ছবি:লেখকের নিজস্ব।
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রাইন নদীর ধারে একটি সাজানো শহর মাইন্জ। ছাপাখানার আবিষ্কর্তা গুটেনবার্গের জন্মস্থান এখানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মাইন্জ ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গথিক ক্যাথেড্রাল, সাজানো-গোছানো রাইন নদীর তীর, গুটেনবার্গ মিউজিয়াম এ সব নিয়ে জমজমাট থাকে মাইন্জের আলস্টাড অর্থাৎ ওল্ড সিটি। গুটেনবার্গ ইউনিভার্সিটি এবং ম্যাক্স প্ল্যাংক রিসার্চ ইনস্টিটিউট থাকার জন্য মাইন্জে বিদেশি ছাত্রছাত্রী এবং গবেষকদের সংখ্যা যথেষ্ট। ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটের একজন বিজ্ঞান গবেষক আমি। আমাদের ইনস্টিটিউটে প্রথম করোনা নিয়ে লোকজন চিন্তিত হয় যখন মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এ. পি. এস (আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি )-র মিটিং বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। তখনও জার্মানির মাইন্জ অঞ্চলে করোনা আক্রান্তের কোনও তথ্য ছিল না। এর পরই আমাদের কাছে ইমেল আসে জার্মানির সবচেয়ে বড় ফিজিক্স মিটিং জিপিএস (জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটি ) বাতিল হবার নোটিস। মার্চের ১৫ তারিখ থেকে জার্মানির অন্য একটি শহরে হওয়ার কথা ছিল। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের ইনস্টিটিউট থেকে জানানো হয়, কাজের সময় ন্যূনতম করা হবে। অর্থাৎ অতি প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ইনস্টিটিউট খোলা থাকবে। আমাদের ঘর থেকে কাজ করতে হবে। এখানে আমাদের প্রায় ৪০ জন সদস্যের গ্রুপ পলিমার থিওরি নিয়ে কাজ করে। আমাদের থিওরিটিক্যাল কাজের জন্য ইন্টারনেট আর একটি ল্যাপটপই যথেষ্ট। কারণ আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সুপার কম্পিউটারে কাজ করি। আমাদের ল্যাবরেটরিতে গিয়ে কাজ করতে হয় না। তাই আমাদের পক্ষে ঘর থেকে কাজ করা সম্ভব। আমার হাসব্যান্ডও হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় সে-ও চলে আসে মাইন্জে। থিওরিটিক্যাল গবেষণা হলেও ইনস্টিটিউটে গিয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনা, কফি ব্রেকে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের বাইরে অন্য বিষয়ে চর্চা না হলে মানসিক ভাবেও তো প্রত্যেকে ক্ষতিগস্ত হয়। তাই শুরু হল অনলাইন কফি আড্ডা। গ্রুপের সমস্ত সদস্য চা বা কফি বানিয়ে সপ্তাহে দু’দিন বিকেলে নির্দিষ্ট একটা সময়ে কথা বলি। পুরোদমে চলছে জার্নাল ক্লাব, রিসার্চ, এমনকি আমার জার্মান ভাষার ক্লাসও। আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার যুগে বোধহয় অনেক কিছুই সম্ভব। আমাদের বাড়ির খুব কাছেই সুপার মার্কেট। মার্চের প্রথম দিকে ক্যানড ফুড বা টয়লেট টিস্যু পেতে সমস্যা হলেও এখন আবার সব কিছু স্বাভাবিক। সুপারমার্কেটে লোকজন দূরত্ব বজায় রেখে ঢুকছে। নাহ, জিনিসপত্রের দামও আগের মতোই আছে। আপোথেকে অর্থাৎ ওষুধের দোকান খোলা। চলছে বাস, ট্রেন। যদিও সংখ্যাতে অনেকটা কম। এখানে কোনও লকডাউনের কঠোর নিয়ম নেই। মানুষ জন অনেকটা স্বেচ্ছায় নিয়ম মেনে চলছে। প্রত্যেকে হাঁটতে বা দৌড়াতে যেতে পারে। তবে ২ জনের বেশি একত্রিত হলে বেশ মোটা অঙ্কের জরিমানা হতে পারে। এই দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক হলেও মৃতর সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। জার্মান চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বাহবা দিতেই হয়। বিকেলে হাঁটতে গেলে দেখতে পাই ড্যাফোডিলস, চেরি ব্লসম, টিউলিপ উঁকি মারছে চারদিক থেকে। এতো সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ইন্টারনেট, পর্যাপ্ত খাবার সবই আছে, অন্তত আমাদের শহরে। তাই ইউরোপে আছে মানেই সবাই যে খুব কষ্টে আছে, দয়া করে এ রকম ভাববেন না। আমরা স্বেচ্ছায় এই পরিস্থিতিতে ইউরোপেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কামনা করছি যত তাড়াতাড়ি করোনার ভ্যাকসিন বাজারে আসে সেটাই বোধহয় একমাত্র পথ এই অতিমারির সঙ্গে লড়াই করার।
আত্রেয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়, ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট ফর পলিমার-এর পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চার
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন,feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)