সংরক্ষণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। প্রতীকী ছবি।
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘চতুর চালে বাজি মাত?’ (১৭-১১) শীর্ষক প্রবন্ধের সঙ্গে সহমত হয়ে কয়েকটা কথা বলতে চাই। দেশে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেও যেখানে অর্থনৈতিক সাম্য এল না, সেখানে সংরক্ষণের মাধ্যমে এই সাম্য প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা সে চেষ্টা করেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন, শুধুমাত্র জাতের গরিমায় সমাজে ছড়ি ঘুরিয়ে আর্থিক সুবিধা আদায় রুখতে। সংরক্ষণের মাধ্যমে নিম্নবর্ণের মানুষরা যাতে প্রশাসনে, আইনসভায়, স্কুল, কলেজে এবং নানা ক্ষমতাসম্পন্ন সংগঠনে ঠাঁই করে নিয়ে কিছু মর্যাদা অর্জন করতে পারেন, এবং যাতে জাতিগত বৈষম্য কমে— সেই ছিল তাঁদের মহৎ লক্ষ্য। কিন্তু উচ্চবর্ণের গরিবদের (যাঁদের মাসিক আয় ষাট হাজার টাকার ঊর্ধ্বে) জন্য এই সংরক্ষণ সংবিধানে সংরক্ষণের ধারণাটাকেই সম্পূর্ণ উল্টে দিল।
আর একটি বিষয় ঠিক বোধগম্য হল না। এই যে তফসিলি জাতির জন্য ১৫ শতাংশ, জনজাতির জন্য ৭.৫ শতাংশ, এবং ওবিসিদের জন্য ২৭ শতাংশ— যা আপাত দৃষ্টিতে দেখলে একটা নিখুঁত হিসাব মনে হয়— জাতগণনা ব্যতীত সংরক্ষণের এই আনুপাতিক হিসাবটা ঠিক কী ভাবে এল! কিছু রাজনৈতিক দলের জাতগণনার দাবি এই পরিপ্রেক্ষিতে যথার্থই মনে হয়।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে জাতের বৈষম্য একটি অন্যতম অমানবিক কারণ। ব্যক্তিগত ভাবে কোনও গরিব মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করলে কিংবা কোনও অভাবিত সুযোগ পেলে বড়লোক হতে পারেন। বড়লোক হলে সামাজিক মর্যাদা লাভের সুবিধা আছে। কিন্তু নিম্নবর্ণের কোনও ব্যক্তি কোনও ভাবে আর্থিক সমৃদ্ধি লাভ করলেও সামাজিক মর্যাদা সহজে মেলে না। যদি সংরক্ষণের কারণে বেশ কিছু সংখ্যক নিম্নবর্ণের মানুষ শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, আইএএস, ডব্লিউবিসিএস বা ডাক্তার ইত্যাদি হতে পারেন, তখন জাতের কারণে তাঁদের অবজ্ঞা করা সহজ হবে না।
অনেকে বলে থাকেন, সংরক্ষণের কারণে নিম্নবর্ণ থেকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, চিকিৎসক, আইএএস, ডব্লিউবিসিএস প্রমুখ নিয়োগে শিক্ষাক্ষেত্রে, গুরুত্বপূর্ণ পেশার ক্ষেত্রে, সরকারি কাজকর্মে অবনমন ঘটছে। এটা যদি আংশিক সত্য হয়ও, তবু সাময়িক ভাবে এটা মানতে হবে একটি সমগ্র জাতির উন্নয়নের কথা ভেবে।
কিন্তু উচ্চবর্ণের গরিবদের সংরক্ষণের ফলে কিছুটা অবনমন ঘটার সম্ভাবনা। তাই শুধুমাত্র জাতের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে সংরক্ষণই যথার্থ। যে কোনও জাতের গরিবদের কিছুটা আর্থিক সুরাহার জন্য তো নানা সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্প আছে। সরকার সদিচ্ছার সঙ্গে সেই সব প্রকল্পের বহর বাড়াক।
দুর্গেশ কুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
দুর্নীতির প্রমাণ
সুকান্ত চৌধুরীর ‘এত বড় আঘাত, উপশম কই’ (৪-১১) শীর্ষক প্রবন্ধের সমর্থনে এই পত্র। বিপুল মানবসম্পদকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগিয়ে আগামী প্রজন্মের উন্নতিসাধনে সরকারি তরফে উৎসাহের যে বিপুল অভাব রয়েছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। যাঁরা যোগ্য, তাঁরা আজ দীর্ঘকাল যাবৎ পথে নেমে আন্দোলন করছেন ন্যায্য দাবিতে। সেখানে যথাযথ আলাপ-আলোচনার বদলে বোঝাপড়ার মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে রফা করা কোনও কাজের কথা নয়। ব্যতিক্রমী ভাবে নিযুক্ত শিক্ষকদের প্রতি এমন ব্যতিক্রমী দরদ জনমানসে সরকারের এক নেতিবাচক ছবিই তুলে ধরছে। সরকারের অধীন পর্ষদের কাজের প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, পর্ষদের যেন নিজস্ব কোনও ভূমিকাই নেই। কেবল হাই কোর্টের নির্দেশটুকু মেনে চলার বাধ্যবাধকতা তার আছে এবং এর বাইরে এটি যেন এক চলচ্ছক্তিহীন সংস্থা। সর্বোপরি, ধুঁকতে ধুঁকতে চলা সরকারি স্কুলগুলোর প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন অভিভাবকরা। সেই সমস্ত মানুষের চোখে সার্বিক ভাবে শিক্ষককুল হয়ে উঠবেন গণশত্রু, যদি ব্যতিক্রমী উপায়ে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি ঘুরপথে সিদ্ধ হয়ে যায়।
সরকার পক্ষের দাবি— এই দুর্নীতি প্রমাণসাপেক্ষ। প্রশ্ন হল, আর কত উদাহরণ সামনে এলে তবে তাঁরা মানবেন যে, সত্যিই দুর্নীতি হয়েছে? যদি কখনও সরকার পক্ষ থেকে ‘কাজ করতে গেলে ভুল হয়’ জাতীয় অজুহাতের দোহাই দিয়ে মেনেও নেওয়া হয় এই সীমাহীন দুর্নীতি, তত দিন এই মানবসম্পদ অব্যবহার্য হয়েই পড়ে থাকবে আর তাঁদের জীবন থেকে বাদ পড়বে এক-একটা মূল্যবান বছর? তাঁরা কি আর কখনও পাবেন না নিজেদের স্বপ্নকে সত্যি করার সুযোগ?
এই রকম বেসামাল পরিস্থিতির মধ্যে মুখরক্ষার্থে (না কি আগামী দিনের পঞ্চায়েত ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে) নতুন টেট পরীক্ষার তোড়জোড় করা হচ্ছে এবং তাতে বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী আবেদনও করে ফেলেছেন। সরকারের দাবি যে, এতে বোঝা যাচ্ছে মানুষ এখনও কতখানি আস্থা রাখছেন শিক্ষা দফতরের প্রতি। সত্যিই কি তাই, না কি সুদীর্ঘ কাল শিক্ষক নিয়োগ কার্যত বন্ধ থাকার পর সাংঘাতিক বেকারত্বের নগ্ন প্রকাশ এই বিপুল আবেদনের ঢলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে?
অনির্বিত মণ্ডল, ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
প্রতিযোগিতা
কর্মচারীদের ডিএ দিতে না পারার কারণ জানিয়ে রাজ্যের তরফে হলফনামা দিয়ে উচ্চ আদালতে বলা হয়েছে, রাজ্যের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। এই অবস্থায় ডিএ দিতে গেলে রাজ্যে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হবে। এর আগে ডিএ নিয়ে মামলা চলাকালীন রাজ্যের তরফে বলা হয়েছিল, রাজ্যে অনেক জনকল্যাণমুখী প্রকল্প চালু আছে, ডিএ দিতে গেলে সরকারের পক্ষে সেই সব প্রকল্প চালানো সম্ভব হবে না। বিরোধী দলগুলিরও অভিযোগ, রাজ্য খেলা-মেলা করে, ক্লাবগুলিকে অনুদান দিয়ে, বিভিন্ন দান খয়রাতি করে অর্থের দেদার অপচয় করছে, আর এ সব করতে গিয়ে প্রচুর ঋণ নিয়ে রাজ্যকে সঙ্কটের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।
রাজ্যের আর্থিক সঙ্কটের জন্য আরও একটি বিষয়কে আমরা আলোচনার মধ্যে আনছি না— সেটা হল বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। প্রথমেই বলতে হয়, ‘খাদ্যসাথী’র কথা। কেন্দ্র রাজ্যের ছ’কোটি মানুষের জন্য তিন টাকা কেজি দরে রেশনে চাল-গম দিচ্ছে, সেখানে রাজ্য কেজি প্রতি আরও এক টাকা ভর্তুকি দিয়ে প্রকল্পের নাম ‘খাদ্যসাথী’ দিয়ে রাজ্যকে জনকল্যাণকামী দেখানোর একটা অপ্রয়োজনীয় চেষ্টা করে চলেছে। এতে রাজ্যের বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, এবং অদ্যাবধি এ-বাবদ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
অন্য দিকে, রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার যোগ করায় এক বছরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রায় এক কোটি কার্ড বাতিল হয়েছে এবং এই বাবদ দেখা যাচ্ছে বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা রাজ্যের খরচ বাঁচছে। এটা আরও তিন বছর আগেই করা যেত। কেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্যই এটা হয়নি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর এই কাজ করা হল। একই ভাবে, কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প চালু না করে রাজ্যের নিজের খরচে সব মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবার জন্য ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ডের প্রচলন করা হল। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প চালু করলে বছরে কম করে দু’হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হত। কৃষকদের জন্য রাজ্যের ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পে বছরে ২২০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এখানেও কেন্দ্রের ‘পিএম কিসান নিধি’ প্রকল্প গ্রহণ করলে অনেকটা অর্থের সাশ্রয় হত। সম্প্রতি কেন্দ্রের এই প্রকল্প সীমিত ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পও রাজ্যে চালু করার কথা শোনা যাচ্ছে।
কেন্দ্রের সঙ্গে অনাবশ্যক প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসার পাশাপাশি অনেক অনুদান প্রকল্পের পরিসর ছোট করতে হবে, সকলকেই অনুদান, ভর্তুকি দেওয়ার মনোভাব থেকেও সরে আসতে হবে। অন্যথায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রাজ্যকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
অসিত কুমার রায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি