‘গাঁধীজি কেন প্রাসঙ্গিক’ (২-১০) নিবন্ধে দীপেশ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘‘যাঁকে ঘিরে এত প্রশ্ন, এত সন্দেহ, তাঁকে প্রতি বছর স্মরণ করা কেন?’’ এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। গাঁধী-বিরোধিতার যুক্তি যা-ই থাক, গাঁধীকে এড়িয়ে চলা কখনওই সম্ভব নয়। গাঁধী ছিলেন প্রবল ধর্মপ্রাণ মানুষ। আবার তিনিই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এ কথা আমরা ভুলব কেমন করে? আহার-বিহার-মৈথুনে আমরা বন্দিজীবন কাটাই, ইন্দ্রিয়নির্ভর হয়ে বাঁচি। অথচ গাঁধী ৩৭ বছর বয়সেই যৌন জীবন ত্যাগ করেছিলেন। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।
খাদ্যাভ্যাসের ধরনেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী। গরুর দুধের বদলে ছাগলের দুধকে তিনি পানীয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তার কারণ, যথেষ্ট পরিমাণ দুধ সংগ্রহের তাগিদে গো-মহিষদের ওপর যে নিষ্ঠুরতা আরোপ করা হত গাঁধীজি তা মানেননি। ছাগলের দুধ সম্পর্কেও গাঁধীর সতর্কবাণী জারি ছিল। ‘‘আমার জন্য ছাগলের দুধ জোগাড় করতে গিয়ে আপনারা যেন দরিদ্র মায়েদের তাঁদের শিশুদের দুধ থেকে বঞ্চিত না করেন। এ রকম করলে সে দুধ আমার কাছে বিষতুল্য।’’ আহার্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি কত দূর বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন এ উক্তিতে তার প্রমাণ মেলে।
নজরুলের ‘গায়ে মাতা কি জ্বর!’ ব্যঙ্গরচনা থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করা যাক: ‘‘সম্প্রতি এক মজার খবর এসেছে। মহাত্মা নাকি তার আশ্রমের একটি রোগ-যন্ত্রণায়-ক্লিষ্টা বকনকে সূচিকাভরণ (ইনজেকশন) দিয়ে মেরে ফেলেছেন। এ নিয়ে গুজরাতের হিন্দুরা গুজরাতি হাতির মতো ক্ষেপে উঠেছে। গান্ধী তাদের চরকা নিয়ে তাড়া করে বলেছেন, এ সবের মানে তোমরা বুঝবে না বাপু! যে আর কিছুতেই বাঁচবে না— সে মানুষই হোক আর গোরুই হোক— তাকে তাড়াতাড়ি ভবযন্ত্রণা থেকে রেহাই দেওয়াই বেশি দয়ার কাজ!’’ ইঙ্গিত স্পষ্ট। মহাত্মাকে এ ক্ষেত্রে বাস্তববাদী বলেই গণ্য করা হয়েছে এবং তাঁর চিন্তা বা কাজ গো-মাতার সন্তানদের খুশি করতে পারেনি। তাঁর এ পরিচয় কি ভোলা যায়!
গাঁধী নির্দেশিত হরতাল-বিধি কেমন ছিল? গাঁধীবাদী ফর্মুলা হল: কর্মবিরতি যে হেতু স্বেচ্ছামূলক, কাজেই হরতালের দিন কাউকে হরতাল পালনের জন্য পীড়াপীড়ি করা চলবে না। এমনটা যদিও সচরাচর ঘটে না, বন্ধ-সমর্থকরা বন্ধের দিন গাঁধীগিরি ফলায় না, জোরজবরদস্তি-মানা হরতাল কি আমরাও চাই? নিঃসন্দেহে না। বাপুজি তো তবে আমাদের মনের কথাই বলেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘‘আমি কল্পনাবিলাসী নই। নিজেকে আমি বাস্তব আদর্শবাদী বলে দাবি করি। অহিংসাধর্ম কেবল মুনিঋষিদের জন্য নয়। সাধারণ মানুষের জন্যও বটে।’’ সমাজতত্ত্ববিদের মতে, নাগরিক সমাজ তো এমন এক পরিসর যা অহিংসা, বিনয় ইত্যাদি মানবিক গুণ দ্বারা চালিত হয়। গাঁধীজি তো এক নৈতিক নাগরিক সমাজের কথাই বলতেন। তবে আমরা তাঁর কথা ভুলে যাব কেন?
কবিকে উদ্ধৃত করে শ্রীচক্রবর্তী লিখেছেন, ‘‘শুনিই তো, লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।’’ আজকাল উন্নয়ন-সন্ত্রাস কথাটাও অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ ব্যবহার করেন। গাঁধীজি এ উন্নয়নের বিরোধী ছিলেন। বা হিংসার যে রাজনীতি, যার প্রভাবে দেশের ৬০৭টি জেলার মধ্যে প্রায় ১৬০টি উগ্রপন্থী নকশাল আন্দোলনের প্রভাবাধীন— সে রাজনীতি থেকে রেহাই মিলবে কেমন করে? এ প্রশ্ন যদি তোলা হয়, গাঁধীর অহিংসা-নীতির আলোচনা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
গাঁধী-আদর্শ দাঁড়িয়ে আছে এক ধরনের Desirelessness বা অনভিলাষিতার সাধনাকে ভিত্তি করে। যৌনতা, খাদ্যাভ্যাস, রাজনীতি এবং প্রযুক্তি— এই চারটি বিষয়ে গাঁধীজির নিজস্ব ধ্যানধারণা ছিল, যার কোনওটাই আমরা গ্রহণ করিনি, কিন্তু এ সমস্ত বিষয়ে তাঁর ভাবনাকে কি আমরা নির্দ্বিধায় নাকচ করতে পেরেছি? না। গাঁধীর প্রাসঙ্গিকতা সে কারণেই কখনও ফুরোয় না।
শিবাশিস দত্ত
কলকাতা-৮৪
দায় ছিল না?
গৌতম ভদ্রের ‘রাজনীতি তাঁর কাছে ছিল সত্যের প্রয়োগ’ শীর্ষক গাঁধী বিষয়ক লেখাটির (রবিবাসরীয়, ৩০-৯) প্রতিক্রিয়ায় এই চিঠি। লেখার শেষ কয়েকটি লাইন এই রকম: ‘‘৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮। সকালে উঠেই গাঁধী সব জরুরি চিঠির উত্তর দেওয়া তাড়াতাড়ি শেষ করলেন, কেন যেন মনে হচ্ছে যে আগামী কাল আর দেখতে পাবেন না। বিকেল পাঁচটায় গাঁধী প্রার্থনাসভায় যোগ দেওয়ার সময় তিনটে বুলেটে বিদ্ধ হলেন, শেষ স্বর শোনা গেল ‘হা রাম’।’’
মহাত্মাকে যে সে দিন মরতে হল, তার পিছনে তৎকালীন ভারত সরকারের কি কোনও দায় ছিল না? মহাত্মার প্রিয় শিষ্যদের দায় ছিল না? স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই কি তিনি বাতিল হয়ে যাননি নেহরু-পটেল সরকারের ভিতর থেকে?
দশ দিন আগে, ১৯৪৮-এর ২০ জানুয়ারি গাঁধীজিকে হত্যা করার একটি চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। সে দিন সন্ধ্যায় দিল্লির বিড়লা হাউসে প্রার্থনার শেষে গাঁধীজি যখন ভাষণ শুরু করেছিলেন, তখন মদনলাল পাহ্ওয়া নামে এক জন চক্রান্তকারী একটি গানকটন স্ল্যাব বিস্ফোরণ ঘটান— গাঁধী যেখানে বসেছিলেন, সেখান থেকে ৭৫ ফুট দূরে। পরিকল্পনা ছিল, ওই বিস্ফোরণের আওয়াজে ভিড় যখন একটু পাতলা হবে, তখন আপ্তে ও গডসের সঙ্কেত পেলে বাডগে ও কিস্তায়া গাঁধীকে রিভলবার থেকে গুলি করবে।
কিন্তু ওই বিস্ফোরণের পর তারা ভয় পেয়ে যায় এবং সভা থেকে একটু দূরে দাঁড় করানো একটি ট্যাক্সিতে উঠে পালিয়ে যায়। কেবল সুলোচনা দেবী নামে এক জন মহিলার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে ধরা পড়ে পাহ্ওয়া এবং তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
সরকারের তরফ থেকে এই চক্রান্তের রহস্যভেদের কতটা চেষ্টা হয়েছিল, তা গবেষণার বিষয়। হত্যার এই চক্রান্ত যে অনেক দিন থেকে দানা বাঁধছিল, তাতে সন্দেহ নেই। সরকারের তৎপরতায় কি ৩০ জানুয়ারির দুর্ভাগ্য এড়ানো যেত না?
মৃণাল ঘোষ
কলকাতা-১১০
গাঁধী ও চ্যাপলিন
দীপেশবাবুর নিবন্ধে গাঁধীজির যন্ত্র-বিরোধিতার কথা লেখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ১৯৩১ সালে লন্ডনে চার্লি চ্যাপলিন ও গাঁধীজির সাক্ষাতের কথা মনে পড়ে। চ্যাপলিন গাঁধীকে বললেন, ‘‘...যন্ত্র যদি ঠিক অর্থে ব্যবহৃত হয়, তা হলে সেটা তো জনগণের পক্ষে আশীর্বাদই বলা যেতে পারে। ...এতে আপনাদের অসুবিধা কী?’’ গাঁধীজি বললেন, ‘‘ঠিকই। ...কিন্তু ভারতের এখনও সে লক্ষ্যে পৌঁছনোর সময় হয়নি। ...ইংরেজ আগে আমাদের দেশ থেকে চলে আসবে। যন্ত্রের ব্যবহার তো এত দিন বিস্তর দেখলাম। যন্ত্র আমাদের দিনকে দিন করে তুলছে ইংল্যান্ডের মুখাপেক্ষী। আমরা আর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চাই না। তাই আহ্বান জানিয়েছি যন্ত্রজাত জিনিস বর্জন করতে।... তা ছাড়া...ভারত আর ইংল্যান্ডের জলবায়ু ভিন্ন প্রকৃতির। ইংরেজ আর ভারতীয়দের আচার-আচরণেও যথেষ্ট পার্থক্য আছে। যে জিনিসটা এখানে দরকার, সেটার প্রয়োজন আমাদের ওখানে যে থাকবেই এমন কোনও কথা নেই। জোর করে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার একটা ব্যাপার আছে।’’ চ্যাপলিন আত্মজীবনীতে এটি উল্লেখ করে লিখছেন, ‘‘ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হল এত ক্ষণে। কৌশলের দিক এটা— লড়াইয়ে জিতবার এক প্রধান অবলম্বন।’’
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা-১৩৫
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
ভ্রম সংশোধন
‘বেতারের প্রাণপুরুষ’ নিবন্ধে (পত্রিকা, ৬-১০) ভুলবশত লেখা হয়েছে ‘বসন্তেশ্বরী’ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় ১৯৩১ সালে। প্রকৃতপক্ষে তা ১৯৩২ সালের এপ্রিলে প্রচারিত হয়। একই নিবন্ধে ১৯৭৬ সালে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম্’ লেখা হলেও ঠিক নামটি ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।