‘কলা এবং মুলো?’ (১-১) শীর্ষক চিঠিতে জানানো হয়েছে, এগুলি ‘বিদেশি’। প্রসঙ্গত জানাই, রসনাপ্রিয় বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় ফল যে আম— তা-ও কিন্তু জন্মসূত্রে বিদেশি। আমের জন্মস্থান দক্ষিণ এশিয়ার মালয় দ্বীপপুঞ্জে। ভারতে ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে ঘন আমবাগান ছিল বলে জানা যায়।
‘রোমান্স অব দ্য ম্যাঙ্গো’ গ্রন্থে লেখক কুসুম বুধওয়ার উল্লেখ করেছেন, বর্মা (এখন মায়ানমার)-র রাজা বীর মহেন্দ্র ব্যাপক ভাবে আম চাষের এলাকা বাড়িয়েছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে। বর্মা মুলুকে চার হাজার বছর আগেও আম চাষের প্রচলন ছিল। সেখানে আমবাগান-ঘেরা গ্রামকে বলা হয় থায়েট ভিলেজ। ‘থায়েট’ শব্দের অর্থ হল আম।
সম্ভবত বর্মা মুলুক থেকেই ভারতে আম চাষ শুরু হয়। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন ৎসাং ভারতের আমের স্বাদ ও গন্ধে মোহিত হয়ে, নিজের দেশে আম পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
সপ্তদশ শতাব্দীতে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকায় (ব্রাজিল, মেক্সিকো) ভারতের আম নিয়ে গিয়ে ব্যবসা এবং আম চাষের পত্তন করেন।
মুঘল সম্রাট বাবর ভারতের উৎকৃষ্ট আমের ফলনে অগ্রণী ছিলেন। বাবরের মতে, আম হল ‘পৌর-ই-হিন্দ’, অর্থাৎ হিন্দুস্থানের সেরা ফল। যদিও বাবরও বিদেশি!
তুষার ভট্টাচার্য
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
শাবাশ মা!
সিএএ-র প্রতিবাদে দুধের শিশুকে নিয়ে রাস্তায় রাত কাটাচ্ছেন রেহানা খাতুন। শীতের রাতে সন্তানের ক্ষতি হচ্ছে, তাই তাঁঁর মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এক পত্রলেখক (‘এ আবার কেমন মা?’, ৩-১)।
সন্তানকে কোলছাড়া না করার মানসিকতা বরং তাঁঁর মাতৃত্বকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ করেছে ৯১ বছরের আসমা বিবির হাত, যা তিনি প্রতিবাদমঞ্চে সেই শিশুর মাথায় রেখেছেন। প্রতিবাদী মা-সন্তান যুগলকে ঘিরে রয়েছেন আরও অনেক প্রতিবাদী নারী, বিভিন্ন বয়সের। সবাই নজর রাখছেন শিশুটির স্বাস্থ্যের দিকে। পুরুষতন্ত্র-নির্ধারিত মাতৃত্বের সঙ্গে এ ধারণা বেমানান বইকি!
তা ছাড়া পত্রলেখককে মনে করিয়ে দিই, ১৪ মাসের আর্যার কথা। তার মা-বাবা তাকে বাড়িতে রেখে বারাণসীর প্রতিবাদমঞ্চে যোগ দেন এবং যোগীর পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে। ১৪ দিন পর তাঁরা ছাড়া পান। এই দু’সপ্তাহ আর্যার কেটেছে অর্ধাহারে, চোখের জলে।
রেহানা খাতুনেরা এই রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করবেন কী ভাবে?
স্বস্তিক মল্লিক
উত্তরপাড়া, হুগলি
কুর্নিশ জানাই
দিল্লির ঠান্ডায় শিশুকে নিয়ে বিক্ষোভে শামিল হলে, শিশুর ক্ষতির কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করাই যায়, কিন্তু গভীর অনুভূতির সঙ্গে বিচার করলেই বোঝা যায়, ওই মা শিশুরই ভবিষ্যতের আরও বড় ক্ষতি এড়াতে ওই বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। তাঁর মাতৃত্বকে তাই এই ক্ষেত্রে সমালোচনা করা উচিত নয়। মায়ের প্রচেষ্টা, এর থেকেও ভয়ানক কষ্টের থেকে নিজ সন্তানকে রক্ষা করা। কুর্নিশ জানাই ওই মাকে। নঞর্থক সমালোচনা না করে, আগামী দিনে যেন মা-দের সন্তান কোলে নিয়ে রাস্তায় না বসতে হয়, বরং সে জন্য আওয়াজ তুলুন।
সুনিতা মুখোপাধ্যায়
চুঁচুড়া, হুগলি
এমন মা চাই
‘‘...যখন প্রকাণ্ড ভূমিকম্পে হর্ম্যরাজি ভেঙে পড়ে, তখন অসূর্য্যম্পশ্যরূপা মহিলা যে, সেও নিঃসংকোচে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।...আজ যে অন্যায় নীতির মহাবিপ্লব, যে দুর্বিষহ অত্যাচার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়ে যাচ্ছে, তা এর পূর্বে বুঝি কুত্রাপি হয় নাই।...দুর্নীতির প্লাবনে কি মানুষের যা কিছু উচ্চ প্রবৃত্তি সব ভেসে গিয়েছে? নীচ স্বার্থ সিদ্ধিই কি মানুষের ধর্মনীতি?’’
এই কথাগুলো বলছেন শাহজাহান কন্যা জাহানারা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’ নাটকের সংলাপ। দরবারে যখন জাহানারা নিজে উপস্থিত হয়ে সর্বসমক্ষে আওরঙ্গজেবের মুখোশ উন্মোচন করছেন, তখন আওরঙ্গজেব এই রকম বলেছিলেন, ‘‘যাও ভগিনী, এই সহস্র চক্ষুর দরবারে তোমাকে শোভা পায় না। এই স্থান তোমার নয়।’’ শঠের যুক্তিগুলো এই রকমই। সব যুগেই। কথাগুলো মনে করাই, ‘এ আবার কেমন মা?’ চিঠির লেখককে।
তাঁকে আমার প্রশ্ন, জমিহারা, জীবিকা ও ভিটেহারা মানুষের ঢল, পোটলা বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে সদ্যোজাত শিশু কাঁখে অজানা ঠিকানার খোঁজে মানুষ চলেছেন দলে দলে— এমন দৃশ্য কি আপনি দেখেননি? সেই দৃশ্য কি খুব সুখদায়ক? তা যদি না হয়, তবে তো এই দিন এড়ানোর জন্য আগেই পথে নামা যুক্তিযুক্ত। আসলে আমরা যারা ভণ্ড, তারা মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তিতে মালা দেব, আর শাহিনবাগে আম্মাদের গাল পাড়ব।
আজ মিথ্যাচারের বান ডেকেছে। মোদীজি এক সভায় বলছেন, ‘‘দেশের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত’’, তার পর রামলীলা ময়দানে বলছেন, ‘‘এখনও কোনও আলোচনা, সিদ্ধান্ত, কিছু হয়নি।’’ অমিত শাহ বলছেন, ‘‘এনআরসি একমাত্র নাগরিকত্ব দেবে’’, আবার প্রধানমন্ত্রীর রামলীলা ময়দানে মিথ্যা ভাষণের পর দিন অমিত শাহ বললেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীই ঠিক বলেছেন, এখনও কোনও আলোচনা হয়নি।’’ প্রধানমন্ত্রী বাবাজির শরণাপন্ন হলেন। সদ্গুরু বললেন, ‘‘ছাত্ররা মূল আইনটা না পড়ে, না জেনে বিরোধিতা করেছে।’’ তার পর পাল্টা প্রশ্নের মুখে জানালেন ‘‘আমি এখনও আইনটা পড়িনি, খবরের কাগজে যা দেখেছি।’’ খবরের কাগজেও শুধু প্রধানমন্ত্রী ও অমিত শাহের কথাগুলোই তিনি পড়েছেন।
এত সব ঘটনার কিছুই না দেখে, পত্রলেখক দেখলেন শীতের শাহিনবাগের মায়ের নিষ্ঠুরতা! মা-দাদির বিপন্নতা নজরে পড়ল না? যে দেশে সন্তানের সামনে মাতা ধর্ষিতা হন, মায়ের সামনে সন্তান, সেই বাস্তবতায় এমন মা-দাদি-আম্মাই তো চাই।
মালবিকা মিত্র
হুগলি
প্রকৃত মাতৃত্ব
আসলে, এই মায়েরা সেই মাতৃত্বের অধিকারী, যাঁরা কেবল নিজের সন্তান নয়, সন্তানসম সবাইকে তাঁর নিজের সন্তান হিসেবে দেখতে শিখেছেন। রেহানারা ভাবেন, যে পরিকল্পনা সরকারের পক্ষ থেকে রচিত হয়েছে তা আমার সন্তান-সহ কত শত সহস্র সন্তানকে, দেশবাসীকে গভীর তমসাচ্ছন্ন দিনগুলির দিকে টেনে নিয়ে যাবে। এই ভাবনা এবং তদনুযায়ী পদক্ষেপ মাতৃত্বের অপমান নয়, এ হল মাতৃত্বের যথার্থ স্বীকৃতি।
এমন মায়েদের আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এ দেশে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের অগ্নিক্ষর দিনগুলিতে। আজ দেশব্যাপী যে সঙ্কট, তার মোকাবিলা করার প্রয়োজন আছে কি নেই সে নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তবে প্রয়োজন থাকলে, সমস্ত পিছুটান উপেক্ষা করে এগিয়ে আসতে তাঁরাই পারেন, যাঁরা চরিত্রে, মহত্ত্বে, ঔদার্যে এই আত্মসর্বস্ব সমাজ-মানসিকতাকে পরাস্ত করতে পেরেছেন।
যে আমি এত কথা বলছি সেই আমি সমাজের এমন আহ্বানে কতখানি সাড়া দিতে পারব জানি না। সেই পরীক্ষায় বসলে হয়তো ডাহা ফেল করব। কিন্তু সেই পরীক্ষায় যিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ, তঁাকে স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য থাকবে কেন?
গৌরীশঙ্কর দাস
সাঁজোয়াল, খড়্গপুর