এনআরসি, ক্যাব, সিএএ নিয়ে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ, আর পাশাপাশি ‘কামিন্স ১৫.৫ কোটি, ব্রাত্য চাওলা ৬.৭৫’ আমাদের সব হিসেব গুলিয়ে দেয়। কোনটা সত্য? আগুনে-প্রতিবাদ এবং আইপিএল বিনোদন, দুটোই? না কি, এক পক্ষ ক্রিকেট জ্বরে ভুগবে, আর এক পক্ষ নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কার আবহে পথে নামবে, পুলিশের লাঠি বা বন্দুকের গুলির সামনে প্রাণ দেবে? বোকাবাক্সে যখন মহানগরীর সাততারা হোটেলে অনুষ্ঠিত বিনোদন-বিপণন প্রচারিত হয়, সাজুগুজু ভদ্রমহোদয়গণ, অতীত দিনের ক্রিকেট-তারকারা, সদ্য-বয়স হয়ে যাওয়া বলিউডি হার্টথ্রব নায়িকার উপস্থিতি আমাদের স্মৃতি উদ্বেল করে, তখন কলকাতা-দিল্লি-কানপুর-লখনউ-হায়দরাবাদ-গুয়াহাটি-আগরতলায় নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কায় পথে নামা ছাত্র-যুবদের ছবিটা, একই দেশের বলে মানতে একটু কষ্ট হয়। অবশ্য প্রতিবাদ হচ্ছে বলে কি আনন্দ হবে না? দেশের অবস্থা কঠিনতর থেকে কঠিনতম হবে, চারিদিকে শুধু নাই-নাই রব শ্রুত হবে, তা-ই বলে কি মোচ্ছবে টান পড়িয়াছে আমাদের? বরং, শীতের দারুণ আমেজে গোটা শহর উৎসবময়। এই তো তিনি মিছিলে হাঁটছেন, পর ক্ষণেই একটা উৎসবের শুভ সূচনা করছেন। চতুর্দিকে এত আলো, এত আয়োজন, তারই মাঝে প্রতিরোধের জনজোয়ার। কোনটা আসল? কেন? সব, সব। আমরা ধর্মে আছি, জিরাফেও আছি।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচি
কলকাতা-১২৫
শংসাপত্র
এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে দেশে প্রতিবাদের আগুন জ্বলেছে। বিভিন্ন আলোচনা থেকে একটা তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে: সংবিধানে বা পরবর্তী সময়ে, নাগরিকত্ব বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট আইন প্রণীত হয়নি। সেই কারণেই দেশের নাগরিকেরা আজ এক বিভ্রান্তিকর অনিশ্চয়তার শিকার। আমার মতো জনৈকের যেমন— রেশন কার্ড, পাসপোর্ট, ভোটার আইডি, প্যান কার্ড, আধার কার্ড, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী হিসেবে পেনশন-বই আছে, কিন্তু সেগুলির কোনওটাই বা সবগুলি মিলেও নাকি আমার নাগরিকত্ব প্রমাণ হবে না। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট।
কিন্তু আমি জানি, কোনও একটি সময় এই রাজ্যের উদ্বাস্তুদের ‘নাগরিকত্বের শংসাপত্র’ দেওয়া হত। স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে একটি তথ্যের উল্লেখ করি। আমি ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত একটি উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে পা রেখেই আমি একটি গ্রামের মিড্ল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হয়েছি, তার পর ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে রানাঘাট পালচৌধুরী হাইস্কুল, কলকাতার টাউন স্কুল, এমনকি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে স্কুল ফাইনাল পাশ করে কলেজে পর্যন্ত ভর্তি হয়েছি— কোনও পর্যায়েই কোনও প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়নি।
বিএ পড়তে পড়তেই বুঝতে পারি, যে-ভাবেই পাশ করি না কেন, এর পর পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না, একটা চাকরি-বাকরি করতেই হবে। ১৯৫৭ সাল, তখনও আমার বিএ পরীক্ষার রেজ়াল্ট বার হয়নি, চোখে পড়ল কলকাতা হাইকোর্টের (আপিল বিভাগ) একটি বিজ্ঞাপন— লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের পদের জন্য আবেদনপত্র চাওয়া হচ্ছে। আবশ্যিক যোগ্যতা স্কুল ফাইনাল এবং ইন্টারমিডিয়েট পাশ। পরে শুনেছি, তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণ চক্রবর্তী মহাশয়ের তাই নির্দেশ ছিল। দরখাস্তের সঙ্গে প্রার্থীদের কাছ থেকে ‘সিটিজ়েনশিপ সার্টিফিকেট’ চাওয়া হয়েছিল।
তখন দমদমে থাকি, জানতে পারলুম ব্যারাকপুর মহকুমা শাসকের অফিস থেকে সেই সার্টিফিকেট আমাকে সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু কী প্রমাণের ভিত্তিতে সেটা আমাকে দেওয়া হবে? জানা গেল, সেন্সাস বা জনগণনার নথির সংশ্লিষ্ট অংশটি উল্লেখ করে একটি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে আবেদন করতে হবে মহকুমা শাসকের দফতরে। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের রাস্তায় কয়লাঘাট রেল অফিসের পিছনে একটি ছোট ঘরে সেন্সাসের একটি শাখা অফিস ছিল। যাবতীয় তথ্যাবলির উল্লেখ করে সেই অফিস থেকে একটি সার্টিফিকেটের জন্য দরখাস্ত করলাম: ১৯৫১ সালের সেন্সাসের সময় আমার ঠিকানা কলকাতার মহারানি হেমন্তকুমারী স্ট্রিটে, আমি (এবং আমাদের পরিবার) ১৯৪৮-এর এপ্রিল/মে মাসে (ঠিক মনে পড়ছে না) ভারতে প্রবেশ করেছি, পিতার নাম, হয়তো জন্মস্থান এবং জন্মতারিখও ছিল। একটি নির্দিষ্ট ছাপানো ফর্মের কলামগুলি পূরণ করে সেই সব তথ্য উল্লেখ করে সেন্সাস দফতর আমাকে একটা স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট দিল। এবং তারই ভিত্তিতে ব্যারাকপুর মহকুমা শাসকের দফতর ‘সিটিজ়েন সার্টিফিকেট’ দিয়ে দিল আমাকে— ওই দু’টি শব্দ সেই সার্টিফিকেটের মাথায় জ্বলজ্বল করছিল।
হাইকোর্টে সেটি পেশ করেই আমার প্রথম চাকরি, এবং নাগরিকত্বের সরাসরি স্বীকৃতিও বলা চলে। এর পর চাকরি পাল্টেছি দু’-দু’বার। কিন্তু কোথাও প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়নি। পরে ভেবেছি, নাগরিকত্ব প্রদান তো কেন্দ্রের এক্তিয়ার, রাজ্য প্রশাসন সেটা দিল কোন অধিকারে! এর কারণ আন্দাজ করার চেষ্টা করেছি— হয়তো সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে এই বিশেষ ব্যবস্থা বিধিসম্মত ছিল, ঠিক যেমন বহু দিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ভারতীয়দের যাতায়াতের জন্য পাসপোর্ট ইসু করত পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এ জন্যই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হয় উদ্বাস্তুদের সাহায্যকল্পে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বিভিন্ন সংবেদনশীল এবং উদ্যোগী ভূমিকার কথা।
বিভাস চক্রবর্তী
কলকাতা-৯৫
শুধু ওঁরা
সারা দেশ যখন এনআরসি-সিএএ নিয়ে উত্তাল, তখন সরকারের সপক্ষে দাবি করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাবেন। অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আসা সংখ্যালঘুরা ভারতের স্থায়ী নাগরিক হওয়ার আবেদন করতে পারবেন এবং তা শর্তসাপেক্ষে মঞ্জুর করা হবে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের মূল বিষয় যদি এটাই হয়ে থাকে, তা হলে দেশসুদ্ধ ১৩৫ কোটি মানুষকে নাজেহাল করার কী দরকার? যে-সমস্ত মানুষের কাছে নাগরিকত্বের উপযুক্ত নথি আছে, তাঁরা অযথা নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে যাবেন কেন? প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত ‘অনাগরিক’ শরণার্থীর সংখ্যাটা তো অনেক কম! তাই সরকার যদি এমন বিজ্ঞপ্তি জারি করে: উপযুক্ত নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র যাঁদের কাছে নেই, কেবলমাত্র তাঁদেরকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদন করতে হবে, তা হলেই তো সব সমস্যা মিটে যায়! প্রক্রিয়াও সহজ হয়!
রৌনক সাহা
কলকাতা-৪৯
বিড়াল বলে...
এনআরসি আর ক্যাবের বিরোধিতায় গত কয়েক দিন ধরে দেশ উত্তাল! লক্ষ করার বিষয়, সংবাদমাধ্যমে বিরোধীদের নিয়ে যতই ডাকাবুকো বিবৃতি দিক, ২০-১২-১৯ তারিখ থেকেই সরকার কিন্তু পিছোতে শুরু করেছে, নাগরিক পঞ্জির ‘ডকুমেন্টেশন’-এর ব্যাপারে নানা রকম বদল আনছে। হতে পারে, এটা শীর্ষ আদালতে অনুমোদন পাওয়ার কৌশল। কিন্তু নোটবন্দি, অসমের এনআরসির অভিজ্ঞতায় ঘরপোড়া জনগণ এদের কোনও কথাই বিশ্বাসে রাজি নন। আগে বলা কথাগুলো তো এত সহজে ভোলা যায় না। উইপোকাদের নিশ্চিহ্ন করার কথা, বা দু’কোটি লোককে বার করার হুমকির সঙ্গে, এখনকার ‘সবাইকে নাগরিকত্ব দিতে চাই’ গোছের ‘ইনক্লুসিভ’ বক্তব্যের মিল কোথায়? এ যেন, বিড়াল বলে আঁশ ছোঁব না!
একটা জিনিস খেয়াল করতে হবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অনেক দিন ধরে বলছে, অসমে এনআরসি বাতিল, সারা দেশে নতুন করে এনআরসি হবে, কিন্তু এখনও ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে একটা লোককেও ছাড়া হল না!
মানস ঘোষ
হাওড়া