Tapan Sinha

সম্পাদক সমীপেষু: সময়ের চিত্রকর

তপন সিংহ সম্পর্কে যে কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল— তাঁর চলচ্চিত্রের নির্মাণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ‘আর্টস’, ‘কমার্স’, ‘ইন্ডাস্ট্রি’ বা ‘লন্ডন মফস্‌সল’ সব উপাদানেরই সুষম সমাহার আছে বলে অনেকের ধারণা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:১৭
Share:

জন্মশতবর্ষে চিত্রপরিচালক তপন সিংহ সম্পর্কে শিশির রায় তাঁর ‘লড়াই, তবে একক মানুষের’ (৩-১০) প্রবন্ধে যা বলেছেন, তা যথাযথ। তপন সিংহ সময়ের চিত্রকর। অনেকে ভাবেন, সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক ছবি করেছেন বিদেশের দর্শকের জন্য; তাঁরা বিদেশের অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের ছবি দেশের নাম বিদেশে ছড়িয়েছে, তাঁরা ‘আর্ট ফিল্ম’ করেন। তপন সিংহ ঠিক এই পর্যায়ে পড়েন না। কেননা তিনি সাধারণ দর্শককে বিমুখ করেননি। তাঁর ছবিতে অনেক ভাল ভাল গান আছে। আছে ভাল গল্প। প্লটের নাটকীয় ওঠাপড়া দর্শককে রীতিমতো টেনে রাখে। এ জন্য তিনি গল্প নিয়েছেন বাংলা সাহিত্য থেকে। এমনকি নাটক থেকেও। দেখা যায় প্রতিটি সিনেমাই দৃশ্যগত ভাবে নিটোল, যা তাঁর চলচ্চিত্র সম্পর্কে গভীর বোধের পরিচায়ক। তিনি যেমন সমসময়ের সঙ্গে আছেন, তেমনই ধরেছেন ঐতিহাসিক সময়কেও। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হবে, তাঁর স্বরচিত গল্পগুলোর চলচ্চিত্রায়নও যথেষ্ট সাবলীল।

Advertisement

তপন সিংহ সম্পর্কে যে কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল— তাঁর চলচ্চিত্রের নির্মাণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ‘আর্টস’, ‘কমার্স’, ‘ইন্ডাস্ট্রি’ বা ‘লন্ডন মফস্‌সল’ সব উপাদানেরই সুষম সমাহার আছে বলে অনেকের ধারণা। তিনি এমন কোনও ছবি করেননি যা দর্শকের কাছে কঠিন আর বিদেশিদের কাছে অপাঙ্‌ক্তেয় বোধ হয়েছে। তিনি কোনও বিশেষ ভঙ্গি বেছে নেননি যাতে কোনও দর্শকের মনে হয় এ ছবি আমাদের জন্য নয়। এই শিল্পসম্মত মান আর দর্শকসাধারণের উপভোগ্যতা— দুই-ই তাঁকে এক স্বতন্ত্র জায়গা দিয়েছে। কাজটা কঠিন। আর একটা বিষয় না বললেই নয়। উত্তমকুমার দিলীপকুমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যে ভাবে তিনি ব্যবহার করেছেন, তা তাঁর নিজের অভিনয় দক্ষতারই প্রকাশ, স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। পূর্বোক্ত তিন পরিচালকের পাশাপাশি নিজের স্বতন্ত্র স্বাক্ষর গড়ে তুলে এত বছর ধরে এত ছবি উপহার দেওয়া তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আজও বিখ্যাত মানুষদের তর্কের বিষয় শোনা যায়— ঝিন্দের বন্দী-তে কে বেশি ভাল অভিনয় করেছিলেন, উত্তম না সৌমিত্র! জতুগৃহ ছবিতে কে কাকে ছাড়িয়ে গেছেন— উত্তম অরুন্ধতীকে না অরুন্ধতী উত্তমকে!

তনুজ প্রামাণিক, হাওড়া

Advertisement

গল্প হলেও সত্যি

তপন সিংহকে নিয়ে শিশির রায়ের প্রবন্ধের প্রসঙ্গেই আমার এই পত্র। তপন সিংহের সিনেমা সম্পর্কে যথার্থ ভাবেই প্রবন্ধকার বলেছেন, “বৈচিত্রই তপন সিংহের প্রতিশব্দ।” সত্যিই তো, যে মানুষটি কাবুলিওয়ালা থেকে গল্প হলেও সত্যি, বা ঝিন্দের বন্দী থেকে হাঁসুলী বাঁকের উপকথা-র মতো ছবি তৈরি করতে পারেন, তাঁর সৃষ্টিকে ‘বৈচিত্রময়’ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়? তাঁর ছবিকে ‘ব্যবসাসফল’ বলে সাফল্যের যে সব কারণের কথা তিনি এই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, সেগুলো হল ছবির বিষয়, চিত্রনাট্য, কাস্টিং, সঙ্গীত, অভিনয়, শুটিং, পোস্ট-প্রোডাকশন, অর্থাৎ সিনেমার প্রায় সব ক’টা উপাদান প্রয়োগেই তিনি ছিলেন একেবারে সিদ্ধহস্ত। বিশেষ করে, সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ছিল এক বিশেষ অনুরাগ।

পাশ্চাত্য-সঙ্গীতের ধারা সম্বন্ধে পাণ্ডিত্য থাকার ফলে তাঁর ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার ক্ষেত্রে যেমন, তেমন গায়ক-গায়িকাদের নানা রকমের ব্যবহারের পরিসরেও এক ধরনের মুনশিয়ানা আমরা দেখতে পাই। এ ছাড়াও তাঁর ছবিতে এক দিকে যেমন রবিশঙ্কর থেকে আলি আকবর খানের মতো বিশিষ্ট শিল্পীরা সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, অপর দিকে তিনি নিজেও চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে সঙ্গীত-পরিচালনা এবং সংযোজনায় সফল ভাবে হাত লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। হারমোনিয়াম সিনেমায় তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গানগুলো এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তপন সিংহও যে বিশেষ সম্মানের দাবিদার, তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর প্রতি সত্যজিৎ রায়ের মতো বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের শ্রদ্ধা দেখেও। সিনেমা নির্মাণ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও চিত্রনাট্যে বাক্যের সঠিক ব্যবহার সত্যজিৎ রায়কে মুগ্ধ করেছিল।

আর একটা কথা বলা প্রয়োজন তপন সিংহের দক্ষতা প্রসঙ্গে। তা হল— শিশুশিল্পীদের দিয়ে তাঁর অভিনয় করানোর ক্ষমতা। বিশিষ্ট সমালোচক, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, “বাংলা সিনেমার ঐতিহ্য বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা না-থাকায় আমরা বুঝতেই পারিনি ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) বা ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬)-য় ছোট্ট অপুর মুখে যখন প্রায় কোনও সংলাপই দেওয়া হয় না, তখন ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৫৭) ও ‘অতিথি’-তে (১৯৬৫) শিশুশিল্পীরাও সংলাপে এমন আশ্চর্য দক্ষতা কোথা থেকে পায়!” তপন সিংহের সময়-সচেতনতার দৃষ্টান্ত হিসেবে এই চলচ্চিত্র-বোদ্ধার আর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করব: “ভাবতে অবাক লাগে, যখন আমাদের ছয়ের দশকের ইতিহাস অশান্ত ও অনিশ্চিত, তখন তপন সিংহ ভাবতে পারছেন অভ্যন্তরীণ ভাঙনের কথা। ‘জতুগৃহ’ (১৯৬৪) ছবিতে সময় ছায়া ফেলছে না সরাসরি। ক্রমাগত ছাত্র আন্দোলন— নুরুল ইসলাম ও আনন্দ হাইতের রক্ত গড়িয়ে পড়ে লাল হয়ে যাচ্ছে বাঙালির মানচিত্র, রাস্তাঘাট-রেস্তোরাঁয় ‘ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, হ্যানয় থেকে সায়গন পর্যন্ত ছত্রীসেনার মতো নেমে আসছে নাপাম বোমা। স্কুল-কলেজের যৌবন ক্ষুব্ধ ও উত্তোলিত বাহু; তখনই শ্রীযুক্ত তপন সিংহ নিবেদন করেছেন ‘গল্প হলেও সত্যি’র (১৯৬৬) মতো অলীক শান্তিনিকেতন।”

গৌতম নারায়ণ দেব,কলকাতা-৭৪

তীব্র নজর

তপন সিংহকে নিয়ে ‘লড়াই, তবে একক মানুষের’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। তপন সিংহ বিষয়বস্তুর উপর বরাবরই জোর দিয়েছেন বলে তাঁর সৃষ্টির বড় অংশটাই কাহিনিপ্রধান। তাই সাহিত্যের আঙিনায় তিনি অবাধে বিচরণ করেছেন এবং হামেশা সাহিত্যনির্ভর ছবি বানিয়েছেন। দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র সম্বন্ধে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য কখনওই অহমিকায় পর্যবসিত হয়নি। কলাকুশলীদের সাহস জুগিয়ে নিজে অভিনয় করে দৃশ্যগুলো বুঝিয়ে দিতেন, স্বরক্ষেপণ করার পদ্ধতি শেখাতেন এবং সেটা অপ্রত্যাশিত ভাবে নির্ণয় করে সংলাপের মাত্রা বদলে দিতেন। আসলে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রটি তো ‘সাউন্ড এঞ্জিনিয়ারিং’ শিখেছিলেন নিউ থিয়েটার্সে, বিদেশেও গিয়েছিলেন। এক যে ছিল দেশ ছবিতে রবি ঘোষের যে অসাধারণ স্বরপ্রক্ষেপণ শুনতে পেয়েছি আমরা, তা তার ছবির অনন্য বৈশিষ্ট্য। বার বার সমাজের প্রতিটি কোণে তাঁর তীব্র নজর ঝলসে উঠেছে। তিনি কিন্তু নিজেকে অন্তরালে রাখতেই ভালবাসতেন। তাঁর ছবিগুলো বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে।

প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত,ব্যান্ডেল, হুগলি

স্বতন্ত্র

কলেজের রসায়ন বিভাগের কিছু ছেলে দুপুরে প্রাচী সিনেমা হলে ছবি দেখতে ছুটলাম। গিয়ে দেখি, সাহিত্যিক শংকরের লেখা এবং তপন সিংহ পরিচালিত এক যে ছিল দেশ ছবিটি চলছে। ছবিতে এক দিকে ওষুধ প্রস্তুতিতে রসায়নের যুগ্ম সংমিশ্রণের পরিমাণের ভুল, অন্য দিকে জমজমাট হাসির খোরাকের উপস্থিতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এ ছাড়া তপন সিংহ পরিচালিত হিন্দি শিশু চলচ্চিত্র সফেদ হাথী ছবিটি শ্রেষ্ঠ শিশু চলচ্চিত্রের জন্য শুধু জাতীয় পুরস্কারই পায়নি, তৎকালীন শিশু ও দর্শকদের হৃদয়ে চিরদিনের সুখস্মৃতি হয়ে আছে। তিনি যে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের চেয়ে সম্পূর্ণ একক ও স্বতন্ত্র ছিলেন, সে বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। পরিচালক, গীতিকার এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে তিনি যে কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, তার প্রমাণ পাই রজনীকান্তের গানটি বাদ দিয়ে হারমোনিয়াম ছবির তাঁর স্বরচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মাধ্যমে।

তপনকুমার বিদ বেগুনকোদর, পুরুলিয়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement