Coronavirus Lockdown

এই অতিমারির মাঝেও সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে বস্টনের নবদম্পতি

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২০ ২১:৫৫
Share:

ছবি: লেখক।

মাসাধিক হল, আমাদের বস্টন শহরে স্তব্ধতা নেমেছে। এ শহরটি হল নিউ ইয়র্কের প্রায় প্রতিবেশী।

Advertisement

মূলত পড়ুয়াতে ভরা এ শহরে হার্ভার্ড, এমাইটি ছাড়াও আরও বেশ কিছু নামীদামি কলেজ-ইউনিভার্সিটি রয়েছে। করোনার বাজারে শহর কিছুটা ফাঁকা হচ্ছিলই। একে একে ইউনিভার্সিটি বন্ধ হচ্ছিল। বিদেশ থেকে পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের ফিরতি ভিড় উপচে পড়ছিল এয়ারপোর্টে। তবু মানুষ তো ছিলই— অফিসে, দোকানে, ব্যাঙ্কে।

১১ মার্চে, মোটামুটি এক মাস আগেও সি পোর্ট এলাকায় মানুষজন অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন টি ট্রেনে। শহরের মধ্যে ঢুকে আসা সমুদ্রের ধার ঘেঁষে গোল চাতালে হোমের আগুনের মতো আগুন জ্বলছিল ঠান্ডার আমেজ মেখে। অফিসফেরত মানুষ ডিনারে সে দিনও বসেছিলেন আগুনের আশপাশে। সমুদ্রের জল থেকে উঠে আসা চাঁদটিকে যেন আড়াআড়ি ফুঁড়ে দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল একের পর এক বিমান। তার পর তো কত জল বয়ে গেল চার্লসের তীর ছুঁয়ে। বন্ধ হয়ে গেল উড়ান, যে যেখানে ছিলেন, সেখানেই ঘরবন্দি হয়ে দিন গোনা শুরু করলেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: লকডাউনে কাজ হারাতে পারেন ১৬০ কোটি মানুষ, রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষায় ভয়াবহ ছবি

বস্টনের ফাইন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্টের ভিড় অনেকটা আমাদের পার্ক স্ট্রিট-ক্যামাক স্ট্রিটের মতো। রাত ১০টা পর্যন্ত অফিসফেরত মানুষ ট্রেনের স্টেশনের দিকে হাঁটেন। কেউ কেউ বন্ধুদের সঙ্গে হল্লা করতে করতে কাছাকাছি পাবে গিয়ে বসেন। মোটের ওপর জমজমাট এলাকা। তুলনায় সাবার্বে বা শহরতলিতে একসঙ্গে অত কেজো লোকের দেখা পাওয়া যায় না এ দেশে। তা সে ফাইনান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্টও অল্প ফাঁকা হতে শুরু করল তার দু’দিন পর থেকেই। ধীরে ধীরে এই এক মাসে ছবিটা পাল্টে গিয়েছে পুরোপুরি। আমরা এখন দু’সপ্তাহে বা আড়াই সপ্তাহে এক বার দোকানে যাই। কারণ, এখানে হোম ডেলিভারির অবস্থা খুব ভাল নয় আর। আজ গ্রসারি অর্ডার করলে, আসবে হয়তো আগামী সপ্তাহে। মাঝে দু’চারবার চেষ্টা করে দেখেছি তবুও। অর্ডার প্লেস হয়েও কিছু ক্ষণ পর থেকে একের পর এক অর্ডার ক্যানসেল হতে থাকে। শেষে দোকানে না গিয়ে উপায় থাকে না। সোশ্যাল সাইটে মিম দেখি, একমাত্র বাঙালি নামক জাতিটিই নাকি বাজার করে আর খেয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অথচ আমার সামনে মাইলের পর মাইল জুড়ে এক মিটার দূরে দূরে বাজার ভর্তি ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কেউই বাঙালি নন, ভারতীয়ই নন। বস্টনের ফরেন পপুলেশনের মাত্র ২.২ শতাংশ ভারতীয়। মোট ভারতীয়র সংখ্যা আটত্রিশ হাজার তিনশো ষোলো। যার মধ্যে আমরা দু’জন ও রয়েছি। এ সব কথা আমার মাথায় ঘোরে লাইনে দাঁড়িয়ে। আমার বন্ধুদের ধরে ধরে বলতে ইচ্ছে করে, ওই মিম ফরোয়ার্ড করা বন্ধ কর, কারণ শুধু বাঙালি কেন, এ পৃথিবীর অনেক মানুষই মারা যাচ্ছেন, যাবেনও। হয় বাজার করতে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে বা না মেনে, নয়তো অর্থাভাবে বাজার করতে না পেরে।

আরও পড়ুন: বাজারে ডিম, মাছ, মাংস কিছুই নেই, এ বার হয়তো খিচুড়ি খেয়েই থাকতে হবে শেরপুরে!

অবশ্য এখন দোকান খোলা বলতে কেবলই গ্রসারি শপ। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি রেস্তরাঁর টেবিলগুলির ওপর চেয়ার উল্টে রাখা। কখনও কোনও একটা পিৎজার দোকান খোলা। না! বসে খাওয়ার জন্য নয়। শুধু ক্যারি-আউট। আমার পাড়াতেও এমন একটি দোকান আছে। ব্লেজ। তার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে প্রাণের গন্ধ পাওয়া যায়। গরম পিৎজার গন্ধ ছাড়া আর কোন গন্ধই গোটা রাস্তায় পাই না।

এমনিতেই এখানে এখনও মাঝে মাঝে বরফ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে জানলা, বৃষ্টিতে ভেসে ধুয়ে যাচ্ছে ব্যালকনিতে পেতে রাখা চেয়ার-টেবিল। পাশের ইউনিটের জুটি ছেলেমেয়ের সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ পাক খেতে খেতে নামছে পাঁচতলা থেকে একতলা। আর কখনও কখনও আমাদের ডান দিকের ফ্ল্যাটের সারমেয়দু’টি দৌড়ে এসে রেলিঙে নাক ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে সুনসান রাস্তার দিকে। তবে আজ আবহাওয়া বেশ ভাল। রোদ্দুর উঠেছিল, ঠান্ডাও কম। তা ছাড়া, মানুষজন বোধহয় ভয় পেতে পেতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। আমিও তাই। তবে ঘরে বসেও শরীর খারাপ লাগতে থাকে। নিজের ঘরে ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজও সম্ভব নয়, কারণ কাঠের মেঝের আওয়াজে আমার নীচের প্রতিবেশীরা ক্ষেপে উঠতে পারেন। তাই মুখে মাস্ক পরে আজ হাঁটতে বেরিয়েছিলাম বাড়ির পাশের পার্কে।

১১ মার্চের আশপাশে পার্কের গাছগুলোয় সবুজের নামমাত্র ছিল না। আর আজ এত দিন পর পার্কে গিয়ে দেখি, প্রকৃতির কোনও লকডাউন নেই। তাই মহাসমারোহে সেজে উঠেছে চারপাশ। রকমারি ড্যাফোডিলের মেলায় বসন্ত জমজমাট যেন। পার্কের মধ্যে ছোট্ট জলাশয়ের ধার ঘেঁষে যে বসার বেঞ্চ, সেগুলি যদিও খালি পড়ে। তবে ইতিউতি দূরে দূরে ছুটতে থাকা তরুণী, ধীর পায়ে হেঁটে আসা দম্পতি, পোষা সারমেয়টিকে নিয়ে হেঁটে যাওয়া ভদ্রলোক, সবার মুখেই মাস্ক, চোখে বিষাদমাখা যেন।

হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দেখি, সুন্দর স্কার্ট পরা একটি মেয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ঘাড় হেলিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর সঙ্গের ছেলেটি একের পর এক ছবি তুলছে। মেয়েটির হাতে বাঁধা কোরসাজ ব্রেসলেট। মাথার ওপর দিয়ে ফেলা ভেল। এ দৃশ্য এ দেশে নতুন নয়। বহু নবদম্পতি বস্টন কমন-এ বা কাছাকাছি পার্কে ফটোশুট করে । তাঁদের সঙ্গে থাকে আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের দল। ছোট ছোট সুবেশা শিশুর মেলা বসে যায় যেন। বিশাল লেন্স হাতে ক্যামেরাম্যান ছুটে বেড়ান ক্যান্ডিড মোমেন্ট লেন্সবন্দি করতে।

কিন্তু আজ এঁদের সঙ্গে কেউ নেই। দূরে রাখা ছোট সুটকেসটির ডালা অল্প খোলা। দেখে বোঝা যায়, ওতে আরও কিছু সোয়েটার-স্কার্ফ আছে। নিজেরাই নিজেদের ফটোশুট করছে নবদম্পতি। ছেলেটিই ছবি তুলছে মেয়েটির। এ অবস্থায়, এমন দিনে আমি চাইলেও ওঁদের বলতে পারব না, তোমরা একসঙ্গে দাঁড়াও, আমি তোমাদের চুম্বনের ছবি তুলে দিচ্ছি ক্যামেরায়। মেয়েটি ফ্লাইং কিস দেওয়ার ভঙ্গি করল দু’বার। হাসছিল দুজনেই খুব। হাঁটতে হাঁটতে যখন আমি ওঁদের প্রায় কাছাকাছি তখন ছেলেটি হাঁটু মুড়ে একটু বসে আর তখনই আমার চোখ আটকাল ছেলেটির কালো জ্যাকেটের নীচ থেকে বেরিয়ে আসা নীল স্ক্রাবের অংশ। মেয়েটিও বোধহয় অন্য কোন স্কার্ফ নিতেই নিজের সুটকেসের কাছে গিয়ে সব বার করতে থাকে তখনই। এবং আমাকে অবাক করেই সেখান থেকেও উঁকি মারে ওই একই রঙের স্ক্রাবের আভাস। বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, সদ্য বিবাহিত এই ছেলেমেয়েদু’টি স্বাস্থ্যকর্মী। এ দেশে ওই স্ক্রাব দেখেই আমরা স্বাস্থ্যকর্মীদের চিনে নিই। হয়তো কাছেই কোনও হাসপাতাল থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে দু’টিতে। হাতে ফুলের কোরসাজ আর মাথার ভেলের অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্যে দিয়ে একে অপরকে ভালবাসার, সুখী করার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছে পার্কের এই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে সাক্ষী করে।

ওঁদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলি, “কনগ্র্যাচুলেশনস!” ওঁরা একগাল হেসে বলে, “থ্যাঙ্কিউউউউ।” মেয়েটির 'উ'টা একটু দীর্ঘ হয়।

বস্টন, ম্যাসাচুসেটস স্টেটের রাজধানী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনবহুল শহরগুলির মধ্যে এর স্থান একুশ। এ শহরের জনসংখ্যা ৬ লক্ষ ৯৪ হাজার ৫৮৩। আজ পর্যন্ত বস্টনে কোভিড-১৯ কেসের সংখ্যা ৫ হাজার ৫১৬। যার মধ্যে ৯৯৪ জন সুস্থ হয়েছেন আর মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন ১৭৫ জন। এ পরিসংখ্যান বস্টন শহরের সরকারি নথিতেই লেখা রয়েছে। যা লেখা নেই, তা হল বস্টন শহরের কেমব্রিজ এলাকার একটি বসন্তস্নাত পার্কে দু’টি স্বাস্থ্যকর্মী এই লড়াইয়ের মাঝে দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই অতিমারির চোখে চোখ রেখে এক নতুন সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখার। আর তাঁদের সে স্বপ্নের ডানায় একটি পালক আমিও এঁকেছি বাড়ি ফেরার পথে।

রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। তবু চারপাশের ফুলের সমারোহ দেখে বুঝি, লোকজন না থাক, ওঁদের বিয়েতে ফুলের অন্তত অভাব হল না আজ।

সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়, বস্টন, ম্যাসাচুসেটস

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement