সুইডেন দেখাল করোনা মোকাবিলার বিকল্প পথ। ছবি-লেখক।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম ঘোষিত সংক্রমণ এবং গত ১৩ মার্চ প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু থেকে শুরু করে, আজ পর্যন্ত সুইডেন লকডাউন আরোপ না করে, এক সম্পূর্ণ বিকল্প সামাজিক পদ্ধতিতে কোভিড-১৯-এর মোকাবিলা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য আলোচনা, সমালোচনা থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তির্যক মন্তব্য, সবই সমানে চলেছে।
আমার কার্যসূত্রে ষ্টকহোমে থাকা আর ইউরোপ তথা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র, ক্যারলিন্সকা ইন্সটিটিউটে কাজের অভিজ্ঞতা জানানোর জন্যই এ লেখার অবতারণা।
মহামারী শুরু হওয়া থেকে সুইডিশ পার্লামেন্ট দেশের কোভিড-১৯ বিষয়ক নীতি নির্ধারণ ক্ষমতা নিলস্ অ্যান্ডারসন টেগনেল নামে এক বিশিষ্ট মহামারী বিশারদের হাতে দেয়। বলা বাহুল্য, আজ তিন মাস হয়ে গেল, কিন্তু কোনও অবস্থায় ওই বিজ্ঞানীর দেওয়া কোনও সুপারিশই সরকারি বিরোধিতায় কার্যকরী হয়নি, এমনটা দেখা যায়নি। প্রতি দিন দুপুর ১টা থেকে ২টায় তিনি প্রেস মিটিং করেন ও দেশের বিভিন্ন অংশের সংক্রমণ পরিস্থিতি আলোচনা করেন আর সুইডিশ টেলিভিশনে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়, কোনও রাজনৈতিক দলের নেতার অনুপস্থিতি এই অনুষ্ঠানকে অন্য এক মাত্রা আর সার্বজনীনতা দেয়, সঙ্গে থাকে বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক বিশ্লেষণের ভরসা। বিজ্ঞান সাধনার ঐতিহ্য আর বিজ্ঞানমনস্কতাকে রাজনীতির পথপ্রদর্শক করে সুইডেন তার কোভিড-১৯ যুদ্ধ লড়ছে। এখন বলা যাক কোথায় আলাদা সেই রণকৌশল।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে সুইডেনের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণটি ছিল, নভেল করোনা ভাইরাসের গড় প্রতিলিপি সংখ্যা ২-২.৫, যা সাধারণ ফ্লু-এর জন্য ১.৫ আর হাম (মিস্লস) এর ক্ষেত্রে তা ১৫। উল্লেখ্য, প্রতিলিপি সংখ্যা হল, যত জন মানুষ সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে এক জন ভাইরাস-বাহক দ্বারা আক্রান্ত হন। অতএব, সংক্রমণের শুরুতেই যে বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত সত্যটি সুইডেন মেনে নেয় তা হল, নভেল করোনা ভাইরাসের মতো একটি আরএনএ ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীতে তার প্রতিকূল ফলাফল বিশ্লেষণ অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। একই কথা খাটে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় প্রচলিত আ্যন্টিভাইরাল ড্রাগের কার্যকারিতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। এবং এই সময়ের মধ্যে দেশের কমপক্ষে ৬০-৭০ শতাংশ মানুষের সংক্রমণ হতে পারে কোনও লকডাউন ছাড়া। অন্য দিকে, সামাজিক দূরত্ব ও হাত-ধোওয়ার মতো কতগুলি স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপক প্রয়োগ, সংক্রমণের হারে রাশ টানতে পারে যা আপৎকালীন স্বাস্থ্যপ্রক্রিয়ার লভ্যতাকে নিশ্চিত করে। আর অপর দিকে, দীর্ঘ লকডাউনের আর্থ-সামাজিক ভার, কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধকেই মন্থর করে। আরও এক গবেষণালব্ধ সত্য হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ অতি সাধারণ উপসর্গ দেখায়, যার জন্য আপৎকালীন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, কিন্তু একান্ত প্রয়োজন ছাড়া, অতিসক্রিয় হয়ে সকল কোভিড-১৯ রোগীর হাসপাতালে স্থানান্তরণ বৃহত্তর সংক্রমণ ও কোমরবিডিটিকে বাড়িয়ে দেয়। অন্য দিকে, এই বিপুল সংখ্যক সাধারন উপসর্গযুক্ত ও উপসর্গহীন বাহকরা এক সামাজিক অনাক্রম্যতা তৈরি করতে পারে যা কোভিড-১৯ সংক্রমণের পরবর্তী পর্যায় বা পরবর্তী সংক্রমণ তরঙ্গে প্রতিষেধক বা টিকার মতো কাজ করতে পারে।
আরও পড়ুন: কোন জেলায় করোনা আক্রান্ত কত, মৃত কত, তালিকা দিল রাজ্য সরকার
আরও পড়ুন: কেন্দ্রীয় সহায়তা চায় তৃণমূল, বিজেপি রাজ্যে
তাই প্রথমেই সুইডেন তার জনগনকে বিভিন্ন রিস্ক গ্রুপে ভাগ করে নেয়, যেমন- বয়স ৬৫-র উর্দ্ধে, ডায়াবিটিক, উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুস ও কিডনির সমস্যা থাকা মানুষজনকে বলা হয় তাঁরা যেন কঠোর ভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মেনে চলেন। আর বাকিরা যেন অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব ও হাত পরিষ্কার রাখার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করেন। এ দেশে, কোনও উপসর্গ দেখা দিলে সরাসরি হাসপাতালে না ভিড় করে আপৎকালীন নম্বরে যোগাযোগ করা হয়, তখন টেলিমেডিশিনের ডাক্তার পরামর্শ দেন হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কি না বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমেই চিকিৎসা চলবে, আর এর ফলে হাসপাতালে ভিড় থেকে অনাবশ্যক সংক্রমণ সবই প্রতিহত করা যায়।
বলা বাহুল্য, এ বারের ইষ্টারের ছুটিতে খুব কম শিশুই তাদের দাদু-ঠাম্মা-দিদাদের সাথে দেখা করতে পেরেছিল, এ শুধু প্রবীণ মানুষ গুলির স্বাস্থ্য-নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁদের কাছের মানুষজনের সংযম।
ইষ্টারের প্রাক্কালে সুইডেনের রাজা কার্ল ষোড়শ গুস্তাফ টেলিভিশনে আর্জি জানালেন-“আরও অনেক ইষ্টার আসবে, শুধু এ বছর আমরা যেন নিজেদের বয়োঃজ্যেষ্ঠদের সাথে দেখা করতে না পারার দুঃখটা ভুলে কোভিড-১৯-এ যাঁরা প্রাণ হারালেন, তাঁদের পরিবারের যন্ত্রণাটার কথা মনে করি ও অদরকারি যাতায়াত না করি।’’ বলা বাহুল্য, স্টকহোমের সেন্ট্রাল ষ্টেশন থেকে ২ মিনিট অন্তর ট্রেনগুলি রোজকার মতো আজও ছাড়ে, আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে হাতেগোনা কয়েক জন অনন্যোপায় মানুষকে পৌঁছে দেয় গন্তব্যে।
আর বাকিরা, যাঁদের বাড়ি থেকে কাজ করা সম্ভব নয়, তাঁরা নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সহকর্মীদের মধ্যে কাজের সময়ের রদবদল ঘটিয়ে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার সহকর্মী, ভিড় এড়ানোর জন্য ১২কিলোমিটার পথ যাতায়াত করছেন ইলেকট্রিক সাইকেলে। বাচ্চাকে স্কুলে ছেড়ে, কোনও দিন বৃষ্টি বা কোনও দিন হাল্কা তুষারপাতের মধ্যেও সময় ধরে কাজ করে যান। শপিং মলগুলিতে সকাল ৯টা থেকে ১১টা শুধু রিস্ক গ্রুপের মানুষরা যান আর বাকি সময়টা সবাই সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাকাটা করেন। শুধু চোখে পড়বে না পুলিশ, কারণ সুইডিশরা বিশ্বাস করেন, স্বাস্থ্যবিধির কঠোরতা তাঁদের নিজেদের ভালোর জন্যই বানানো, তার মধ্যে পুলিশের দরকার নেই।
ইউনিভর্সিটির পঠনপাঠন ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় চললেও প্রি-স্কুল থেকে হাই-স্কুল এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। কারণ, গবেষণায় প্রমাণিত তথ্য অনুযায়ী ১৫ বছরের কমবয়সীদের সংক্রমণ-পরবর্তী জটিলতা প্রায় নেই, আর বাচ্চারা স্কুলে না গেলে বড়দের অফিস যাওয়াও বন্ধ, যার অর্থ হাসপাতাল-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মী সংখ্যায় ঘাটতি। তাই স্কুল খোলা সেই প্রথম দিন থেকে।
এই অতি দুর্গম ও জটিল সময়ে ষ্টকহোমে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলতে পারি যে কোভিড-১৯ আমাদের জীবনযাত্রার রূপান্তর নিঃশব্দে করিয়ে দিয়েছে। লকডাউনের ক্ষমতা সীমিত, সময়কে বাঁধার ক্ষেত্রে। বিপুলা পৃথিবীর সকল দেশে, সকল জনগনের অংশীদারিত্বে এক দিন নিশ্চয় লকডাউন উঠে গিয়ে বিজ্ঞানসম্মত জনস্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়িত হবে। এ ভাবেও এগিয়ে যাওয়া যায়, সুইডেন দেখিয়েছিল, পৃথিবী বলবে সে দিন!
পার্থ প্রতিম বসু, সিনিয়র রিসার্চার, ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল, স্টকহোম, সুইডেন
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে)