‘তর্কে বহু দূর’ (১০-১১) শীর্ষক সম্পাদকীয়ে যথার্থই বলা হয়েছে, ‘‘সমাপন একটি গন্তব্য— তাহা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, যুক্তির কোন পথে সেই গন্তব্যে পৌঁছানো গেল, তাহার গুরুত্ব তুলনায় তিলমাত্র কম নহে।’’ অযোধ্যা জমি-বিবাদের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিল, বিশ্বাসের উপর ভর করে তার গন্তব্যে পৌঁছনো। ১৯৩৪-এর দাঙ্গা, ১৯৪৯-এ মসজিদে সহসা রামলালার মূর্তির ‘আবির্ভাব’, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের লজ্জাজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্ন করা যাবে না, প্রায় ৪৯০ বছর আগে মসজিদ নির্মাণের আগে ওই জায়গাটিতে ঠিক কী ছিল। মসজিদের নীচের কাঠামোটি কাদের ছিল তা পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের রিপোর্টে নাই বা মিলল, তা যে মুসলিমদের ছিল না, এই তো যথেষ্ট।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা স্মর্তব্য, “...ঐতিহাসিক তপোবনের কথা আমি জানিনে। কেউ জানে ব’লে আমি বিশ্বাস করিনে। তপোবনের কথা আছে পুরাণে, কিন্তু এত অসম্ভব অলৌকিক কাহিনীর সঙ্গে সে জড়িত যে তাকে ঐতিহাসিক সত্য বলে বিশ্বাস করতে কাউকে অনুরোধ করিনে। সেখানে যে-সব ঋষি-তপস্বীদের বাস, তাঁরা সমুদ্র-পর্বতকে অভিশাপের জোরে কম্পমান ক’রে জোড় হস্তে দ্বারস্থ করতে পারতেন। আবার তাঁদের তপস্যাও অযুত-নিযুত বছরের তাপে এমন সর্বনেশে বয়ে যেতে পারত যে, সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে যাবার যো হ’ত, শেষকালে দেবতাদের কেঁদে এসে পড়তে হ’ত তাঁদের ঠাণ্ডা করতে। এমন সব বিশ্বাস করার শক্তি যাঁদের আছে, তাঁদের পড়াশোনা করবার দরকার নেই ” (কষ্টিপাথর, প্রবাসী, ভাদ্র ১৩৪৭) ।
গৌরীশঙ্কর দাস
সাঁজোয়াল, খড়্গপুর
কিছু কাল আগে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছিলাম এই কথা জেনে, তাজমহল আদতে একটি শিবমন্দির ছিল; তার আদি নাম তেজো মহালয়া। বলা নিষ্প্রয়োজন, এই বিশাল জ্ঞানের উৎস আমাদের দেশনেতাদের মুখনিঃসৃত বাণী। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। ভাবছি, তেজো মহালয়া দেখার আগে এক বার তাজ মহল দেখে আসব।
অমিত বর্ধন
‘ক্যাওট’
বিরোধিতার শিকার হয়েছিলেন কর্তব্যে নিরলস কিন্তু পদলাভে নিস্পৃহ, দক্ষ সংগঠক ‘মেদিনীপুরের ক্যাওট’ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (৭-১১) শীর্ষক চিঠিতে যাঁর কথা লেখা হয়েছে। বীরেন্দ্রনাথ নেতা হয়েছিলেন তাঁর আদর্শ ও আত্মত্যাগের জন্য। গাঁধীজির অসহযোগ আন্দোলন পর্বে বীরেন্দ্রনাথ (সেপ্টেম্বর ১৯২০)দেশবন্ধুরও (ডিসেম্বর ১৯২০) আগে ব্যারিস্টারি ছাড়েন। গাঁধীজি যেমন একক শক্তিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্দোলন সংঘটিত করতে পেরেছিলেন, বীরেন্দ্রনাথ একক শক্তিতে মেদিনীপুর জেলায় ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলন (১৯২১) সফল করতে পেরেছিলেন। এর পরই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বীরেন্দ্রনাথকে মেদিনীপুরের ‘মুকুটহীন রাজা’র আখ্যায় ভূষিত করেন। দেশবন্ধু এই আন্দোলন সম্পর্কে কোনও মন্তব্য না করলেও, সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ গ্রন্থে বীরেন্দ্রনাথের ও এই আন্দোলনের প্রশংসা করেন। এই ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলনই হল ভারতবর্ষের প্রথম সার্থক গণ-আন্দোলন। অনেকের মতে, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ভিত্তি।
দেশবন্ধু কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র এবং মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক পদে সুভাষচন্দ্র আসীন হওয়ার পর, ১ মে ১৯২৪ কলকাতার ‘ক্যাপিটাল’ পত্রিকার মূল্যায়ন ছিল: ‘‘মিঃ সি আর দাশের আদেশে গত সপ্তাহে কর্পোরেশনে স্বরাজ্য দলের সভ্যগণ এক সভায় তাঁর সুশীল শিষ্য সুভাষচন্দ্র বসুকে মাসিক ১৫০০ টাকা বেতনে প্রধান কর্মকর্তার পদে নিযুক্ত করেছেন। কোলকাতা কর্পোরেশনের কক্ষে অনেক প্রহসন হয়ে গেছে... মিঃ শাসমলকে চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের পদে নিয়োগ করলে মতলববাজ কায়স্থেরা চটে যাবে। দলনেতা দাশ এই বিপদের সম্মুখীন হতে চান না। তাই পূর্বতন সিভিলিয়ান অসহযোগী হওয়ার জন্য আরামের চাকরী বর্জন করেছিলেন, তাঁকেই উক্তপদে বসানোর জন্য মেদিনীপুরের বলিষ্ঠ ব্যক্তিকে সজোরে সরিয়ে দিয়ে কোণঠাসা করার ব্যবস্থা করা হল।’’
এর পর বীরেন্দ্রনাথ কলকাতা ছেড়ে জেলার রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বীরেন্দ্রনাথকে লিখলেন, ‘‘আপনার পাবলিক লাইফ হইতে বিদায় গ্রহণ দেশের পক্ষে বড়ই দুর্ভাগ্য।...কোলকাতা কর্পোরেশনে চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার-এর পদ আপনার প্রাপ্য জানিতাম। কিন্তু স্বরাজ্য দলের কি অভিসন্ধি ছিল জানি না। আপনাকে চালাকি করিয়া উপেক্ষা করিল।’’
বীরেন্দ্রনাথের বিরোধিতা এর পরেও হয়েছে। ১৯৩৩-এ কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে, কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও বীরেন্দ্রনাথ প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে, বিধানচন্দ্র রায়ের মনোনীত প্রার্থী রায়বাহাদুর রামরতন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ৯৯০ ভোটে পরাজিত করেন।
বিলেতের ব্যারিস্টার (১৯০৪), প্রবল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বীরেন্দ্রনাথের প্রয়াণের (২৪ নভেম্বর ১৯৩৪) পর অমৃতবাজার পত্রিকা যথার্থই লিখেছিল, 'In him Bengal has lost a towering personality who alone was able, if any single Bengali is able, to restore the position of the province in the Councils of India.'
(তথ্যসূত্র: কালের নিরিখে দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ, সম্পাদক গৌরীশংকর মহাপাত্র; স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর, ডা. রাসবিহারী পাল, অধ্যাপক হরিপদ মাইতি)
‘শরীর’ গল্পটিতে (রবিবাসরীয়, ১০-১১) লেখক সিজার বাগচী এক ভ্রমণবিলাসী, বহুবিধ নারীর শরীরে বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করা শহুরে ‘বাবু’র গল্প বলেছেন। লেখক যে ভাবে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের নারীচরিত্রকে কেন্দ্র করে গল্পের অবতারণা করেছেন, তাতে সামগ্রিক ভাবে আদিবাসী নারীসমাজের মর্যাদাহানি হয়েছে, আদিবাসী সমাজের ভাবাবেগ আহত হয়েছ। গল্পটি পড়ে মনে হচ্ছে, আদিবাসী নারীরা ‘অতি সহজলভ্য’। তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
শিবু সরেন
নীলডাঙা, বীরভূম
লেখকের উত্তর: ‘শরীর’ গল্পটি নারীশক্তির মহিমা ও তার জয়ের কথা বলেছে। গল্পটির শেষাংশ পড়লেই তা স্পষ্ট বোঝা যাবে। কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের নারী তো নয়ই, কোনও নারী সম্পর্কেই গল্পটিতে কোনও অপমানজনক মন্তব্য করা হয়নি। বরং গল্পের শেষে, যে-পুরুষটি নারীকে নিছক ভোগের সামগ্রী ভেবেছে, তার পতনের কথাই লেখা হয়েছে। গল্পটিকে নিছক বাস্তব গল্প ভাবলে ভুল হবে, কাহিনিতে কিছুটা ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজ়ম’ মিশেছে। তবু যদি এই গল্প পড়ে কেউ আঘাত পান, তা হলে আমি দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
‘চিলি’র মানুষ (‘চিলির এই জনজোয়ার’, ১৩-১১) তাঁদের দেশটাকে ‘চিলে’ বলেই জানেন। তা হলে আমরা কথায় বা লেখালিখিতে দেশটাকে ‘চিলি’ বলব কেন?
কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বহু হল-এ, প্রায় নিয়ম করে কিছু ছবি শেষ মুহূর্তে পাল্টে যায়। খারাপ লাগে, ওগুলো দেখতেই তো যাওয়া!
সায়ক সান্যাল
কলকাতা-৯৪