বিরোধীদের বক্তব্য, মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করতেই এনআরসি প্রক্রিয়া।
প্রতি বছরই বিশ্বের ১৬৫টি স্বাধীন দেশ ও দু’টি অঞ্চলের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে সমীক্ষা চালায় দি ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। ইআইইউ-র সমীক্ষায় বিশ্ব গণতান্ত্রিক সূচকে ১০ ধাপ নেমে গেল ভারত। পাঁচটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় গণতন্ত্র সূচক- নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং বহুত্ববাদ, সরকারের ভূমিকা, রাজনৈতিক যোগদান, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক স্বাধীনতা। ভারতের গণতন্ত্র সূচক কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ, নাগরিক স্বাধীনতার অবক্ষয়। সামগ্রিক নম্বর অনুযায়ী মোট চারটি বিভাগে ভাগ করা হয় দেশগুলিকে। যে সব দেশের স্কোর ৮-এর বেশি তারা ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’-এর তালিকাভুক্ত, ৬-এর বেশি কিন্তু ৮-এর সমান বা কম স্কোর ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’, ৪-এর বেশি কিন্তু ৬-এর সমান বা কম স্কোর ‘মিশ্র শাসনতন্ত্র’, আর যেসব দেশের স্কোর ৪-এর কম, তাদের ‘একনায়কতন্ত্র’ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১৯-এর গণতন্ত্র সূচকে ভারতের স্কোর ৬.৯০, অর্থাৎ ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’। গত কয়েক বছরের তথ্য বলছে, ২০০৬ সালের পর গণতন্ত্র সূচকে এটাই ভারতের সর্বনিম্ন স্কোর, অর্থাৎ ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ভারতীয় গণতন্ত্রে এই অবক্ষয়ের প্রথম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের কথা। রিপোর্টে উল্লেখ আছে, “এই পদক্ষেপের আগে কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু-কাশ্মীরে বিপুল সংখ্যক সেনা পাঠিয়েছে, চাপানো হয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত একাধিক বিধিনিষেধ। স্থানীয় নেতাদের গৃহবন্দি করা হয়েছে। এমনকি জম্মু-কাশ্মীরে ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ রাখা হয়েছে।” এ ভাবে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা নিয়ে গত সপ্তাহে কেন্দ্রকে ভৎসনা করেছে সুপ্রিম কোর্টও। বিরোধী দলগুলির সমালোচনার পাশাপাশি অনির্দিষ্টকালের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ রাখাকে বাকস্বাধীনতার বিরোধী বলে উল্লেখ করেছে শীর্ষ আদালত। গণতন্ত্র অবক্ষয়ের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কারণ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে সিএএ এবং এনআরসির প্রসঙ্গ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “অসমে এনআরসি তালিকা থেকে কমপক্ষে ১৯ লক্ষ লোক বাদ গিয়েছেন। বিরোধীদের বক্তব্য, মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করতেই এনআরসি প্রক্রিয়া। এর ফলে ধর্মের ভিত্তিতে জনবৈচিত্রে ব্যাপক বদল ঘটাবে। নতুন নাগরিকত্ব আইনও মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতে ছড়িয়েছে প্রতিবাদ, সাম্প্রদায়িক অশান্তি।” নয়া নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, ২০১৪-এর ৩১ ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা অ-মুসলিম শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের এই আইনকে ‘সংবিধান বিরোধী’ বলে উল্লেখ করে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়েছে প্রায় সব রাজ্যেই। ব্রিটেন, জার্মানির অনাবাসী ভারতীয়রাও সিএএ-র প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। বুধবারই এ সংক্রান্ত ১৪৪টি মামলার শুনানিতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে কেন্দ্রের অবস্থান জানতে চেয়েছে শীর্ষ আদালত। আইনের উপর স্থগিতাদেশ না দিলেও চাপ বেড়েছে কেন্দ্রের উপর। যে কারণে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশ। ২০১৯-এর সূচকে চিনের সামগ্রিক নম্বর ২.২৬। সূচকে চিনের অবস্থান ১৫৩তম স্থানে। শিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের পাশাপাশি নাগরিকদের উপর ডিজিটাল পদ্ধতিতে নজরদারিই চিনকে ‘একনায়কতন্ত্র’ করেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। প্রতিবেশী পাকিস্তানের স্থান ১০৮। তাদের সামগ্রিক নম্বর ৪.২৫। ৬৯-তম স্থানটি শ্রীলঙ্কার। তাদের সামগ্রিক নম্বর ৬.২৭। বাংলাদেশ রয়েছে ৮০-তম স্থানে। সে দেশের সামগ্রিক নম্বর ৫.৮৮। সূচকের শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। দ্বিতীয় স্থানে আইসল্যান্ড এবং তৃতীয় স্থানে সুইডেন। প্রথম দশের মধ্যে থাকা বাকি দেশগুলি হল নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং সুইৎজারল্যান্ড যারা যথাক্রমে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম এবং দশম স্থানে আছে। তালিকার একদম শেষে, ১৬৭-তম স্থানে রয়েছে উত্তর কোরিয়া। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ১০ ধাপ নেমে ৫১তম স্থানে এল ভারত যা ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ তালিকাভুক্ত। ভারতের পিছনে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চিন। মার্কিন ভাষাবিদ নোওম চমস্কি বলেছেন, ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদী লক্ষণ স্পষ্ট। কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক অসাম্যকে দায়ী করেছেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতেও গণতন্ত্রের অবক্ষয়ে এই আক্ষেপের সুর শোনা গিয়েছে।
সাগরময় অধিকারী, ফুলিয়া