বাঙালি বণিকসমাজ ব্যবসায় উন্নতি করেছিল কলকাতা এবং উত্তর ২৪ পরগনার ধান্যকুড়িয়া, আরবেলিয়া এবং বসিরহাট অঞ্চলে। নিবন্ধে উল্লিখিত সফল ব্যবসায়ীরা কোনও দিনই বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করতে পারেননি, যতটা অনুপ্রাণিত তাঁরা হয়েছেন রাজনীতিতে। যে ক’জনের নাম লেখক উল্লেখ করলেন, হয়তো তাতে পিয়ারলেস গ্রুপ-এর কর্ণধার বি কে রায়, রোমান সার্কাসের প্রতিষ্ঠাতা রমনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কিংবা বন্ধন ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রশেখর ঘোষের নাম রাখা যেত। তবে সংখ্যাটি যা-ই হোক না কেন, কখনওই এঁদের দৃষ্টিভঙ্গিকে গড়পড়তা বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গি বলা যায় না। সত্তরের দশকে ‘কেরানিকুল’ বলে আমরা যা জানতাম, তা আজ তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের কর্মীতে বিবর্তিত হয়েছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিল্প, আর প্রোমোটারি শিল্প, এই দু’টির মালিকপক্ষের অধিকাংশই বাঙালি হিসেবে পরিচিত। আপাতত সেটা নিয়েই আমরা আত্মতৃপ্তি অনুভব করতে পারি!
পিনাকী রুদ্র, কলকাতা-১২৪
দাশনগর
মোহিত রায়ের নিবন্ধটি পড়ে স্মৃতির সিংহদুয়ার খুলে গেল। হাওড়া কদমতলায় যে ভাড়াবাড়িতে জন্ম থেকে জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে, তার বাড়িওয়ালি দিদা গল্প করতেন— “একটা ১০-১২ বছরের বাচ্চা ছেলে মুড়ি বেচতে আসত। সে যে এক দিন আলামোহন দাশ হয়ে উঠবে, দাশনগর বানাবে, তা কে জানত?” শিশু বয়স থেকেই সারা বছর অপেক্ষা করতাম দাশনগরের মেলা দেখার জন্যে। যন্ত্রচালিত পুতুলের সাহায্যে মহাভারত দেখানো হত। জন্মাষ্টমীতে শুরু, দুর্গাপুজো হয়ে শেষ। ইন্ডিয়া মেশিনারির কুশলী কারিগরবৃন্দ দ্বারা নির্মিত হত আশ্চর্য এই চলমান মহাভারত।
মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আলামোহন দাশের নির্মিত ইন্ডিয়া মেশিনারি কারখানায় তৈরি লেদ মেশিন, ওয়েয়িং মেশিন ইত্যাদি গুণগত মানে ভারতশ্রেষ্ঠ ছিল। বিদেশেও রপ্তানি হত। লেখাপড়া তেমন কিছুই ছিল না ওঁর। ছিল যেটা, তা হল ক্ষুরধার বুদ্ধি, নতুন কিছু সৃষ্টির অদম্য বাসনা, আর কঠোর পরিশ্রম করার ক্ষমতা, যেগুলি ব্যবসাবিমুখ বাঙালি চরিত্রে অনেকটাই অনুপস্থিত। আরও কয়েকটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান তিনি নির্মাণ করেছিলেন ওই দাশনগরেই। আরও বেশ কিছু বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল হাওড়া শহর এলাকায়। অদূরবর্তী বেলিলিয়াস রোড ও সংলগ্ন কয়েকটি অঞ্চলে ছিল প্রায় ২৪ হাজার এক বা দুই ঘরের কারখানা। অনেক সময়ে তাদের মালিক ও কারিগর ছিলেন একই ব্যক্তি। এঁরা নির্ভরশীল ছিলেন এই বৃহৎ শিল্পগুলির উপর।
এই শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে বলা হত ‘ম্যাঞ্চেস্টার অব দি ইস্ট’। শিফটের ভোঁ বাজলে রাস্তায় হাজার হাজার সাইকেলের ঢল নামত। ষাটের দশকের শেষ ভাগ থেকে বামপন্থী রাজনীতির আগুনে পুড়ে খাক হয়েছে বাংলার শিল্প। হাওড়া, কলকাতা, ২৪ পরগনা (অবিভক্ত), হুগলি ও বর্ধমান জেলা জুড়ে যে ঘন সন্নিবিষ্ট শিল্পাঞ্চল ছিল বাংলার গৌরব, আজ তা যেন এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধা।
অশোক চক্রবর্তী, কলকাতা-৯২
নয়াচরে নয়
মোহিত রায় নিজে এক জন পরিবেশবিদ হয়ে এবং পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে কেন যে নয়াচরে শিল্পের কথা আবার বলছেন, বুঝতে পারছি না। সুন্দরবনের সাগরদ্বীপের এসডি মেরিন বায়োলজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রাণপুরুষ ও আজীবন সম্পাদক অধ্যাপক অমলেশ চৌধুরী সম্প্রতি প্রয়াত হলেন। জেগে-ওঠা নয়াচর দ্বীপে যখন কেমিক্যাল হাব করার প্রস্তাব করা হয়, তখন তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, নয়াচরে ১০-১২ রকমের বিশেষ ধরনের ঘাস জন্মায়, হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের পরিবেশ রক্ষায় যেগুলির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে (সংহতি, সেপ্টেম্বর, ২০০৭)।
শ্যামল ভদ্র, কলকাতা-৬৮
এত বেকার
গোপালের মুদির দোকানে জিনিসপত্র কিনতে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বিক্রিবাটা কেমন?” গোপাল জানাল, খদ্দেরের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কারণ, বেকারের সংখ্যা যত বাড়ছে, দোকানের সংখ্যা তত বাড়ছে। খদ্দের বিভিন্ন দোকানের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। গোপালের আক্ষেপ, “যদি এই অঞ্চলে দু’চারটে কারখানা হত, তবে দোকানের সংখ্যা এত বাড়ত না। কারখানার মাঠ তো দেখতে দেখতে মরুভূমি হয়ে গেল।”
সঞ্জয় চৌধুরী, ইন্দা, খড়্গপুর