বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন ২০০০ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেছিলেন, তখন তাঁর সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল, যা দেখে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সন্দিহান ছিলেন বুদ্ধবাবু আদৌ সফল হবেন কি না। কিন্তু তিনি নিজের মতো করে সংস্কারক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। এক দিকে, সিটুর উগ্র আন্দোলন, শিল্প নেই, দলের অনুশাসন, তার উপর বেকারত্বের বহর। অন্য দিকে, সারা পৃথিবীতে বামপন্থার খরা চলছে। এর মধ্যে থেকেও শিল্পের পুঁজি দেশ-বিদেশে খুঁজে বেড়িয়েছেন। পার্টি কংগ্রেসেও বাস্তব পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছিলেন। বিতর্ককে নিত্যসঙ্গী করে নিয়েছিলেন, কিন্তু আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে শিল্পভাবনায় তিনি অবিচল ছিলেন। হয়তো কিছুটা পেরেছেন, অথবা কিছুই পারেননি। কিন্তু কখনও কালোকে সাদা বলেননি। ঐতিহাসিক ৩৪ বছরের বামজমানায় ১৩টা দল নিয়ে ঘর সামলে শেষ এগারো বছর যে সততার রাজনীতি তিনি করলেন, রাজনীতির সেই ঘরানা দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে দৃষ্টান্ত। সেই জন্য বুদ্ধবাবুও সব রাজনৈতিক দলের কাছে রোল মডেল হয়ে থাকবেন।
উন্নত বামফ্রন্টের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি, তাই মানুষের চিন্তায় ও মননে সযত্নে রয়ে যাবেন বহু কাল। এ-হেন ব্যতিক্রমী সাচ্চা কমিউনিস্ট, এক জন দক্ষ প্রশাসক, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ, যাঁকে বলা চলে বাম শাসনের শেষ নায়ক, তাঁকে জানাই রক্তিম স্যালুট।
তাপস কুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৩০
মানবিক
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অকারণে বেশি কথা বলতেন না, সংযম তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তাই তাঁর সম্পর্কে বেশি কথা লিখব না। বুদ্ধদেববাবু নিজেকে এক জন প্রকৃত মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর কথায় বলা যায়, তিনি যদি রাজনীতিতে যোগ না দিতেন, অবশ্যই তিনি শিক্ষক, লেখক বা চিত্রপরিচালক হতেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সমস্ত সুযোগসুবিধার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভোগী হয়ে ওঠেননি। এক জন সৎ, বিবেকবান ও নির্লোভ পুরুষ ছিলেন তিনি। যে গুণে মানুষ বড় হয় সেই সমস্ত মানবিক গুণ তাঁর চরিত্রে ছিল। আমার মতে, তিনি ছিলেন এমন এক জন আদর্শবান মানুষ, যিনি তাঁর যথাযথ কাজের জায়গা খুঁজে পাননি। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের আচরণে তিনি যথেষ্টই ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন, তথাপি তাঁর অভিমানের কোনও বহিঃপ্রকাশ ঘটাননি। আমরা যেন অপেক্ষা করছিলাম, তিনি পরলোক গমন করার পর তাঁর গুণকীর্তন শুরু করব। তাঁর সম্পর্কে আজ যত মূল্যায়ন হচ্ছে, তিনি যদি শুনে বা দেখে যেতে পারতেন, তা হলে হয়তো জমে থাকা অভিমান, দুঃখ ভুলে যেতেন।
সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি
সৃষ্টিশীল বুদ্ধ
সুমিত মিত্রের ‘বিদ্রোহী, অভিমানী, একা’ (৯-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সম্পর্কে আরও কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করলাম। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (১৯৪৪-২০২৪) ছিলেন মার্ক্স দর্শনে বিশ্বাসী, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি ও কোলাপুরি চপ্পলের আপাদমস্তক এক নিপাট বাঙালি ভদ্রলোক। বুদ্ধদেববাবু ২০০০-২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে তিনি ছিলেন এক জন সাহিত্যিক, নাট্যকার ও সুস্থ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলা অনার্সের ছাত্র ছিলেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। রবীন্দ্রনাথ সকলের জন্য, সে কথা তুলে ধরতেন বারে বারে। এ ছাড়া মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, শেক্সপিয়র, কাফকা, মায়াকোভস্কি, কামু, মার্কেসের বই ছিল তাঁর প্রিয়। সম্পাদনা করেছেন দলীয় পত্রপত্রিকা। লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ। ১৯৯৩ সালে তাঁর রচিত দুঃসময় নাটকটি সে সময় যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। নাটকের বিষয়বস্তু ছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবতার জয়গান।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম দশ বছর ও শেষ দশ বছর নিয়ে দু’টি খণ্ডে ফিরে দেখা নামে দু’টি গ্রন্থ রচনা করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যা ইতিহাসের দলিল। বিদেশি কবি লেখকদের বিভিন্ন লেখা অনুবাদ করেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত একটি বই হল স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা। ১৯৯৯ সালে প্রকাশ পায় বুদ্ধদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে পুড়ে যায় জীবন নশ্বর নামক গ্রন্থটি। তিনি বাঙালি পাঠককে উপহার দিয়েছেন একগুচ্ছ বিদেশি কবিতার অনুবাদ চেনা ফুলের গন্ধ। মার্কেসের উপন্যাস অনুবাদ করেছেন বিপন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প। উল্লেখযোগ্য বই চিলিতে গোপনে (অনুবাদ), যা সে সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তাঁর আরও একটি অমূল্য গ্রন্থ হল নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেখা নাটক পোকা যথেষ্ট চর্চিত। এটি ফ্রানজ়্ কাফকার মেটামরফোসিস অবলম্বনে লেখা। তিনি লিটল ম্যাগাজ়িন মেলার সূচনা করেছিলেন। নাট্যমেলা, যাত্রা উৎসব ইত্যাদি অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের রূপকার ছিলেন তিনি। নাটক ও ফিল্মের প্রতি তাঁর অনুরাগও সর্বজনবিদিত। ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের প্রতি আকর্ষণ ছিল তীব্র। তাই তো কলকাতার নন্দন প্রেক্ষাগৃহকে আন্তর্জাতিক স্তরে জনপ্রিয় করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি ভালবাসতেন কবাডি ও ক্রিকেট।
বুদ্ধদেববাবু ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিতর্কিত ট্র্যাজিক নায়ক। কারও কাছে তিনি দাম্ভিক ছিলেন, আবার কারও কাছে তিনি নিন্দিতও হয়েছেন। কিন্তু যশ ও প্রতিষ্ঠার লোভ বুদ্ধদেববাবুর কোনও কালেই ছিল না। তিনি নিখাদ কর্মসংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ২০২২ সালে তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকার ‘পদ্মভূষণ’-এ মনোনীত করলে তা নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বুদ্ধদেববাবু বিশ্বাস করতেন, সততার পথ লম্বা ও কঠিন। কিন্তু সেই পথে জয় সুনিশ্চিত। তিনি ছিলেন সমগ্র বাংলার গর্ব।
বিপদতারণ ধীবর, বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া
মূল্যবোধ
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রয়াত হলেন। তখন আমি স্কুলের ছাত্র। প্রফুল্ল সেনের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বুদ্ধবাবু ছিলেন যুবনেতা। এক বার পুলিশ আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা করে ভ্যানে তুলছিল। বুদ্ধবাবু মাটিতে পড়ে গিয়ে নেতিয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ তাঁকে মৃত ভেবে চলে যায়। পরে পুলিশ চলে যাওয়ার পর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে স্থানত্যাগ করেছিলেন।
এখনকার রাজনীতির সঙ্গে তখনকার রাজনীতির পার্থক্য ছিল। এখন কাউকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণ করা হলে তিনি বিরোধী দলের প্রার্থী হয়ে জিতে মন্ত্রী হয়ে যান। তখনও কংগ্রেস ভেঙে বাংলা কংগ্রেস হয়। কিন্তু সুশীল ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায় স্বার্থসিদ্ধির জন্য দলত্যাগ করেন, এ অপবাদ তাঁদের নিন্দুকেরাও দিতে পারবেন না।
এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তখনও আমি বিদ্যালয়ের ছাত্র। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে অকংগ্রেসি সরকার গঠনের তোড়জোড় চলছে। সেই সময় কংগ্রেস সভাপতিকে কংগ্রেসের কেউ কেউ প্রস্তাব দেন, বিরোধী দল থেকে কিছু নেতাকে মন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে কংগ্রেসে নিয়ে এসে সরকার গঠন করা হোক। তিনি এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছিলেন, এই কাজ করা অসম্ভব, তা হলে নৈতিকতা বলে কিছুই থাকে না।
দিলীপ চট্টোপাধ্যায়কলকাতা-৯১