Language Conflict

সম্পাদক সমীপেষু: সংযোগের ভাষা চাই

যথার্থই বলা হয়েছে যে, “গুজরাতে গুজরাতি, ওড়িশাতে ওড়িয়া, দক্ষিণে তামিল তেলুগু কন্নড় মালয়ালমই বলা হবে প্রথমত ও শেষ পর্যন্ত। এই ভাষাবৈচিত্রই ভারতের সম্পদ, দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনারও ভিত্তি সেখানেই।”

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৪:০৯
Share:

সম্পাদকীয় ‘ভাষার দেওয়াল তুলে’-তে (১-১২) বলা হয়েছে, এখন বনামতন্ত্রই শেষ কথা। বনামতন্ত্র যে চলছে— একশো ভাগ সত্য। কিন্তু এর জন্য নাগরিক সমাজ আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাচ্ছে, সেটা অংশত সত্য।

Advertisement

যথার্থই বলা হয়েছে যে, “গুজরাতে গুজরাতি, ওড়িশাতে ওড়িয়া, দক্ষিণে তামিল তেলুগু কন্নড় মালয়ালমই বলা হবে প্রথমত ও শেষ পর্যন্ত। এই ভাষাবৈচিত্রই ভারতের সম্পদ, দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনারও ভিত্তি সেখানেই।” এই যুক্তি তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে ভালই লাগে। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে? ধরা যাক, ভারতের দশটি রাজ্যের দশ জন সাধারণ নাগরিক এক স্থানে সমবেত হয়েছেন। তাঁদের কেউই মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানেন না। তাঁদের মধ্যে সংযোগ গড়ে উঠবে কী করে? কেউ তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবেন না। অতএব বৈচিত্র সব সময় সম্পদ নাও হতে পারে, বিশেষত মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে।

ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগের একটি সাধারণ ভাষা থাকা জরুরি— তা সে হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি যা-ই হোক না কেন। তার জন্য একটি বিশেষ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়োজন নেই। সম্পাদকীয়তে ঠিক ভাবে বলা হয়েছে “...একটিমাত্র ভাষাকেই প্রতিষ্ঠা দিতে চাইলে বুঝতে হবে তারা হয় বিভ্রান্ত, কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিপথে চালিত।” কিন্তু বিভিন্ন ভাষাভাষী ভারতীয়ের মধ্যে একটি বা দু’টি ব্যবহারিক সাধারণ যোগাযোগের ভাষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সম্পাদকীয়তে অনালোচিত থেকে গেল। গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকীয়টি কিন্তু দেওয়ালটার ও-পারে কোনও আলোর রশ্মি ছড়াতে পারল না। মনে করুন, উত্তরাখণ্ডের কোনও এক প্রান্তিক স্টেশনে কেবল দু’জন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। দুই মা— এক জন মণিপুরি ও অন্য জন বাঙালি। কেউ কাউকে তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারছেন না। একুশ শতকের ভারত দেশটির সাধারণ নাগরিকের মধ্যে তা হলে ‘ভাষার দেওয়াল’টাই সত্য হবে?

Advertisement

প্রদীপ বাগচি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া

শ্রদ্ধা ফিরুক

সম্পাদকীয় ‘ভাষার দেওয়াল তুলে’র পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। দেশ-এ (১৭-০১-২০০৭) পুনঃপ্রকাশিত একটি পুরনো লেখায় পাচ্ছি, “শ্রীযুত মজিবর রহমান বি.এ পাবনা হইতে লিখিতেছেন, “সম্প্রতি কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে যে অপ্রীতিকর ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে, তাহার উপযুক্ত প্রতিবাদ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশেরই বুকের উপর দাঁড়াইয়া বাঙ্গালী ছাত্রদিগকে এরূপভাবে অপমানিত ও নির্য্যাতিত করিবার স্পর্দ্ধা প্রকৃতই অভিনব। উর্দ্দু ভাষাভাষীদের বাঙ্গলা ভাষার প্রতি এইরূপ আক্রোশের কারণ কি? বাংলার সাহিত্য সম্পদের কথা না হয় ছাড়িয়াই দিলাম, উহা যে তিন কোটি মুসলমানের মাতৃভাষা। এই হিসাবে উক্ত ভাষা অন্যান্য ভাষাভাষী মুসলমানদের নিকট সম্মান দাবী করিতে পারে। অথচ সেদিন উচ্চপদস্থ অধ্যক্ষ হইতে আরম্ভ করিয়া অন্যান্য প্রদেশ হইতে আগত ছাত্রবৃন্দ পর্যন্ত্য উক্ত ভাষা এবং উহার সেবকবৃন্দের প্রতি যে রূপ ব্যবহার করিয়াছেন তাহা বাঙ্গালীর বুকে চিরদিনের ক্ষতের ন্যায় বিরাজ করিবে। আমি এ বিষয়ে প্রথমত বাঙ্গলার তিন কোটি মুসলমানের এবং পরে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। স্মরণ রাখিতে হইবে যে, আমরা বাঙ্গালী বাঙ্গলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে যাহারা অবমাননা করিবার প্রয়াস পায়, হিন্দু মুসলমান নির্ব্বিশেষে সমস্ত বাঙ্গালী জাতি কখনই তাহাদিগকে প্রীতির চক্ষে দেখিবে না।””

ধর্ম এবং জাতপাতের ভিত্তিতে অতীতের হাত ধরেই ভাষাগত হিংসা বিদ্যমান। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের বিভাজন এবং আন্দোলনকারীদের রক্তপাত কখনও ভোলা যাবে না। ভারতে ভাষা বৈচিত্রে রামধনু সংস্কৃতির হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ঐক্যের বাতাবরণ তৈরিই একমাত্র লক্ষ্য। বিবিধ ভাষাভাষীর দেশে ভারতের রাষ্ট্রভাষা ‘হিন্দি’ এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা জনমানসে প্রচলিত আছে। অথচ ভারতের কোনও একক ‘রাষ্ট্রভাষা’ নেই।

একটি ভাইরাল ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, দুই সহযাত্রিণীর তর্কবিতর্কের সময় এক জন অপর জনকে বলেছেন, এটা ভারত এখানে হিন্দি জানতে হবে। অন্য জন বলেছেন, আমি বাঙালি, আমি ভারতীয়, এটা আমার মাটির ভাষা। রাস্তাঘাটে জনপরিসরে একটি বহু ভাষাভাষীর রাষ্ট্রে জনসাধারণের মধ্যে এমন বিভেদকামী মনোভাব কাঙ্ক্ষিত নয়। জাতীয় সঙ্গীতে উল্লিখিত পঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাত, মরাঠা, দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গ প্রভৃতি সব প্রদেশেরই নিজস্ব মাটির ভাষা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের শাসক দলের এক দেশ, এক ভোট, এক ধর্ম, এক ভাষার অভিমুখে ধাবিত হতে চাওয়া ভারতের একটি অংশের জনগণ হিন্দিকেই মান্যতা দিতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন যথাযথ না হওয়ার কারণেই অনেক সময় হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। এর কারণ হিসাবে বলা যায় যে বাঙালিদের মাতৃভাষা এবং আপন সংস্কৃতির প্রতি চরম অবহেলা অনেকাংশেই দায়ী। আমি কলকাতার অফিস-ফেরত সময়ের ঠাসাঠাসি মেট্রো রেলে বসার আসন নিয়ে দুই বাঙালিকে কামরায় ইংরেজিতে তর্কাতর্কি করতে দেখেছি। প্রথমটায় এক পক্ষ বাংলাতেই তর্ক চালাচ্ছিলেন, কিন্তু ধারে-ভারে হেরে যাওয়ার ভয়ে বা অন্য পক্ষের ইংরেজি কথনে উদ্দীপিত হয়ে বিদেশি ভাষাতেই তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। আর দেশীয় ভাষায় সাম্প্রতিক তর্কবিতর্কের জের এবং হিন্দি না জানার অপরাধে বাংলা ভাষার প্রতি অবমাননা অত্যন্ত কুরুচিকর। কারণ ভারত নামক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সকলের মাতৃভাষাই সম-মর্যাদার। বিদ্বেষ-বিভাজনের আজকের ভারতে সবেতেই যে একের সঙ্গে অন্য পক্ষকে লড়িয়ে দেওয়ার হীন মানসিকতা কাজ করছে, সেটিকে সবার আগে নিরাময় করতে হবে।

সম্প্রতি কলকাতা পুরসভা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং থেকে দোকানের সাইনবোর্ড, সরকারি দফতরের নামের বোর্ড থেকে রাস্তার নামফলক— সবই অন্য ভাষার সঙ্গে বাংলাতেও লিখতে হবে। অতীতেও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নামফলকে বাংলা থাকা নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল। কিছু জায়গায় অত্যুৎসাহীদের দ্বারা ভাঙচুরও ঘটেছিল। তখন অনেকেই আন্দোলনকারীদের একাংশকে প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট বলেছিলেন। তাই শুধুমাত্র নামফলকে বাংলা ভাষার ব্যবহারই যথেষ্ট নয়, কাজের ভাষা হিসাবে বাংলাকে শিক্ষার্থীদের মনের গভীরেও পৌঁছে দিতে হবে। এ ভাবেই চর্চার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলাকে যথাযোগ্য সম্মানের আসনে বসাতে পারলেই বাঙালি মাতৃভাষার প্রতি ঔদাসীন্যের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে। পশ্চিমবঙ্গের বহু ভাষাভাষীর ক্ষেত্রগুলি অর্থাৎ শহর-শহরতলি সন্নিহিত এলাকায় অন্য ভাষাভাষীদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রেও মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রাধান্য সম্পর্কে নিজেদেরই সশ্রদ্ধ এবং ওয়াকিবহাল হওয়া জরুরি।

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

ভুল পথে

স্বাধীনতার পরে দেশে যে সমস্যাটি আজও অমীমাংসিত— তা হল ভাষা। ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠন স্বাধীনোত্তর ভারতেই হয়েছে। ভাষা আগ্রাসনও তো চাপিয়ে দেওয়াই, তাও হিংসার পথ প্রশস্ত করে। সে জায়গায় মাতৃভাষাকে যদি অবহেলার শিকার হতে হয় তা হলে এই হিংসার ভিতই ‌অলক্ষ্যে পোক্ত হয়। আমাদের রাজ্যের অর্থনৈতিক বিপণনের ভিত বাঙালিদের হাতে কতটা আছে তা ভাবা দরকার। সেখান থেকে আধিপত্যবাদী মানসিকতা গড়ে উঠছে যা ভাষার ব্যবহারিক সঙ্কট বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ক’জন বাঙালি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছেন? বহু ক্ষেত্রে দেখি বাংলা বলায় অনীহা। মাতৃভাষার চর্চা আর পালন ইংরেজি মাধ্যমে পাঠগ্রহণের রমরমায় অনেকটাই উপেক্ষিত। এ তো ঠিকানা আর পথ হারিয়ে ফেলার শামিল।

আব্দুল জামান নাসের, চন্দননগর, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement