ডিডকটের রাস্তা এখন নির্জন।
আমি থাকি ডিডকটে। এই শহরটি এখানকার রাষ্ট্রীয় সিঙক্রোটন থেকে অনেকটা কাছেই। এখান থেকে ট্রেনে অক্সফোর্ড ১৫ মিনিটে এবং লন্ডন ৪০ মিনিটে যাওয়া যায়। ২০১৮ সাল থেকেই গবেষণার জন্য এখানে রয়েছি। আগে তিন বছর ছিলাম সুইৎজারল্যান্ডে।
ঠিক ছিল, এপ্রিল মাস থেকে ভারতে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেব। সেই মতো চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ২৪ মার্চ এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ধরব, এই আশায় ছিলাম। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি খুব তাড়াতাড়িই সব কিছু বদলে দিল। হঠাৎ শুনলাম, ইউরোপের কোনও বিমান ভারতে ঢুকতে পারবে না। এখন সবই অনিশ্চিত। লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনও জানাল, যে যেখানে আছ থাক। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত কোনও ফ্লাইটের সম্ভাবনা নেই। ফলে আমাদের অনিশ্চয়তার সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশে বাড়ির আত্মীয় পরিজনদের উদ্বেগও। জানি না কবে দেশে ফিরতে পারব বা কবে সব কিছু স্বাভাবিক হবে।
এ দিকে ব্রিটেনের চেনা ছন্দ আর গতানুগতিক জীবনেও ইতিমধ্যে নেমে এসেছে লকডাউন। প্রতি দিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সর্বজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব প্রিন্স চার্লস, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, স্বাস্থ্য দফতরের সচিব ম্যাট হ্যানকক, সকলেই করোনায় আক্রান্ত। এই খবরগুলি আরও ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে।
খুব সাজানো গোছানো এই শহরের রাস্তাঘাট এখন জনমানবশূন্য। বন্ধ দোকানপাট, রেস্তরাঁ। এখন অবশ্য উদ্বেগের সামগ্রিক অভিব্যক্তি বিলেতের শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে।
স্কুল কলেজগুলিতে আগে থেকেই ছুটি। যতটা সম্ভব বাড়িতে থেকেই অনলাইনে বা ফোনের মাধ্যমে কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ এসেছে। একান্ত আবশ্যক খাদ্যসামগ্রী ওষুধপত্র কেনাকাটা বা দিনে একবার বাইরে হাঁটা ও জগিংয়ে ছাড়, তা-ও দু’মিটার দূরত্ব বজায় রেখে। আমাদের বেশিরভাগই সময় কাটছে ঘরবন্দি হয়েই। টিভি বা খবরে এ রকমই মন খারাপ করে দেওয়া বিবরণ। তাই দিনে শুধু এক বার করেই খবরে চোখ রাখছি। বাকি সময়ে প্রাণায়াম বা কিন্ডেলে বাংলা উপন্যাস বা গল্প পড়েই দিন কাটছে।
এই পরিস্থিতিতে দেখলাম মানুষের মনের প্যানিক কতটা জোরাল। সুপার মার্কেটগুলি বার বার আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও সাহেব সুবোরা বান্ডিলের পর বান্ডিল টয়লেট পেপার কিনে সাফ করে দিয়েছে। অমিল নানা নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। যেমন হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ ইত্যাদি। সাধারণত ব্রিটেনের আবহাওয়া মেঘলা আর ঝোড়ো হয়। হয় হাওয়া, নয় বৃষ্টি বেশিরভাগ সময়েই লেগে আছে। কিন্তু এখন মাঝে মাঝে বেশ রোদ উঠছে। বাইরে হাঁটতে গিয়ে লোক জন চোখে পড়ছে। কিন্তু সকলের মুখে থমথমে ভাব। কিছুটা অনিশ্চয়তা, কিছুটা উদ্বেগ আর বাকিটা ঘরবন্দি থাকার একঘেয়েমি।
সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে আশার আলোও দেখছি। যেমন স্কুলগুলি ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ফ্রন্ট লাইন স্টাফদের শিশুদের জন্য দিনে খোলা। ওই ভাবে তাদের খাবার ও দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। সুপার মার্কেটগুলি বয়স্কদের জন্য ও স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটা করার জন্য পৃথক সময় দিয়েছে। এই দুঃসময়েও যাঁরা নিরলস ভাবে কাজ করছেন তাঁদের ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা বার্তায় সেলাম জানাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। দিকে দিকে সেলফ আইসোলেশনে থাকা মানুষদের বাড়ির বাইরে খাবার রেখে আসতে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজকর্মীরা। মনের উদ্বেগ দূর করতে ফোনে বা ভিডিয়ো কলে পরামর্শ দেওয়া চলছে। ওই প্রবৃত্তিগুলিই আমাদের সমাজব্যবস্থার আকর। অদৃশ্য এক ভাইরাস আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও একাত্মবোধ। আগামী দিনগুলিতে যা আরও ভীষণ জরুরি। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অনুপ্রেরণা সেই বৈদিক বাণীর মতো, ‘আত্মন মোক্ষারথম জগদ্ধিতায় চ’। অর্থাৎ নিজের মোক্ষলাভ তথা জগতের কল্যাণ, এই আমাদের পরমার্থ।
কনক, ডিডকট, ইংল্যান্ড
অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।