‘দুঃশাসন’ (২২-৭) শিরোনামের সম্পাদকীয়তে যে ভাবে অকপটে পশ্চিমবঙ্গে নারী নির্যাতনের ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ তুলে ধরা হয়েছে, তা অত্যন্ত সময়োচিত। মনে পড়ে, অনেক বছর আগে কোনও এক ধর্ষিতা মূক ও বধির কন্যার বিচার চাইতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সটান ঢুকে পড়েছিলেন মহাকরণের অন্দরমহলে। অভিযোগ ছিল, চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে মহাকরণ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। তাঁর এ-হেন সম্ভ্রমহানির ঘটনায় তখন সমস্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম আমরা। কী নিষ্ঠুর নিয়তি, আজ তিনিই এ-রাজ্যের শাসক, আর তাঁরই শাসনে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ দুর্বৃত্তদের হাতে নির্যাতিত হতে হচ্ছে তাঁরই মতো আরও কত নারীকে। একদা আগুন নিয়ে খেলতে যাওয়ার অপরাধে কোনও এক দুষ্কৃতী মাথা ফাটিয়েছিল মমতার। ‘হার্মাদ’-দের সেই কাজের প্রতিবাদ করেন ডান থেকে বাম, সব দলের শুভবুদ্ধিসম্পন্নরা।
আজ তাজমুল, জামাল, জয়ন্তদের কী নামে ডাকবে সাধারণ মানুষ? দলের প্রচ্ছন্ন মদতে স্বঘোষিত মাতব্বরদের বিধানই সালিশি সভায় শেষ কথা। প্রশ্ন হচ্ছে দল এবং প্রশাসন কেন এদের দেখেও না দেখার ভান করে? সম্ভবত তার কারণ হল, মিটিং-মিছিলে ভিড় বাড়াতে, প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য করে দলীয় কর্মসূচি সফল করে তুলতে, বিরোধীদের শায়েস্তা করতে, বুথে বুথে ‘ভূতের দাপট’ অব্যাহত রাখতে লোক দরকার। দলের জন্য এরা যে কাজটি করতে পারে, ভদ্রলোকদের দ্বারা সে কাজটি হয় না। বেগতিক বুঝলে দল এদের ছেঁটে দেয়।
সত্যি বলতে, জেসিবি, জয়ন্তদের কোনও দল হয় না। তবে মাতব্বরি ফলানোর জন্য সর্বদা এরা শাসক দলের ছাতার তলায় আশ্রয় নেয়। তাই সরকার পাল্টালে গুটি গুটি পায়ে এরাও দল পরিবর্তন করে।
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
আশার আলো
‘দুঃশাসন’ শীর্ষক সম্পাদকীয়টি পাঠ করে মনে পড়ল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে ‘দুঃশাসনীয়’ নামে একটি ছোট গল্পের কথা। তার বিষয়বস্তু ছিল গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের বস্ত্র সঙ্কটের একটি করুণ চিত্র। শাশুড়ি ও বৌয়ের জন্য বরাদ্দ একটিমাত্র বস্ত্র, স্বামী খেতে বসে বৌকে ডাকলে সে আসতে পারে না, কারণ সে তখন নিরাবরণ! স্বামী রাগান্বিত হওয়ার দুঃখে বৌটি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তারাশঙ্করের গণদেবতা (১৯৪২) দেখিয়েছে, ব্রিটিশ সরকারের পদলেহনকারী ছোটখাটো জমিদার বা জোতদারদের অত্যাচারে গ্রামাঞ্চলের নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবন কতখানি অতিষ্ঠ ছিল। তখনও গ্রামের গণ্যমান্যরা— শিক্ষক, পুরোহিত প্রমুখ বসে গ্রামাঞ্চলের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান করতেন। অর্থাৎ, গ্রামাঞ্চলের কেষ্টবিষ্টুদের নেতাগিরি অব্যাহত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এই প্রজাতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে জমিদারি কায়দায় এক দল প্রভাবশালী মানুষ নিজেদের স্বঘোষিত এলাকার ‘ডন’ হয়ে উঠল। এরা নির্বাচনের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ‘আশীর্বাদধন্য’ হয়ে থাকে। এলাকার মানুষজনও এদের ভয়ে তটস্থ থাকে।
উত্তর ভারতের খাপ পঞ্চায়েতে আইনের তোয়াক্কা না করে অঞ্চলের গণ্যমান্যরা ছোটখাটো অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করেন। কিন্তু আমাদের রাজ্যে কিছু মানুষ অবৈধ ভাবে বিরাট সম্পদের মালিক হয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছে, প্রশাসন ও পুলিশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে, যাতে তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের বিরাগভাজন না হতে হয়। সম্পাদকীয়তে উল্লিখিত ঘটনাগুলি ডুবোপাহাড়ের চূড়ামাত্র! তবে অনেক সময়েই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অসহায়তা পরিলক্ষিত হয়। তার ফলে দলের মধ্যে মাঝেমাঝেই সংঘাত শুরু হয়। সম্পাদকীয়তে যথার্থ ভাবে উল্লিখিত হয়েছে যে, এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা সব আমলেই ঘটেছে। তবে সাম্প্রতিক কালে একেবারে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বোধোদয় হতে শুরু করেছে। কঠিন ভাষার প্রয়োগ করে ফরমান জারি হচ্ছে, এমনকি নেতাদেরও রেয়াত করা হচ্ছে না, এটাই আশার কথা।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
সহ্যের প্রলেপ
‘দুঃশাসন’ সম্পাদকীয়টি সত্যকে দেখাল। এই রাজ্যে সম্প্রতি সালিশি সভার নামে মহিলাদের উপর যে মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঘটনা প্রকাশ পেল, রাজ্যবাসী হিসাবে আতঙ্কিত হতে হয়। আগে আমরা উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানায় এমন ঘটনা ঘটলে দেশবাসী হিসাবে আতঙ্কিত হতাম। এখন ওই রাজ্যগুলির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নামও যুক্ত হল। শুধু সালিশি সভার নামে মহিলাদের উপর অত্যাচারের ঘটনাই নয়, রাজ্য জুড়ে চুরি, ডাকাতি, তোলাবাজি, নাবালিকা ধর্ষণ লাগাতার চলছে। এ যেন প্রতি দিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে। এ সব দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে জনগণের মনে এক সহ্যের প্রলেপ তৈরি হয়েছে। এই প্রলেপ খুব সুচতুর ভাবে জন্ম দেওয়া হচ্ছে, অনেকেই এখন এ সব নিয়ে খুব একটা ভাবিত নয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এ সব ঘটনা যেন দেখেও দেখছেন না, চাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা বড়ই প্রকট।
সম্পাদকীয় নিবন্ধের শেষে প্রশ্ন করা হয়েছে, প্রশাসন যে দুঃশাসনের নামান্তর, এ কথা কি নাগরিক বোঝেন না বলে মনে করে সরকার? প্রশ্নটা এখানেই যে, নাগরিক যদি তা বুঝতেন তা হলে ভোট দিয়ে এই সরকারকে জেতান কেন?
অমরেন্দ্র নাথ ধর, কলকাতা-৫১
স্কুলের দশা
সম্পাদকীয় ‘চমকসর্বস্ব’ (২০-৭) প্রসঙ্গে এক জন শিক্ষক হিসাবে কিছু কথা। রাজ্যের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে (সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বা পোষিত) পরিকাঠামোগত অব্যবস্থা রয়েছে। মুশকিল হল আগে বিভিন্ন বিভাগে আলাদা আলাদা অর্থ সাহায্য আসত। ‘অ্যাডিশনাল ক্লাসরুম’ বলে একটি অনুদান আসত। দীর্ঘ দিন ধরে তা আর আসে না। বর্তমানে বিদ্যালয়ে বেশির ভাগ অনুদান একত্রিত করে একটিমাত্র ‘গ্রান্ট’-এর অন্তর্গত করে পাঠানো হয়, যার নাম ‘কম্পোজ়িট গ্রান্ট’, যেটির পরিমাণ আবার নির্ভর করে ওই বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যার উপরে। গ্রান্টের পরিমাণও অনেক কম, সেখান থেকে আবার বিদ্যুতের বিলও পেমেন্ট করতে হয়, কাগজপত্র কিনতে হয় এবং বিদ্যালয়ের সারা বছরের খরচ চালাতে হয়। অথচ বেশির ভাগ বিদ্যালয়েরই ভবনের অবস্থা খুব খারাপ, দেওয়াল এবং ছাদে বড় বড় ফাটল, প্রায় ভেঙে পড়ছে। অনেক বিদ্যালয়ে যথেষ্ট সংখ্যায় শৌচালয় নেই, পানীয় জলের ব্যবস্থা অপ্রতুল, বেঞ্চ ভাঙা, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। ভারত সরকারের ‘ডিপার্টমেন্ট অব স্কুল এডুকেশন অ্যান্ড লিটারেসি’-র ২০১৯-২০ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গে এ রকম ভগ্নপ্রায় বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪২৬৯টি। এই চার-পাঁচ বছরে সংখ্যাটি বেড়েছে বই কমেনি। অনুদান কি এখানে প্রয়োজন ছিল না?
মিড-ডে মিল প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ দিন দিন কমছে, অথচ বাজারে সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। ছাত্রদের মাথাপিছু দৈনিক বরাদ্দ প্রাথমিকে পাঁচ টাকা পঁয়তাল্লিশ পয়সা এবং উচ্চ প্রাথমিকে আট টাকা সতেরো পয়সা। এই অর্থে এক জন শিশুকে সুষম আহার দেওয়া সম্ভব কি? এ দিকে কি রাজ্য নজর দিতে পারত না?
তৃতীয়ত, বেশির ভাগ পাঠ্য বইয়ের মান অত্যন্ত খারাপ। বইগুলো শিক্ষার্থীর বয়স অনুযায়ী তৈরি নয়, মূল বিষয়ে ঢোকার আগে অযথা অপ্রাসঙ্গিক কথাতে ভর্তি। ছবির মান খুব খারাপ, পৃষ্ঠা খুলে বেরিয়ে আসে, বইপাঠের আনন্দ নষ্ট করে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের এই বই শিক্ষার্থীকে সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলোর উপযুক্ত করে তোলে না। এই বিষয়ে আগাগোড়া পরিবর্তনের দিকে রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
অমিত দত্ত, গাড়ুলিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা