সম্পাদক সমীপেষু : সেই অমর উপাধি

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share:

‘কবে থেকে বিদ্যাসাগর’ (৩-১০) শীর্ষক চিঠি বিষয়ে এই পত্র। ঈশ্বরচন্দ্রের বুদ্ধিমত্তা ও বিদ্যানুশীলনের প্রতিভার বৈচিত্র দেখে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক সকলেই বিস্মিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিভার যোগ্য সম্মান দেওয়ার জন্য প্রবীণ অধ্যাপক শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি মহাশয় প্রস্তাব করলেন: ঈশ্বরচন্দ্রকে একটি উপাধি দেওয়া দরকার। জ্ঞানের বিরাট বারিধি তিনি অতি সহজে অঞ্জলিতে ধারণ করেছেন, তাই তিনি ‘বিদ্যাসাগর’। এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। আর এই ঐতিহাসিক প্রশংসাপত্রে স্বাক্ষর করলেন সংস্কৃত কলেজের ছ’জন অধ্যাপক— ব্যাকরণে গঙ্গাধর শর্মা, কাব্যে জয়গোপাল, অলঙ্কারে প্রেমচন্দ্র, বেদান্ত ও ধর্মশাস্ত্রে শম্ভুচন্দ্র, ন্যায়শাস্ত্রে জয়নারায়ণ ও জ্যোতিষশাস্ত্রে যোগধ্যান— যাঁরা প্রত্যেকেই নিজের বিষয়ে ছিলেন সে যুগের দিকপাল পণ্ডিত। ছাত্রজীবনের এই সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার ঈশ্বরচন্দ্রকে বিদ্যাসাগর নামে (উপাধিতে) বিখ্যাত করে তুলল, এই উপাধিই শাশ্বত হয়ে রয়েছে ঊনবিংশ শতকের বাংলার ইতিহাসে।

Advertisement

(সূত্র: বিদ্যাসাগর, মণি বাগচি, ১৯৫৭)।
কেয়া চৌধুরী
কলকাতা-৪৭

উপাধির হদিস

Advertisement

‘কবে থেকে বিদ্যাসাগর’ (৩-১০) প্রসঙ্গে এই চিঠি। বিদ্যাসাগরের জীবনীকারেরা কেউ বলেছেন, ল’কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পান। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সে সময় আদালতে জজ পণ্ডিতের চাকরি পাওয়ার জন্য অনেকেই এই পরীক্ষায় বসতেন এবং উত্তীর্ণও হতেন। তাঁরা সকলেই ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রাপ্ত ছিলেন, তেমনটা জানা যায় না। যেমন বিদ্যাসাগরের অন্যতম সুহৃদ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। তিনি জজ পণ্ডিত হয়েছিলেন, কিন্তু ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পাননি। অন্য দিকে, ঈশ্বরচন্দ্র ব্যতীত আরও কেউ কেউ সে-সময় বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁরা সকলেই সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন না। তারানাথ তর্কবাচস্পতির পুত্র জীবানন্দ বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু রংপুর নিবাসী নীলকমল বিদ্যাসাগর, রাজীবলোচন বিদ্যাসাগর প্রমুখ এই উপাধি পেলেও, কেউই সংস্কৃত কলেজে পড়েননি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উপাধি পান দু’ভাবে। জীবনীকারদের লেখা তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, তিনি ১৮৪১ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজ’ থেকে বিদ্যাসাগর উপাধি পান। আবার কলেজের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ১৮৪১-এর ১০ ডিসেম্বর তাঁকে এই উপাধি দেওয়া হয়।

উপাধি বিতরণের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী বলা হয়, কী কারণে বা কোন বিশেষ পারদর্শিতার জন্য এই বিশেষ উপাধি প্রদত্ত হচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের উপাধি শংসাপত্রে সরাসরি তাঁকে ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ নামে অভিহিত করা হয়। এখানেই একটা খটকা থেকে যায়। সংস্কৃত কলেজের অনেক ছাত্রই সম্পূর্ণ পাঠ শেষ করেছিলেন বলেই মনে হয়! যেমন জীবানন্দ বিদ্যাসাগর। কিন্তু সকলেই এই উপাধি পাননি। কলেজ থেকে বিদ্যাসাগর ছাড়াও ন্যায়রত্ন, তর্করত্ন, তর্কশিরোমণি, তর্কালঙ্কার, বিদ্যাভূষণ ইত্যাদি উপাধি সফল ছাত্রদের প্রদান করা হত। এই উপাধি প্রদানের মাপকাঠি কী ছিল?

কোন উপাধি ছাত্রেরা পেতে চান, বা কোন কোন বিষয়ে অধ্যয়ন সমাপ্ত করলে ছাত্রেরা নির্দিষ্ট কোন উপাধি পাবেন, তেমন কোনও মাপকাঠি ছিল কি? জিজ্ঞাসা এটাই। শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় তাঁর এক প্রবন্ধে (‘বিদ্যাসাগর’ উপাধির উৎস সন্ধানে, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি প্রকাশিত ‘প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর’) গোপিকামোহন ভট্টাচার্য প্রণীত গ্রন্থ, কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস (২য় খণ্ড) থেকে সূত্র উদ্ধার করে বলেছেন, সংস্কৃত কলেজের সাহিত্য শ্রেণির কৃতী ছাত্র হিসেবে ১৮৩৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি অর্জন করেন। এই সূত্র ধরে বলাই যায় ঈশ্বরচন্দ্রের ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রাপ্তি ছিল স্ব-নির্বাচিত! এবং এ কারণেই কলেজ ও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র শংসাপত্রে সরাসরি ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ নামেই অভিহিত করা হয়।

প্রলয় চক্রবর্তী
কলকাতা-১২৪

প্ল্যান করে নয়

জহর সরকারের ‘দুর্গা বাঙালি হলেন কী ভাবে’ (২৭-৯) পড়ে মনে হয়, এক দল লোক প্ল্যান করে এই সব তৈরি করেছে। আসলে ট্র্যাডিশন হল ধীরে ধীরে আঞ্চলিক ভাব দিয়ে মূল ভাবটি আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার প্রকরণ। এটা হয় ধীরে ধীরে বহু বছর ধরে, বহু শিল্পী, বহু উদ্যোক্তা, বহু ভক্ত, বহু কবি আর লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের অনুভূতির সম্মিলনে। পশ্চিমবঙ্গে ঠাকুর একচালা হোক বা ‘থাকা’ হোক, অনেকগুলি মূর্তিকে পাশাপাশি বসিয়ে একটা ‘গ্র্যান্ড এফেক্ট’ তৈরির জন্য করা হয়। কার্তিকের ‘থাকা’ অসম্পর্কিত দেবদেবীতে ভর্তি করা হয়ে থাকে। এমনকি মা কালীর পাশে করালী ভৈরবী, শৃগাল ইত্যাদি দিয়েও জমজমাট করার প্রচেষ্টা হয়। মা লক্ষ্মী, মা সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক এই ভাবে ক্যানভাসে ঢুকে ধীরে ধীরে কাহিনি আর গানের মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়ে হয়ে গিয়েছেন। চালচিত্রেও অনেক চরিত্র। এটা খুবই স্বাভাবিক ভাবে দু’এক শতাব্দী ধরে হয়েছে।

তুষারকান্তি চৌধুরী
উত্তরপাড়া, হুগলি

বৌবাজার

বৌবাজারের তলায় হয়তো আজও অন্তঃসলিলা গঙ্গার খাঁড়ি লুকোনো জলস্রোত হয়ে বয়ে যাচ্ছে— এমনটাই মনে হয় ইতিহাস ঘাঁটলে। ঋজু বসুর ‘শহরের তলায় আজও পলি আর লুকোনো জলখাত’ (রবিবাসরীয়, ২২-৯) প্রবন্ধটি থেকে জানা যায় মধ্য কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গঙ্গার একটি খাঁড়ি ছিল। পরে এটি বিদ্যাধরী নদীতে মিশে যায়। বর্তমানে বিদ্যাধরী মজে গিয়েছে। বৌবাজারের বেশ কিছু অঞ্চলের নাম এই খাঁড়ির স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয়। যেমন ক্রিক রো। ক্রিক কথাটির মানেই হল খাঁড়ি। বৌবাজারের হিদারাম ব্যানার্জি লেন ধরে শিয়ালদহের দিকে এগোলে দুর্গা পিতুরি লেন ও হিদারাম ব্যানার্জি লেনের সংযোগস্থল থেকে প্রায় সোজা চলে গেলেই ক্রিক রো-তে পড়া যায়। সুতরাং বৌবাজারের দুর্গা পিতুরি লেন, সেকরা পাড়া ও গৌর দে লেন সংলগ্ন অঞ্চলে গঙ্গার খাঁড়ি যে এক কালে ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ক্রিক রো নাম থেকেই। এখনও সেই খাঁড়ির লুকোনো উপস্থিতিই কি বৌবাজারে মেট্রোর সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ে জল উঠে আসার কারণ!

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, বৌবাজার অঞ্চলে আরও একটি গলি রয়েছে, যার নাম হুজুরিমল লেন; পুরনো পত্র-পত্রিকা থেকে জানা যায় এই গলির নাম ছিল হুজুরিমল ট্যাঙ্ক লেন। নাম থেকেই খালের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।

নিবন্ধটি থেকে জানা যায়, ১৭৩৭ সালের ভূমিকম্প বিপর্যয়ের পরবর্তী সময়েও বৌবাজারে এই খাল টিকে ছিল। এটিই ডিঙাভাঙা খাল বা বৌরানির খাল বা বৌঠাকুরানির খাল নামে পরিচিত। কথিত রয়েছে, দুর্গা পিতুরি লেনের বাসিন্দা বিশ্বনাথ মতিলালদের বাড়ির বিধবা বৌমার নামেই বৌবাজারের নাম হয়েছে। তারই নামে বৌবাজারের বাজারটিও। সেই ভাবেই খালটির নামও ছিল বৌরানির খাল। রচনাটি থেকে জানা যাচ্ছে, ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার আমলে এই খাল বুজিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কারণ সেই সময় শিয়ালদহে রেললাইন পাতা হচ্ছে, শহরে নর্দমার লাইন পাতা হচ্ছে।

এ ছাড়াও পুরনো নথি থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে কলকাতা শহরে মাটির তলায় টিউব রেল তৈরি করার পরিকল্পনা করেও সেই প্রকল্প বাতিল হয়। কারণ হিসেবে জানা যাচ্ছে, সেই সময় মাটি পরীক্ষা করে বলা হয়— এই অঞ্চলের মাটিতে জলীয় ভাব অত্যন্ত বেশি এবং মাটি খুবই নরম। আমি এই প্রবন্ধের লেখকের সঙ্গে একমত; যদি ইতিহাসের গভীরে যাওয়া যেত, তা হলে হয়তো বৌবাজার অঞ্চলের বাসিন্দাদের এবং মেট্রো কর্তৃপক্ষের এই ক্ষতি হত না।

রীনা নন্দী
কলকাতা-১২

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement