পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসে ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ‘জমি-জল-জঙ্গল: জীবন-জীবিকার অধিকার ও গণআন্দোলন’ শীর্ষক অধ্যায়ে, তেভাগা-তেলঙ্গানার গণআন্দোলন সম্পর্কে অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর, ‘টুকরো কথা’য় বিশ শতকের কয়েকটি পরিবেশ আন্দোলনের কথা উল্লেখের পর, ‘কৃষিজমির অধিকার: সিঙ্গুর গণআন্দোলন’-এর কথা সাত পৃষ্ঠা জুড়ে যে ভাবে স্থান পেয়েছে, তাতে এক জন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম গবেষক হিসেবে গর্ব করতেই পারি। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে কথা বলতে গেলে, তেভাগা, তেলঙ্গানা আন্দোলন সিঙ্গুরের থেকে কোনও অংশে কম নয়। তাই ওই দুই গণআন্দোলনের কথা আর একটু বিস্তারিত করে ছাত্রছাত্রীদের জানার সুযোগ দিলে কী ক্ষতি হত?
কিছু তথ্যগত ভ্রান্তিও আছে। অষ্টম শ্রেণির ‘অতীত ও ঐতিহ্য’ বইটির ১৬৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে : ‘২০০৬ সালের মে মাসে সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা স্থাপনের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে কারখানা তৈরির কাজ শুরু হয়। সে বছর সেপ্টেম্বরে কারখানার কাজ স্থগিত করার পর ৩ অক্টোবর শিল্প গোষ্ঠি সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।’ এতে মনে হচ্ছে, কারখানার কাজ স্থগিত ও শিল্পগোষ্ঠীর ছেড়ে চলে যাওয়া— দুটি ঘটনাই ২০০৭-এ ঘটেছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে: ২০০৮-এর ৩ অক্টোবর শিল্পগোষ্ঠী সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, ২০০৭-এ নয়। আর ‘গোষ্ঠি’ বানানটি হবে ‘গোষ্ঠী’।
ইতিহাস বইটিতে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকের নাম থাকলেও, কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। যে কমিটির হাত ধরে আন্দোলনের সূচনা, সিঙ্গুরের সেই ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র উল্লেখ নেই। অষ্টম শ্রেণির বইটিতে তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ছাড়াও বেচারাম মান্না, মহাদেব দাস সহ তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতা-নেত্রীর নাম থাকলেও, কমিটির যুগ্ম সম্পাদক শংকর জানা সহ সভাপতি সঞ্জীব ভট্টাচার্যের নাম নেই। অথচ অনেক পরে আন্দোলনে এসেছেন, এমন অনেকের নাম যুক্ত হয়েছে।
বইটিতে ২০০৬ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২৬ দিনের অনশনের কথা ফলাও করে বলা হয়েছে। অথচ ২০০৮-এ সিঙ্গুরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপর লাগাতার ১৫ দিনের ধর্না আন্দোলনের কথা নেই। ওই ধর্না আন্দোলনের কথা দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। মমতা তাঁর ‘আন্দোলনের কথা’ বইয়ের ১৩ পৃষ্ঠায় ‘সিঙ্গুরের ধর্না মঞ্চ থেকে’ কলামের ‘মাটির লড়াই’ অংশে এর গুরুত্বের কথা লিখেছেন। এই আন্দোলনের চাপেই সরকার রাজ্যপালের মধ্যস্থতায় রাজভবনে বৈঠক করতে বাধ্য হয়। অবস্থা অনুকূল নয় দেখে ২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ কারখানার কাজ স্থগিতের নির্দেশ দেয় টাটা কর্তৃপক্ষ। এবং ৩ অক্টোবর সিঙ্গুর ছেড়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে। সে দিনই জয়ী হল সিঙ্গুর।
সিঙ্গুরের কথা বললে অবধারিত ভাবে নন্দীগ্রামের কথা এসে পড়ে। দুই আন্দোলন একে অপরকে প্রেরণা জুগিয়েছে। সিঙ্গুরের চাষিদের প্রতিবাদ দেখে নন্দীগ্রাম যেমন সচেতন হয়েছে, তেমনই নন্দীগ্রামের ১৪ মার্চ ২০০৭-এর গণহত্যা-পরবর্তী লড়াকু মানসিকতা সিঙ্গুরবাসীকে প্রভাবিত করেছে। সিঙ্গুরের জয় এসেছে অনেক পরে, সর্বশেষ জয় আসে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে (৩১ অগস্ট ২০১৬)। অন্য দিকে নন্দীগ্রামের জনগণ বলিষ্ঠ ভাবে লড়াইয়ে যে ভাবে শামিল হয়েছিলেন, তাও স্মরণীয়। মাত্র এক বছরের লড়াইয়ে নন্দীগ্রামের ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র আন্দোলন জয়যুক্ত হয়। এই জয় সিঙ্গুরকেও পথ দেখায়। অথচ ‘ইতিহাসে’ নন্দীগ্রাম আন্দোলনের কথা ব্রাত্যই রয়ে গেল?
কার্তিক কুমার মণ্ডল
জয়পুর, পুরুলিয়া
নার্সের মহিমা
আমি নার্সিং পেশার এক জন সহযোগী অধ্যাপিকা। বিভিন্ন হাসপাতালে বা বিভিন্ন পদে ১৭ বছর কাজ করার পরে, বর্তমান আমি একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বি এসসি নার্সিং শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। আমার মোট ২০ বছরেরও বেশি সময়ের নার্সিং জীবনে, বহু প্রতিভাবান ছাত্রীকে উচ্চ মাধ্যমিকে ৯০% -এর বেশি নম্বর পেয়ে এই পেশায় যোগদান করতে এবং মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে দেখেছি। আমার সকল সহকর্মীও যৌথ প্রবেশিকা পরীক্ষায় সফলতা পাওয়ার পরে এই পেশায় যোগদান করেছেন।
দুর্ভাগ্যক্রমে, আমি এখনও পর্যন্ত নার্সদের কোথাও কোনও প্রশংসা শুনিনি। কেবল নার্সিং সম্পর্কিত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সিরিয়াল, সিনেমাগুলিতে চিত্রিত করা হয়েছে। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক বা কোনও তারকা, নার্সদের কখনও কোনও কারণে প্রশংসা করেননি। ২০২০ সালকে, ডব্লুএইচও (হু) ‘নার্স ও ধাত্রীদের বছর’ হিসাবে ঘোষণা করেছে, কারণ এটি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল-এর ২০০তম জন্মবার্ষিকী। তবুও সমাজ নার্সদের মূল্য দিতে সক্ষম হয়নি।
কিন্তু করোনা সঙ্কটের পরে এই প্রথম দেখছি, নার্সদের অবদান, আত্মত্যাগ, মমত্ববোধের কথা, ডাক্তার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সমান ভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। সমাজের সমস্ত বিভাগ এই প্রশংসা করছে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের সময়ে, ইউরোপীয় দেশে নার্সিংয়ের চিত্রটি বেশ সম্মানজনক ছিল। আমি আজ অভিভূত হয়ে পড়েছি যে, আমাদের সমাজের সর্ব স্তরের মানুষ নার্সের মূল্য, নার্সদের অবদান বুঝতে পেরেছেন। এটি পেশার ক্ষেত্রে এক দুর্দান্ত মুহূর্ত।
করোনাভাইরাস বিশ্বকে অনেক দুর্দশার সামনে দাঁড় করালেও, এই দুঃসময়ে সমাজকে নার্সিংয়ের মর্ম অনুভব করতে সহায়তা করেছে।
ঊষা মল্লিক
উদয়নপল্লি, বড়িশা
দুয়োরানি অসুখ
পনেরো বছর হয়ে গিয়েছে, এখনও সেই মেয়েটার মুখ ভুলতে পারি না। দুর্গাপূজার সময় ছিল, পুরো শহর জুড়ে মানুষ আর আনন্দের বন্যা। সদ্য সন্তানের জন্ম দেওয়া মেয়েটির রক্তবন্যা থামছিল না। এক হাসপাতাল থেকে অন্য অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পথে মেয়েটার অ্যাম্বুল্যান্স আটকে পড়েছিল সে দিন উৎসবের বেড়াজালে। সে বাঁধন কাটতে কাটতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল।
এখন রাস্তায় মানুষও নেই, আনন্দও নেই— শুধু অচেনা ভাইরাসের আতঙ্ক আর হাহাকার। তবু কায়াহীন যানজটে আজও আটকে আমাদের অ্যাম্বুল্যান্সগুলো।
চিকিৎসা করি— এখনও করছি— তাই জানি হাসপাতাল বা নার্সিং হোমগুলোর কী অবস্থা। অসুস্থ হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এর থেকে খারাপ সময় হয় না। কোভিড-১৯ ছাড়া আরও অনেক অসুখ আছে পৃথিবীতে। সেই অসুখগুলো সাধারণ নিয়ম মেনে হচ্ছে, হবেও। কিন্তু তার চিকিৎসার জায়গাগুলো নামেই খোলা আছে— কার্যত সেই ছোট তরীতে আপনার-আমার ঠাঁই নেই।
বেশ কয়েক জনের খবর শুনলাম, যাঁদের অসুখের লক্ষণগুলো করোনাজাতীয় কিছু নয়— কারও বুকে ব্যথা, কারও হঠাৎ করে প্যারালিসিস, কারও কেমোথেরাপি চলছে— এঁদের সবাইকে বিভিন্ন অছিলায় হাসপাতাল-নার্সিং হোম থেকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে। জ্বর হয় না? হয়, হয়, জানতি পারো না... জ্বর মানেই করোনা... এখানে হবে না— অন্য কোথাও যান।
পরিস্থিতি ভয়াবহ। করোনা গিলতে আসার আগে হয়তো আমরা এই আতঙ্কের গহ্বরেই তলিয়ে যাব। গত কয়েক মাস ধরে সংবাদপত্র-টিভি-রেডিয়ো-সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘন্টার পর ঘন্টা করোনা-বন্দনার খেসারত হয়তো এখন আমরা এ ভাবে দিচ্ছি।
হেনরি জেমস সাহেব একশো বছর আগে ‘দ্য টার্ন অব দ্য স্ক্রু’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন, যা ভূতের গল্প কি না, তা নিয়ে আজও বিতর্ক চলে। কিন্তু ভূত আছে, ভূত আসবে, হয়তো ভূত সামনে দাঁড়িয়ে— এই সর্ব ক্ষণের আতঙ্ক শেষমেশ বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জানি না কেন, গল্পটা বার বার মনে পড়ছে।
অরিজিৎ সেন
কলকাতা-৪৭
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।