‘ভয়ঙ্কর’ (১২-৮) সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। সরকারি পরিষেবা প্রদানের জায়গাগুলির কর্মসংস্কৃতি, পরিকাঠামো এবং পরিচালনা এক ভয়ঙ্কর নৈরাজ্যের উদাহরণ। দুর্ঘটনা ঘটলেই বিশৃঙ্খল চেহারাটি বেরিয়ে পড়ে। সরকারি হাসপাতালের স্নাতকোত্তর ছাত্রী তথা তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুন হওয়ার পরবর্তী ঘটনা-পরম্পরায় কোনও রদবদল চোখে পড়ল না। রাজ্যে যে কোনও অপরাধ ঘটার পরে দেখা যায়, শাসকের তরফে পরবর্তী পদক্ষেপের একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থাকে, এবং একটি সুনির্দিষ্ট নকশা দেখা যায়। শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী, আধিকারিক এবং পুলিশ প্রশাসন ওই নকশার হুবহু অনুসরণ করার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যান।
পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার দময়ন্তী সেন বলেছিলেন, ধর্ষণ ঘটেছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু থেকেই তা অস্বীকার করেছিলেন। ধর্ষণের অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার যে পাঠ প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে এক বার পড়িয়ে ফেলা হয়েছে, সেটির বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আর কারও কিছু বলার থাকে কি? কামদুনি হোক কিংবা পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড অথবা সাম্প্রতিক আরজি কর, সমস্ত ধর্ষণের ঘটনাই প্রাথমিক ভাবে সরকারের তরফে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। রাজনৈতিক এবং সামাজিক চাপের উপর নির্ভর করে সরকার তথা প্রশাসনের পদক্ষেপের অভিমুখ কি আগামী দিনে এমনই ঢিলে-ঢালা ভাবে চলবে?
আসলে প্রশাসনিক ফাঁকফোকরগুলিই অপরাধপ্রবণ মানসিকতাকে উদ্দীপিত করে তোলে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে ক্যামেরা নেই, সার্ভেল্যান্স আছে অথচ হার্ড ডিস্ক নেই, হার্ড ডিস্ক আছে, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেটিতে ভিডিয়ো ক্লিপ উধাও, ক্যামেরা আছে অথচ কাজ করে না ইত্যাদি অজুহাতে অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যায়। এই ঘাটতি এবং ঔদাসীন্য অপরাধীরা জেনেই অপরাধ সংগঠিত করার সাহস পায়। এনআরএস-এর ছাত্রাবাসে দশ বছর আগে মানসিক ভারসাম্যহীন কোরপান শাহকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। ধনীর দুলালদের কর্মজীবনে ক্ষতির অজুহাতে এবং প্রমাণের অভাবে সকলকেই ছাড় দেওয়া হয়েছিল। সেটিও কম বড় অপরাধ ছিল না।
পিনাকী রুদ্র, কলকাতা-১২৪
ব্যক্তির স্বাধীনতা
দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘স্বাধীনতা, তুমি কার?’ (১৫-৮) শীর্ষক প্রবন্ধ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সাতাত্তর বছর আগে এ দেশ পরাধীনতার হাত হতে মুক্তি পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতা? না, ছিল না। আজও তা অমিল। যেন তেন প্রকারেণ নির্বাচনের জয় চাই। হোক না সে হিংসা, দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ, খুন, লুটতরাজ, বুথ দখল, শাসানি দ্বারা অর্জন। আজ আরজি কর হাসপাতালে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি একটি সরকারি চিকিৎসালয়ের মধ্যে হয়েছে বলে সবার গোচরে এসেছে। সারা দেশ জুড়ে এত হইচই হচ্ছে। এমন বর্বরোচিত ঘটনা প্রতিনিয়ত গ্রামে-গঞ্জে হচ্ছে। যেটা সবার নজরে আসে, সেটা নিয়েই হইচই প্রতিবাদ হতেই থাকে। তাতে কি সরকারের টনক নড়ে? তবু মানুষ আজও প্রতিবাদে রাস্তায় নামে, বিক্ষোভে শামিল হয়। আসলে এমন ঘটনা দেখতে দেখতে বিতৃষ্ণায় রাজনীতিকে মানুষ ঘৃণার চোখে দেখছে। কারণ লক্ষ করলে দেখা যাবে, যেখানে যত অপ্রীতিকর, অনৈতিক, অমানবিক ঘটনা ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে, তা সবই স্বার্থ চরিতার্থের রাজনীতির কারণে, অর্থাৎ রাজনীতির দাদাদের ছত্রছায়ায় বা নির্দেশে। লোভ-লালসার রাজনীতিতে চোখ রাঙানো এ বার বন্ধ হোক। বর্তমান রাজনীতির হালচাল দেখে মনে হয়, স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক নেতাদের জন্য। সাধারণ মানুষকে পরাধীনতার জালে আজও আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে হিংসার বাতাবরণ ছড়িয়ে। নেতাদেরই শাসানিতে আজ ব্যক্তি স্বাধীনতা বিপন্ন। দেশ জুড়ে মোমবাতি জ্বেলে, শঙ্খধ্বনি দিয়ে, রাত দখলকারী মহিলাদের গণপ্রতিবাদ বা বিক্ষোভ অনুষ্ঠান সফল হয়েছে। তাঁরা ডাক দিয়েছেন, জাগো, ওঠো, সমবেত হও। এমনটাই প্রয়োজন। সঙ্গে প্রয়োজন সাধারণ মানুষের বিবেকদংশন ও সুস্থ ও রুচির জাগরণ।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
অচল পুলিশ
১৪ ও ১৫ অগস্টের সন্ধিক্ষণে যখন মেয়েরা এবং মহিলারা দখল নিতে শুরু করেছেন মধ্য রাতের রাস্তা এই বিরামহীন নারী-নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে, তখন অতর্কিতে কিছু দুষ্কৃতীর দল আরজি কর হাসপাতালে বেলাগাম ভাঙচুর চালাল। পুলিশের তরফ থেকে ঠেকানোর কোনও প্রচেষ্টা দেখা গেল না। দেখে মনে হল পুলিশের উপর এ রকমই নির্দেশ ছিল। ভেন্টিলেটর থেকে নানা জিনিসপত্র, জরুরি মেডিসিন খোয়া গেল। পুলিশ আশ্রয় নিল মেয়েদের টয়লেটে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোনও এফআইআর করা হল না বাইশ ঘণ্টার মধ্যে। কারা এ কাজ করল তা পুলিশের গতিবিধি দেখেই যে কেউ বুঝতে পারবেন। আমরা দেখেছি যে শাসক দলের আন্দোলনে পুলিশ কী ভাবে ফাইলের আড়ালে মুখ ঢেকে ছিল। তরুণী ঘনিষ্ঠ এক সহপাঠীর কথা থেকে জানা যায় ওই তরুণী স্বাস্থ্যভবনে হসপিটাল কর্তৃপক্ষের মদতে চলা বিভিন্ন অপকর্মের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছিলেন, কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি। শোনা যাচ্ছে, ওই তরুণী চিকিৎসক যখন এ সব কথা সমাজমাধ্যমে ভাইরাল করার কথা ভাবছিলেন, তিনি হাসপাতালের অশুভ চক্রের রোষানলে পড়ে যান। প্রতিবাদ করতে গিয়ে আর কত জনকে হারাতে হবে, জানি না। কামদুনি, মধ্যমগ্রাম ও হাঁসখালির কিশোরী বিচার পেল না! আরজি করের চিকিৎসক পাবেন কি?
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
চক্রান্তের জের
যারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য হাসপাতালে এই জঘন্য ভাঙচুর করল, তারা এক বারও ভেবে দেখল না যে, তাদের বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে কী করে পরিষেবা পাবে? এরা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত করে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, যাতে রাজনীতির রং লাগানো যায়। এটুকুই সান্ত্বনা যে, তরুণী চিকিৎসকের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু আমাদের এক ছাতার তলায় এনে দিয়েছে, যা আগামী দিনে আরও জোরদার হবে।
দেবাশিস গোস্বামী, কলকাতা-১৩৫
সুবিচারের দাবি
‘স্বাধীনতা, তুমি কার?’ প্রবন্ধের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। কলকাতায় ধর্ষণ করে খুন করা হল এক তরুণী চিকিৎসককে। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এই নারকীয় খুনের প্রতিবাদে জনরোষ আছড়ে পড়ে বাঁধভাঙা জলস্রোতের মতো। মধ্যরাতে রাজপথগুলো হাজার হাজার নারী-পুরুষের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে ছিল মুখরিত। মুখে ছিল দ্রুত অপরাধীদের গ্রেফতার করতে হবে, কলেজ কর্তৃপক্ষকে তদন্তের আওতায় আনতে হবে, সর্বক্ষেত্রে মহিলাদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি বিধানও ছিল দাবির তালিকায়। লক্ষণীয়, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বাক্যটিতে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল ১৪ অগস্টের মধ্যরাতে, এই রাজ্য এই দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। প্রতিবাদের অভিমুখ ছিল দীর্ঘ দিন ধরে পুঞ্জীভূত নারী লাঞ্ছনা অত্যাচার ধর্ষণ এবং কলেজে চিকিৎসক তরুণী খুনের ঘটনা। তাই লক্ষ্য, স্বাধীনতা দিবসের শুভলগ্নে নারী-পুরুষের এই বিবেকপ্রসূত অভূতপূর্ব আন্দোলন কাঁপন ধরাবে অত্যাচারীর বুকে। এটা সরকার পরিবর্তনের ডাক ছিল না, ছিল অত্যাচারীদের সতর্ক করার অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার যদি প্রতিষ্ঠা পায়, তবে এক দিনের এই আন্দোলন সর্বক্ষেত্রে সুরক্ষা সৃষ্টির ইতিহাস তৈরি করবে।
সারনাথ হাজরা, কদমতলা, হাওড়া