এমন রাস্তা একেবারেই অচেনা। —নিজস্ব চিত্র।
অনেকদিন বাদে পাড়ার ওষুধের দোকানে গেলাম। হাতে দস্তানা, মুখে মুখোশ। মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। পৌছে কাগজে লিখে দিলাম কেন গিয়েছি, তার পরে বাইরে দাঁড়ালাম। একবারে দু’জনের বেশি দোকানের ভিতরে থাকার অনুমতি নেই। বাইরেও “টু-মিটার-ডিসটেন্স” মেনেই অপেক্ষা করতে হল।
আমার পরিচিত রাস্তাঘাট, দোকান-পাট সব কেমন অচেনা। দোকানগুলোর সামনে গুটিকতক লোক সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে। অনেকেই আড়চোখে চারপাশে নজর রাখছেন। মাঝে-মাঝে দুই-একটা গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় আমাদের পাড়ার ‘কমিউনিটি পুলিশিং টিম’-র দু’জনকে দেখলাম সাইকেলে করে চলেছেন। আমাকে ইশারায় দাঁড়াতে বললেন। অন্য সময় হলে হয়ত তাকাতেনই না। আমাদের পরিচয় অনেক দিনের। দূর থেকে গলার স্বর চড়িয়ে জানতে চাইলেন, কোথায় চলেছি। ওষুধের দোকান শুনে হাত নেড়ে যেতে বললেন। কয়েক পা এগোতেই কানে এল, “স্টে সেফ”। গত প্রায় দেড় মাস ধরে “স্টে সেফ” শব্দবন্ধই যেন জাতীয় বাক্যালাপে পরিণত হয়েছে। অনেকেই এখন এ ভাবেই অপরকে সম্বোধন করছেন। আমরা, যাঁরা বাসস্থানের নিরাপত্তায় রয়েছি তাদের কথা তাও একরকম, যাঁদের প্রতিনিয়ত কাজের জন্য বাইরে বেরতে হচ্ছে তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের উৎকন্ঠার কথা ভেবে নিজের অজান্তেই আঁতকে উঠছি।
আরও পড়ুন: লকডাউন শেখাল অনেক কিছু
আমাদের পরিচিত যাঁরা জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে কর্মসূত্রে জড়িত তাঁদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, পুলিশ, সুপারমার্কেট বা দোকানে যাঁরা কাজ করেন, ‘কেয়ারওয়ার্কার’ হিসেবে অসুস্থ এবং বয়স্কদের দৈনন্দিন কাজকর্মে সহায়তা করেন, বা যাঁরা জন-পরিবহন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত, তাঁদের সঙ্গে দেখা বা কথা হলেই ওদের মুখে একটাই কথা— “আমাদের যা করার আমরা তাই করছি।”
পরিচিত একজন ‘এন-এইচ-এস’-এ কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট সেদিন যেমন বললেন, “আমাদের মহান প্রতিপন্ন করার কোনো মানে হয় না। আমরা শুধুমাত্র আমাদের কাজটাই করছি।” কিন্তু আমরা জানি সভ্যতার সংকটের এই কঠিন লড়াইয়ে কী ভাবে বুক চিতিয়ে লড়ছেন এরা প্রত্যেকেই। প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে টেলিভিশনে খবর দেখতে বসে কিছুটা আন্দাজ করতে কী অসম লড়াইটাই না এরা লড়ছেন আমাদের সকলের হয়ে।
আমাদের মেডিকেল সেন্টারে তিনটে সার্জারি। একেকটাতে চারজন করে চিকিৎসক। এখন সার্জারিতে যাওয়ার অনুমতি নেই তাই টেলিফোন আর ইন্টারনেটেই বেশিরভাগ কাজ সারতে হচ্ছে। ডাক্তাররা অবশ্য নিয়মিত ফোন করছেন। সপ্তাহে অন্তত একবার কখনও দু’বারও। বার বার জানতে চাইছেন, কেমন আছি। কোনও দরকার আছে কি না। মানসিক ভাবে সুস্থ রয়েছি তো? প্রয়োজনে নিঃসংকোচে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলছেন। করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য রোগীরা যাতে অসুবিধার মধ্যে না পড়েন সেজন্য ‘এন-এইচ-এস’-র পক্ষ থেকে বার বার এসএমএস পাঠিয়ে সতর্ক করা হচ্ছে। মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার কথাও।
আরও পড়ুন: ৪০ দিন পর জেল থেকে বেরচ্ছি! ফের যাব কানপুর আইআইটি-র ক্যাম্পাসে
বিপদ তো কখনওই কাউকে জানিয়ে আসে না। এই অতিমারির আদর্শ মোকাবিলা প্রায় কাঁটালের আমসত্ত্বের মতো। অসুস্থদের পরীক্ষা আর চিহ্নিত করা নিয়ে সারা দুনিয়াজুড়ে নানা কথা চলছে। সকলেই সরকার-প্রশাসনের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। কিন্তু এটা কি কারওর ভাবনায় উঁকি দিচ্ছে, এমন ভয়াবহ এক বিপর্যয়ে লাখে-লাখে লোক আক্রান্ত হচ্ছেন, হাজারে-হাজারে মারা যাচ্ছেন। শত প্রস্তুতি সত্ত্বেও এর মোকাবিলা কি সহজ কাজ! চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে নয়, বরং আমি বলবো “বেনিফিট অফ হাইন্ডসাইট”। ঘটনাটা ঘটে গেলে পিছন দিকে তাকিয়ে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সমালোচনার ঝড় তোলার থেকেও কঠিন কাজ বুক চিতিয়ে বিপর্যয় মোকাবিলা করা। আর এই কথাটা সব জায়গা আর দেশের জন্যই প্রযোজ্য।
ওষুধের দোকানের বাইরে এক মহিলাকে দেখলাম তেড়ে চিনকে গালাগাল দিচ্ছেন। যেন এটা ওই দেশেরই পরিকল্পিত কীর্তি। বাড়ি ফেরার সময় আমাদের পাড়ার চিনা বংশোদ্ভুত শেরন চেং-র মুখটা কল্পনায় ভেসে উঠল। বরানগরে জন্ম। বরানগর বিদ্যামন্দিরে পড়েছেন। অনর্গল রবি ঠাকুরের কবিতা বলে যেতে পারেন। মননে আপাদমস্তক বাঙালি। অথচ চিনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধের পরে বৈরী পরিবেশের মুখে ভারত ছেড়ে ব্রিটেনে চলে আসতে বাধ্য হন। এতদিন পরেও প্রতি বছর দূর্গাপুজোর সময় দেখা হলে ছল-ছল চোখে বলেন, “আমার মা প্রতিদিন ভোরে রতনবাবুর ঘাটে গঙ্গাস্নানে যেতেন। আর সেই আমাকেই দেশ ছাড়তে হল।”
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব একদিন কাটবেই কাটবে। কিন্তু মানুষে-মানুষে বৈরীতায় আমরা যেন আটকে না থাকি। আর যাঁরা আমাদের আজকের এই বিপদে বুক দিয়ে আগলাচ্ছেন তাঁদের অবদানের কথাও যেন আমরা বিস্মৃত না হই।
সোনালী মুখোপাধ্যায়, হান্সলো, পশ্চিম লন্ডন, ইংল্যান্ড
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে)